মহুয়া দত্ত
‘গলৌটি কাবাব’-যার অর্থ এমন জিনিস যা মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। তা-ও আবার মটন। হ্যাঁ, মটনই হচ্ছে এই কাবাবের আসল উপাদান। যদিও আজকাল চিকেন বা নিরামিষ ‘গলৌটি কাবাব’ও পাওয়া যায়। তবে ইতিহাস বলছে, এর প্রধান উপাদান মটনই। হ্যাঁ, এই কাবাবের একটি ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু জানেন কি, রেস্তোরাঁয় গিয়ে আপনি আপনার প্রিয় যে খাবারটি অর্ডার করেন, তার একটি জোরালো ইতিহাস রয়েছে? হয়তো জানেন, হয়তো নয়। যেমন, খাদ্যরসিক অভিনেতা অম্বরীশ ভট্টাচার্য জানেন না। আবার সঙ্গীত জগতের ‘খাদ্যমন্ত্রী’ বলে জনপ্রিয় রাঘব চট্টোপাধ্যায় জানেন এই কাবাবের ইতিহাস। তিনি লখনউয়ে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে জেনেছিলেন গলৌটি কাবাবের ইতিহাস। হ্যাঁ, সারা পৃথিবীতে পাওয়া গেলেও এই ‘গলৌটি কাবাব’-এর উৎপত্তি লখনউয়ের অউধ।
যে খাবার মুখে দিলে মিলিয়ে যায়, এমন খাবার কার না পছন্দ হবে? বিশেষত মটনপ্রেমীদের কাছে তো এই খাবার পরম তৃপ্তির। বয়স হয়েছে অথবা দাঁত পড়ে গিয়েছে (আজকাল যদিও নকল দাঁত সহজলভ্য), কিন্তু মটনপ্রেম যায়নি, এমন ব্যক্তিদের কাছে এই খাবারের মূল্য কতটা, দাঁত থাকতে তা বোঝা কঠিন। কেন উঠছে দাঁত প্রসঙ্গ? আসলে কাবাবের উৎপত্তির পিছনে রয়েছে দাঁত। যাঁরা জানেন তাঁরা বুঝতেই পারছেন, কেন এটা বলা হচ্ছে। তবে যাঁরা জানেন না তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানানো, দাঁত-ই হচ্ছে এই কাবাব আবিষ্কারের পিছনের কারণ। একটু ফিরে দেখা যাক সুস্বাদু ‘গলৌটি কাবাব’-এর ইতিহাস।
লখনউয়ের খাদ্যরসিক নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের প্রিয় খাবার ছিল মটন। কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ায় তিনি দন্তহীন হয়ে পড়েন। আর তখন নকল দাঁত সহজলভ্য কী, হয়তো ছিলই না। তিনি খুব দুঃখ করতেন মটন খেতে না পেরে। খেতে বসে হতাশ নবাবকে দেখে তাঁর খানসামারও খুব খারাপ লাগত। ইতিহাস অন্তত তেমনটাই বলছে। তখন তিনি ভাবতে থাকেন, এমন কী করা যায়, যাতে মটনও থাকবে, আর নবাবও তা খেতে পারবেন। ভাবতে-ভাবতেই তিনি তৈরি করে ফেলেন ‘গলৌটি কাবাব’। কী করে সম্ভব হল এমন মুখে মিলিয়ে যাওয়া কাবাবের? কাঁচা পেঁপের সঙ্গে মটন বেটে, তাতে প্রায় ১০০ রকমের মশলা যোগ করে সেই খানসামা তৈরি করলেন এমন সুস্বাদু কাবাব, যা মুখে দিলেই মিলিয়ে যাবে। যা খেয়ে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ হলেন খুশি। আর এখন নবাবের রসোইঘর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে আমজনতার অন্যতম প্রিয় খাবার হয়েছে ‘গলৌটি কাবাব’।
যাঁরা লখনউ গিয়েছেন, তাঁরা ছোট-বড় রেস্তোরাঁয় যেমন পাবেন এই কাবাব, তেমনই এলাকার বিভিন্ন রাস্তার স্টলেও পাওয়া যায়। অনেকটা যেন লখনউয়ের জাতীয় খাবার এটি। গায়ক রাঘব লখনউয়ের একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলেন এই কাবাব। সেখানকার অভিজ্ঞতা ভাগ করে তিনি বলেন, “আমি কলকাতায় গলৌটি কাবাব খেয়েছি। কিন্তু এর পিছনে যে এমন একটি গল্প রয়েছে, তা জানি লখনউ গিয়ে। আমি সেখানকার ‘দশতর খোয়ান’ নামে একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে জানতে পারি এর ইতিহাস। ভাগ্যিস ওয়াজিদ আলির দাঁতের সমস্যা হয়েছিল। তাই তো আমরা এত ভাল একটা খাবার পেয়েছি। ওই রেস্তোরাঁয় ফিনফিনে পাতলা পরোটা আর আম-পেঁয়াজ বেটে মিষ্টি চাটনি সহযোগে ‘গলৌটি কাবাব’ পরিবেশন করা হয়। না খেলে বোঝানো যাবে না তার স্বাদ।” অম্বরীশ, যদিও ভীষণই খাদ্যরসিক, তবু গলৌটি কাবাবের ইতিহাস সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন তিনি।
আজ আর মূল রেসিপির ১০০ রকম মশলা দেওয়া হয় না রান্নায়। তবে প্রচুর মশলা থাকে এই কাবাব তৈরির জন্য। মশলাই হল এর স্বাদের ‘রাজ়’। মটন যাঁরা খান না বা যাঁদের মটন সহ্য হয় না, বিশেষত নিরামিষাশীদের জন্য আজকাল রেস্তোরাঁয় ভেজ গলৌটি কাবাব, চিকেন গলৌটি কাবাব রাখা হয় মেন্যুতে। তবে দুধের স্বাদ সব সময় ঘোলে মেটে না, মত খাদ্যরকিসদের। তাই তাঁদের কাছে ‘গলৌটি কাবাব’ মানেই মটন দিয়ে তৈরি হতে হবে। এবার রেস্তোরাঁয় গিয়ে এই কাবাব অর্ডার করলে একটা ধন্যবাদ ওয়াজিদ আলি শাহ এবং তাঁর খানসামাকে দেওয়াই যেতে পারে, কী বলেন?