“আজ থেকে ২০০ বছর পরও যদি কেউ বাবার সম্পর্কে জানতে চান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জানতে পারবেন,” শিকাগো থেকে মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল

Sneha Sengupta | Edited By: স্বরলিপি ভট্টাচার্য

Aug 05, 2021 | 11:26 AM

‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’—‘কলকাতা ট্রিলজি’র স্রষ্টা মৃণাল সেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন না-ফেরার দেশে। কলকাতা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে তিনি শান্তি পেতেন না। এমনকী প্রাণের ‘বন্ধু’ ছেলে কুণালের কাছে শিকাগোতেও না। মৃণালকে তাঁর প্রিয়তম শহর পরিবর্তে কী দিল? মৃণাল সেনের অস্তিত্ব রক্ষা করছে ভিন দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যে দেশে ‘বন্ধু’-পিতাকে […]

“আজ থেকে ২০০ বছর পরও যদি কেউ বাবার সম্পর্কে জানতে চান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জানতে পারবেন,” শিকাগো থেকে মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল

Follow Us

‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’—‘কলকাতা ট্রিলজি’র স্রষ্টা মৃণাল সেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন না-ফেরার দেশে। কলকাতা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে তিনি শান্তি পেতেন না। এমনকী প্রাণের ‘বন্ধু’ ছেলে কুণালের কাছে শিকাগোতেও না। মৃণালকে তাঁর প্রিয়তম শহর পরিবর্তে কী দিল? মৃণাল সেনের অস্তিত্ব রক্ষা করছে ভিন দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যে দেশে ‘বন্ধু’-পিতাকে শেষ জীবনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ছেলে কুণাল সেন। মৃণালের মৃত্যুর পর বাবার অস্তিত্বকে তিনি জায়গা দিতে পেরেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে। সে কাজ অনায়াসে করতে পারত এই শহর? TV9 বাংলার সঙ্গে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে শিকাগো থেকে কুণাল জানালেন তাঁর আক্ষেপ। জানালেন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে বাবাকে তিনি কীভাবে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই করছেন আগামী প্রজন্মের জন্য।

সংরক্ষণের জন্য শিকাগোকেই কেন আদর্শ জায়গা বলে মনে হল আপনার?
আমি কলকাতায় আদর্শ কোনও জায়গা খুঁজে পাইনি। তার উপর আমি শিকাগোরই বাসিন্দা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার বহুদিনের যোগাযোগ। মুম্বইয়ে একটা ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে রেস্টরেশনের ভাল কাজ হচ্ছে। তাঁদের কাছেও বাবার কিছু জিনিস আমি দিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে শিকাগোতে যা-যা ছিল, যেমন চিঠিপত্র, ছবি ইত্যাদি সব আমি শিকাগো বিদ্যাবিদালয়কেই দিয়েছি। এটা বহু পুরনো ইনস্টিটিউশন। আমি দেখেছি এখানে কীভাবে জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়। আজ থেকে ২০০ বছর পরও যদি কেউ বাবার সম্পর্কে জানতে চান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জানতে পারবেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষই করেছিলেন। ওঁদের ব্যপস্থাপনা দেখেই আমি রাজি হয়েছি।

(২০১০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের এক্সক্লুসিভ ছবি TV9 বাংলাকে পাঠিয়েছেন কুণাল সেন)

হলিউড তথা প্রথম বিশ্বের দেশ—যেভাবে সিনেমার ইতিহাসকে ধরে রাখতে পেরেছে—ভারত তথা বাংলা পারল না কেন?
এটা আমার মনে হয় সিনেমা বলে নয়। আমাদের দেশের চরিত্রেই সংরক্ষণের গুরুত্ব নেই। আমরা পুরনো জিনিসকে পুরনো হিসেবে দেখি। কদর করতে জানি না। এগুলো কোনও একজন ব্যক্তি করতে পারেন না। অনেক খরচের ব্যাপার। এর জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারি সাহায্য়। আপনি তো জানেন, কলকাতা কিংবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সেই পরিকাঠামো রয়েছে। আর্কাইভের জন্য এয়ার কন্ডিশন ঘর, ম্যানুস্ক্রিপ্ট ধরলে সেটা রবারের গ্লাভস পরে ধরতে হয়—এই প্র্যাকটিস আছে? স্টিলের আলমারির মধ্যে পড়ে থাকে কাগজপত্র, প্রয়োজনীয় জিনিস। তারপর কেউ একটা নিয়ে চলে যায়। আর পাওয়া যায় না।

মৃণাল সেনের ১২টি শর্ট ফিল্মের ক্ষেত্রে তাই-ই হয়েছে। যেগুলো দুরদর্শনে দেখানো হয়েছিল…
একেবারেই। আমরা আর পেলাম না। বাবা আমাকে পাঠিয়েছিল ওগুলোর খারাপ কিছু ভিডিয়ো। আমি সেগুলো নেটে শেয়ার করেছি, যাতে কাজগুলো বর্তমান প্রজন্ম দেখতে পায়।

ভারত বা বাংলা থেকে কেউ আপনাকে বলেনি যে তিনি বা তাঁরা মৃণাল সেনের কাজ, জিনিস সংরক্ষণ করতে চান?
না বলেনি। একটি মাত্রা ফাউন্ডেশন আছে: মুম্বইয়ের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। তাঁরা বাবার অনেককিছু সংরক্ষণ করেছিলেন। তাঁদের কাছে অনেক কিছু আছে। বাবার ছবি আছে। বাবার পাওয়া অনেকগুলো পুরস্কারও ওঁদের কাছে আছে। এমনকী বাবার জাতীয় পুরস্কারও আছে ওঁদের সংগ্রহে। কিন্তু কলকাতায় কিছুই নেই।

কলকাতায় দিতে পারলেন না কিছু। অথচ কলকাতা ছিল মৃণাল সেনের প্রাণ। তিনটি কালজয়ী ছবি ‘কলকাতা ট্রিলজি’ নামে বিখ্যাত—‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কলকাতাতেই মৃণাল সেনের কিছু সংরক্ষিত নেই।
কলকাতায় সেই পরিকাঠামোই নেই, যে বাবার কাজ আর্কাইভ করা যাবে। পুণের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া’ বাবার কিছু কাজ রেস্টোর করেছে। ওঁদের কাছে বাবার ১৭টি ছবি আছে। আমার ফোকাস আর্কাইভের দিকে। পুরনো কাগজপত্র রাখা, সেগুলো সংরক্ষণ করা। এই কাজ করার জন্য মানসিকতার প্রয়োজন। সঠিক পরিকাঠামোরও প্রয়োজন। আমার মনে হয় দু’টোর কোনওটাই কলকাতায় নেই।

এটাকে আপনি কলকাতার দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন?
বটেই। একশো শতাংশ মনে করি। দুরদর্শনের টেলিসিরিজ় (‘কভি দূর কভি পাস’)-এর কথা আপনি কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন। দুরদর্শন তো একটি বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাঁদের কাছে এই ১২টি শর্ট ফিল্মের অরিজিন্যাল কপি আর্কাইভে ছিল। কিন্তু ধরে রাখা যায়নি। অন্য কারও মনে হয়েছে রেকর্ডিংয়ের উপর রেকর্ডিং করেছে, অর্থাৎ রিরেকর্ডিং। ব্যস, আর্কাইভ থেকে সব উধাও। পুরনো জিনিসের কদর করার মানসিকতাই আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের নেই। ইউরোপ কিন্তু সেই চর্চা বহুদিন থেকে করছে। ভারতের মিউজিয়াম ও ইউরোপের মিউজিয়ামে গেলেই পরিষ্কার হয়ে যায় বিষয়টা। আমরা পুরনোদিনের একটা চেয়ারকেও সামলে রাখতে পারি না। আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিই।

চিঠি ও ছবি ছাড়া মৃণাল সেনের আর কী-কী আছে শিকাগোতে?
শেষের দিকে ছবি তৈরির জন্য কিছু আইডিয়া এসেছিল বাবার মাথায়। সেগুলো বাবা লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু কোনওদিনও সেই সব ছবি তৈরি করতে পারেননি। সেই কাগজগুলো কিন্তু আছে। আমাকে সেই সব কপি পাঠিয়েছিলেন মেইলে। নিজে কিছু গুছিয়ে রাখতেন না। অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফেলে দিতেন বাবাও।

এছাড়া…
কাগজের ক্লিপিং। প্রেসে বাবাকে নিয়ে যা-যা লেখা বেরত, সেগুলো আমার কাছে ছিল। একবাক্স কাগজের ক্লিপিং। বিদেশের পুরস্কার। সব আর্কাইভ করছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মৃণালের শেষ জীবনের আইডিয়া নিয়ে আপনি বলছিলেন বেশ কিছু লেখা আছে আপনার মেইলে। পরবর্তীকালে অন্য কোনও পরিচালক সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের রূপ দিতে চাননি?
ছবি বানানোর কথা কোনওদিনও এগোয়নি। কিন্তু হ্যাঁ, কলকাতার এক প্রকাশক বই আকারে ছাপতে চান সেগুলো। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বাবা গোটা চিত্রনাট্য লেখেননি। আপনি খসড়া বলতে পারেন। গল্প ও চিত্রনাট্যের মাঝামাঝি।

সেই বিষয়গুলি কী ছিল? জানতে চাই কী এমন বিষয়, যা মৃণাল সেনকে শেষ জীবনে খুব ভাবাত, অথচ তিনি ছবি করতে পারলেন না?
একটি ছিল পুরনো দিনের বনেদি বাড়ির গল্প। সেখানে রয়েছেন এক মাতৃস্থানীয়া ব্যক্তি। তিনি হেড। তাঁর কথাতেই সব হয়। চিত্রনাট্যের শুরুটাই হচ্ছে, তিনি মারা গিয়েছেন এবং তাঁর স্মৃতিসভা হচ্ছে। জীবনের অনেক কিছু নিয়েই মিথ তৈরি হয়। এই মিথ বিষয়টি বাবাকে শেষের দিকে খুব নাড়া দিত। সেটা ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে লিখেছিলেন বাবা।

(২০১০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের এক্সক্লুসিভ ছবি TV9 বাংলাকে পাঠিয়েছেন কুণাল সেন)

কী-কী জিনিস আর্কাইভ করা গেল না?
অনেকগুলি পুরনো ছবি আর পাওয়াই যায়নি। প্রথমদিকের বেশির ভাগ ছবিরই কোনও কপি নেই। একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের ক্ষেত্রে সেটা সবচেয়ে বড় ক্ষতি বলে আমি মনে করি। পরের দিকের কিছু ছবির নিম্নমানের কপি এ দিকে-ও দিকে থাকতে পারে। কিন্তু ভাল কপি কারও কাছে আছে বলে শোনা যায় না। বাবার ‘জেনেসিস’ বলে একটি ছবি ছিল। বিদেশ থেকে প্রযোজনা করা হয়েছিল। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ফ্রেঞ্চ-বেলজিয়াম-সুইজ প্রযোজনায় তৈরি হয়েছিল। নাসিরউদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, ওম পুরি অভিনয় করেছিলেন। আমেরিকায় একজন ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে একটি কপি ছিল। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ামে সেটি রেস্টোর করা হচ্ছে। পরের দিকে ‘চালচিত্র’ নামের একটি ছবি তিনি তৈরি করেছিলেন বাবা। সেটারও কোনও ভাল কপি নেই।

কীভাবে সংরক্ষণ করা হয় ছবি?
ওই যে আগেই বললাম, কোনও একজন ব্যক্তির জন্য সম্ভব নয়। অনেক খরচের ব্যাপার। দেড় থেকে দু’কোটি টাকা খরচ হয়। আমার পক্ষে একা সবটা সংরক্ষণ করাও কঠিন কাজ। তবে আমি যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি কেউ যদি এগিয়ে আসেন। যেমন পুনের ইনস্টিটিউট ‘জেনেসিস’ ছবিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল। আমি খোঁজ দিয়েছি নিউ ইয়র্কে সংরক্ষণ করেছে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো সুবিধে হবে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কীভাবে কাজ করেছিলেন?
এটা সম্ভব হয়েছে আমি শিকাগোয়ে থাকি বলে। একই পাড়ায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। আমার সঙ্গে যোগাযোগ বহুদিনের। ওঁদের লাইব্রেরি ব্যবহার করেছি। এই দেশের অন্যতম সেরা লাইব্রেরি বলতে পারি। ওঁদের পরিকাঠামোর তুলনা নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর ওঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বলেন, বাবার সব কাজ আর্কাইভ করতে চান। আমি রাজি হয়েছিলাম। কোভিডের জন্য কাজ বন্ধ ছিল বহুদিন। এ দেশে করোনা পরিস্থিতি একটু ঠিক হওয়ার পর আমি নিজে গিয়ে সব দিয়ে আসি। এ বার ওঁরা আর্কাইভের কাজ শুরু করেছেন। ক্যাটালগিং শুরু করেছে। ডিজিট্যালাইজ় করবেন সবটাই। সেই কাজটা করতে ২-৩ বছর সময় লাগতে পারে। ডকুমেন্টগুলি যেহেতু বাংলায়, ফলে অনুবাদও হবে।

মৃণাল সেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ কীভাবে মনে রেখেছেন?
যাঁরা সিনেমা নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা বাবাকে চেনেন। কয়েক মাস আগে এখানকার নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটি দেখানো হয়েছিল। আমাকে যেতে বলা হয়েছিল ছবিটা ইন্ট্রোডিউস করার জন্য। আমি গিয়ে দেখলাম হল ভর্তি লোক। ছবির আলোচনার সময়েও তাঁরা ছিলেন। অনেকে মিনিংফুল প্রশ্নও করেন ছবি নিয়ে। তবে এখানে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, ইউরোপে কিন্তু বাবার পরিচিতি আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি। সেখানে শুরু থেকেই বাবার ছবি নিয়ে চর্চা হত।

মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক… বাংলা সিনেমার ট্রায়ো। বাংলা সিনেমার ধারক এবং বাহক। বাকি দু’জনকে নিয়ে মৃণাল সেন আপনাকে কী বলতেন?
ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বাবার সঙ্গে সারাক্ষণই কথা হত। ঋত্বিক কাকা ও বাবা ছেলেবেলার বন্ধু। সেই কলেজের সময় থেকে। সিনেমা তৈরি করার আগে থেকেই একে-অপরকে চিনতেন। খুব বন্ধু ছিলেন দু’জনে। কিন্তু আমি যখন বড় হলাম, দেখলাম ঋত্বিককাকার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। সুতরাং আমার জ্ঞানত তাঁকে যেভাবে দেখেছি, সেটা মনে রাখার মতো নয়। সারাক্ষণ মদ্যপান করে আছেন। সেটা ভুলে যেতে পারলেই ভাল। এটা বলতে পারি বাবা ও ঋত্বিককাকার ছবির ধরন খুবই আলাদা ছিল। ঋত্বিককাকার ছবিতে মেলোড্রামা ছিল বেশি। বাবা মেলোড্রামা পছন্দ করতেন না। সত্যজিৎ রায়কে খুবই শ্রদ্ধা করতেন বাবা। তাঁর সম্পর্কে অনেককিছু লিখেওছিলেন। তবে সত্যজিতের প্রথম দিকের ছবির জন্যই তাঁকে বেশি শ্রদ্ধা করতেন বাবা। পরের দিকের ছবি তেমন পছন্দ করতেন না। সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছিল।

আপনি আর সন্দীপ রায় তো একই স্কুলে—অর্থাৎ—পাঠভবনে পড়তেন। আপনাদের পারিবারিক গেট টুগেদার হত? আপনি, সন্দীপবাবু, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, আপনাদের মায়েরা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন? কীভাবে ফিরে দেখেন দিনগুলো?
সন্দীপ আর আমি একই স্কুলে পড়তাম ঠিকই। ও আমার থেকে একটু সিনিয়র ছিল। খুবই প্রাইভেট মানুষ ছিলেন সন্দীপ। সকলের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা করতেন না। বন্ধুবান্ধবও ওঁর বেশি ছিল না। তখন থেকেই ছবির জগতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। যে কারণে সত্যজিৎবাবুর ছবির জগতেই সন্দীপের বেশি বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়েছিল। সত্যজিৎবাবুর শুটিং চলার সময়ও স্কুলে বেশ কয়েকমাস আসতেন না সন্দীপ। ইউনিটের সঙ্গেই থাকতেন। ফলে আমার সঙ্গে সন্দীপের বন্ধুত্ব থাকলেও সেটা গভীর হয়নি কোনওদিন। গোড়ার দিকে বাবা ও সত্যজিৎবাবু যখন ফিল্ম সোসাইটি করতেন, তখন সদ্য ছবি বানানো শুরু করেছিলেন। ভালই বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ ছিল। কিন্তু পরে বন্ধুত্ব কমে এসেছিল। কোনওকালেই পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল না আমাদের দুই পরিবারের। তবে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ঋত্বিককাকাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল। খুব যাতায়াত ছিল। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব হত। ঋত্বিককাকার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেমেয়েরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন অনেকদিন। আর সত্যি বলতে কী, আমাদের তেমন আর্থিক অবস্থাও ছিল না, যে খুব বেশি হইহই করব। অনেক সময় আমাদের খাবারই জুটত না। মা বসে থাকতেন উনুনের ব্যবস্থা করে যদি কোনও খাবার আসে, তাহলেই খাওয়া হবে, না হলে হবে না।

এখনকার সিনেমা নির্মাতাদের তো আর সেই অবস্থা নয়। অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন তাঁদের…
বাবাদের ছবি থেকে মুনাফা নেওয়ার প্রবৃত্তি ছিল না। আমি দেখেছি, বাবার যখন মোটামুটি পরিচিতি হল ৭০ ও ৮০-র দশকে, কলকাতাতে ছবি না-চললেও বিদেশে ছবি বিক্রি হত। সুতরাং প্রযোজকেরা জানতেন অন্তত টাকাটা ফেরত আসবে। বাবার ছবির উপর টাকা লগ্নি করতে চাইতেন তাঁরা। তাতে সম্মান পেতেন। ছবি বিদেশে যেত। কিন্তু বাবা বার্গেইন করতেন। সেটা একটু অন্যরকমের বার্গেইনিং। বাবাকে তাঁরা বলতেন, ছবিতে লগ্নি করতে চান, কিন্তু বাজেট ৮০ লাখ টাকা। বেশি বাজেট হলে ভাল স্টার পাওয়া যায়, ঝকঝকে-তকতকে হয় ছবি। বাবা বলতেন ২০ লাখ টাকার বেশি তিনি কিছুতেই খরচ করবেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, কম খরচে ছবি করলে বেশি স্বাধীনতা পাওয়া যায়। অনেকসময় ছবিটাই তৈরি হয়নি, কারণ বাবার সঙ্গে মতের মিল হয়নি। বাবা কোনওভাবেই সমঝোতা করতে রাজি ছিলেন না।

সে কারণেই হয়তো কিছু কালজয়ী ছবি তৈরি করতে পেরেছিলেন মৃণাল সেন…
(হাসি) বাবা বহু জায়গায় লিখেওছেন, ভাল ছবি করার প্রধান শর্ত, স্বাধীনতা নিয়ে ছবি করা। ক্রিয়েটিভ স্বাধীনতা।

আপনি কখনও সিনেমা তৈরি করতে চাননি?
না আমি চাইনি। খুব অল্প বয়স থেকে আমার আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানে। তবে আমার ছবি দেখতে খুবই ভাল লাগত। ছবি নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগত। ফিল্মমেকার হওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমার।

মৃণাল সেন চাইতেন না আপনি ছবি তৈরি করুন?
না, একেবারেই চাইতেন না বাবা। আমার খুব কপাল ভাল, যে বাবা ও পরিবারের প্রত্যেকে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আমি যা হতে চাই, আমাকে সেটাই হতে দিয়েছেন। সেই স্বাধীনতার একটাই শর্ত ছিল, স্বাধীন হতে হবে। ছোট থেকেই আমার মতামত চাওয়া হয়েছে প্রত্যেক বিষয়ে। আমি ছোট বলে আমার মতামতকে অগ্রাহ্য করেননি তাঁরা। অনেকেই জানেন, বাবা ঘোরতর নাস্তিক একজন মানুষ। বাড়িতে পুজো হত না। আমি একবার বাড়িতে সরস্বতী পুজো করতে চেয়েছিলাম। বাবা কিন্তু নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও আমার সেই ইচ্ছেকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। নিজের ইচ্ছে বা ধারণাকে আমার উপর চাপিয়ে দেননি। সেই জন্যই হয়তো আমার ছবির দিকে আগ্রহ না দেখানোর বিষয়টিকে তিনি ভালভাবে দেখেছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন।

বাবা মৃণাল সেনের সঙ্গে ছেলে কুণাল সেন (২০১০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের এক্সক্লুসিভ ছবি TV9 বাংলাকে পাঠিয়েছেন কুণাল সেন)

আপনি তো বাবাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকতেন… তিনি চলে গিয়েছেন। বাবাকে কতটা মিস করেন এখন…?
বাবাকে কোন বয়স থেকে ‘বন্ধু’ ডাকতাম ঠিক মনে নেই। কিন্তু সারাজীবন বাবার মধ্যে একজন প্রকৃত বন্ধুকেই আমি পেয়েছি। বাবার সঙ্গে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে পারতাম। তিনি আমাকে বুঝতে পারতেন। ওঁর অভাব মেটার নয়। শেষ জীবনে বাবাকে যেভাবে আমি দেখেছি, সেটা সহ্য করা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল। ওরকম একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ ডিমেনশিয়ার কারণে সব ভুলে যাচ্ছিলেন। কিছু বুঝতেও পারতেন না। আমি বাবাকে বহুবার আমার কাছে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কয়েকদিনের জন্য যেতেনও। মা থাকতে চাইতেন। কিন্তু বাবা চাইতেন না। বাবার প্রাণ ছিল কলকাতা। কলকাতা ছেড়ে তিনি কোথাও গিয়ে থাকতে পারতেন না। বাবা আর কলকাতা ছিল একে অপরের পরম আত্মীয়, পরম বন্ধু!

‘কলকাতা ট্রিলজি’র স্রষ্টা কোনওদিনও কলকাতা ছাড়তে পারেননি। কিন্তু তাঁর হাত ছেড়ে দিয়েছে খোদ কলকাতাই। তাই আজ তিনি কলকাতা ছেড়ে সংরক্ষিত হচ্ছেন আমেরিকায়। ছেলের কাছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে। বাবাকে শেষজীবনে নিজের কাছে না রাখতে পারলেও। তাঁর মৃত্যুর পর কাছেই রেখেছেন ছেলে মৃণাল। এই বন্ধুত্বই বা কম কীসের।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

Next Article