বিটের মূল, নিমের পাতা, আর পলাশের ফুল। এইটুকুই সম্বল। সেই বিট, নিম আর পলাশের নির্যাস দিয়ে প্রথমবার ‘বাহা সাঁদেশ’ আবির তৈরি করেছেন পুরুলিয়ার বিরহড় জনগোষ্ঠীর মহিলারা। সাঁওতালি ভাষায় ‘বাহা’ হল ফুলের উৎসব, আর ‘সাঁদেশ’ মানে খবর। এবারের দোলে ওঁদের এই আবিরের ৫০ কিলো নিঃশেষিত হয়েছে প্যাকিং করার মাত্র ১৭ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে! ওঁদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরাও হতবাক আবিরের এহেন জনপ্রিয়তায়। তাই আবার জোরকদমে শুরু হয়েছে আবির তৈরির তোড়জোড়। ২০০ গ্রাম ৭০ টাকা আর ৪০০ গ্রামের প্যাকেট ১৪০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে পুরুলিয়া, বলরামপুর বাগমুণ্ডি, বালি, বেলুড়, উত্তরপাড়া দক্ষিণেশ্বর আর উত্তর কলকাতার সমস্ত মেট্রো স্টেশন চত্বরে। আবির চেয়ে ফোন আসছে কাটোয়া, বর্ধমান আর উত্তরবঙ্গ থেকেও।
পোস্ট অফিস: নেকড়ে, গ্রাম বেড়সা। বন, পাহাড় আর পলাশে ঘেরা ভূগোলে বসবাস ভারতের অন্যতম আদিম জনজাতি, বিরহড়দের। এই মুহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে ওঁদের জনসংখ্যা মাত্র ৪১০। আর সারা দেশে মাত্র ১০ হাজার। সাম্প্রতিক অতীতে চরম দারিদ্র আর অনটনই ছিল বিরহড়দের নিত্যসঙ্গী। জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে বিক্রি করাই ছিল ওঁদের মূল পেশা। আর খাদ্যাভ্যাস? ভাতের সঙ্গে কখনও আলু, কখনও শাক, জংলি পাতা কিংবা পিঁপড়ের ডিম (চলতি ভাষায় কুরকুট) ভাজা। তাঁদের সেই অবহেলার বারোমাস্যা থেকে টেনে তুলে জঙ্গলের ফলমূল আর প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে জ্যাম, জেলি আর আচার বানিয়ে পথ চলা শুরু হয় বিরহড় মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর। পুরুলিয়ার বলরামপুর ব্লক প্রশাসন আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মৈত্রেয় ফাউন্ডেশন আজ থেকে তিন বছর আগে এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কাজ শুরু করে। তারই একটি পরীক্ষামূলক ধাপ এবারের দোলে ওদের তৈরি এই আবির।
সবজি বাজার থেকে বিট কিনে তা কেটে, তারপর বেটে রোদে শুকিয়ে তৈরি হয়েছে বিটের আবির। জঙ্গলের নিম গাছে পাতা বেটে নিমের বাহা সাঁদেশ। আর পুরুলিয়ার গর্ব পলাশ ফুল দিয়ে তৈরি হয়েছে পলাশের আবির। তবে সেক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশিকা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে একটাও পলাশ ফুল গাছ থেকে পাড়েননি বিরহড় মহিলারা। গাছের তলায় ঝরে পড়া রক্তিমাভ পলাশ কুড়িয়ে এনে জলে সেদ্ধ করে মিক্সার গ্রাইন্ডারে পিষে আবির তৈরি করেছেন ওঁরা। এই সব কাজের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও খুঁটিনাটি ওঁদের হাতে ধরে মহিলাদের শিখিয়েছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, “পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আবেগের সুড়সুড়িকে মূলধন করে নয়, বরং গুণমানে বাজারের অন্যান্য ভেষজ আবিরের সমকক্ষ হয়েই যাতে নিজের স্থান করে নেয় বাহা সাঁদেশ, সেটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল”।
মৈত্রেয় ফাউন্ডেশনের সপ্তর্ষি বৈশ্য কলকাতার মানুষ হলেও ইদানিং নিত্যযাত্রীর মতই তাঁর আনাগোনা বিরহড় ডেরা বেড়সা গ্রামে। তিনিই বলছিলেন, “বাহা সাঁদেশ বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হচ্ছে, তা জমা হচ্ছে ওই মহিলাদের স্বনির্ভরগোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। আর লাভের একটি অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই মহিলাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ মূলধন। যাতে ওঁরা পরবর্তীকালে এই ধরনের কাজ করতে গিয়ে কারও মুখাপেক্ষী না হন। এমনকী আমাদের সাহায্য ছাড়াও ওঁরা যাতে প্রকৃত পক্ষেই স্বনির্ভর হতে পারেন। এটাই এখন আমাদের মূল উদ্দেশ্য।“
বসন্ত ঋতুরাজ। সে তার সেরা সম্ভার হেলায় পথে ছড়িয়ে বীর সন্ন্যাসীর মতো হেঁটে চলে যায় নীল দিগন্তে। অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে সদ্য নির্মিত নীলরঙের কিছু বাড়িতে এখন প্রান্তিক, আদিম এই বিরহড়দের ডেরা। এবারের বসন্তে ঝরে পড়া অরণ্যের সম্পদ ফুল পাতা দিয়ে বসন্তের রঙ বানিয়ে ওঁরা হাজির আমার আপনার সঙ্গে রঙমিলান্তির খেলাতে। ওঁদের তৈরি এই রঙ যেন আমাদের মর্মে, কর্মে আর যাওয়ার পথে এগিয়ে যেতে লাগে! তাই কি ফুল ফুটিয়েছে পুরুলিয়ার পাহাড়তলির পলাশবন?
ছবি সৌজন্য: মৈত্রেয় ফাউন্ডেশন