‘ভানু সিংহের এ পদাবলী হৃদয়ে ধাক্কা দেয়’, কেমন হল ‘ধূমকেতু’?
মানুষ যে বড় কাঁদছে, তা পরিচালকরা বহুবার বড়পর্দায় বহু গল্পে বলেছেন। তেমনই আর একটা প্রেমের গল্প, ছটফটানির গল্প, সমাজের অন্ধকারে আলো খুঁজতে গিয়ে হাতড়ে মরার গল্প 'ধূমকেতু'। আমরা রোজ এই সমাজে আলো খুঁজি। কিন্তু পাই না। আমরা মানে, আমরা সকলে, যেখানে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো স্বার্থপরতার উদযাপন নেই। মনে করি, আজ না হোক কাল একটা সুস্থ সমাজ পাবো। তারপর উপলব্ধি হয়, সুদিন আর আসবে না!

মানুষ যে বড় কাঁদছে, তা পরিচালকরা বহুবার বড়পর্দায় বহু গল্পে বলেছেন। তেমনই আর একটা প্রেমের গল্প, ছটফটানির গল্প, সমাজের অন্ধকারে আলো খুঁজতে গিয়ে হাতড়ে মরার গল্প ‘ধূমকেতু’। আমরা রোজ এই সমাজে আলো খুঁজি। কিন্তু পাই না। আমরা মানে, আমরা সকলে, যেখানে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো স্বার্থপরতার উদযাপন নেই। মনে করি, আজ না হোক কাল একটা সুস্থ সমাজ পাবো। তারপর উপলব্ধি হয়, সুদিন আর আসবে না! ৪৭ বছর বয়সে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যে ছটফটানি থেকে এই চিত্রনাট্য-সংলাপ লিখেছেন, আজ ৫৭-তে দাঁড়িয়েও তিনি অনুভব করছেন, তা ভয়ঙ্কর প্রাসঙ্গিক। এটা তীব্র শোকের আর দুঃখের যে সমাজটা সেই জায়গাতেই আটকে রইল। আবার হয়তো এটা আনন্দের যে দশ বছর আগে তৈরি ছবিটা, বড্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।
ছবির গল্প এমন, সামান্য় খোসা ছাড়ালেই, স্পয়লার দেওয়া হবে। তাই সে পথে হাঁটছি না। তবে চরিত্রগুলো ধরিয়ে দেওয়া যায়। ভানু চরিত্রে দেব। বাবা-মা-বউকে নিয়ে তার সুখের সংসার। কিন্তু তার পরিবারের সঙ্গে এমন এক ঘটনা ঘটে যে রাতারাতি শিকড় থেকে সে নিজেকে উপড়ে নেয়। তার ছোটবেলার বন্ধুর চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষ। কেন সে শিকড় ছাড়া হলো, আর তারপর জীবন কীভাবে বদলে গেল, সেটা রয়েছে ছবি জুড়ে। ভানু কি আর ফিরবে পরিবারের কাছে? সেই উত্তর সারা ছবি জুড়ে খোঁজার পালা চলে।
ছবিতে ভানু দেবের প্রেমিকা রূপার চরিত্রে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। সিনেমার ইতিহাসে বহু সময় এমন হয়েছে যখন কোনও পরিকল্পনা না থাকলেও, প্রকৃতির খেলায় রিল আর রিয়েল লাইফ মিশে গিয়েছে। দেব-শুভশ্রী জুটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টো ছবি হয়ে রইল ‘চ্যালেঞ্জ’ আর ‘ধূমকেতু’। ‘ধূমকেতু’-র গল্প এমন, এই ছবিতে নায়ক-নায়িকা কাছাকাছি আসুন বা দূরে যান, তাতে যদি দর্শক-মনে তীব্র প্রভাব না পড়ে, তা হলে ছবি উপভোগ্য হবে না। তাই দেব-শুভশ্রী জুটি ছাড়া এই ছবি হতো না। লক্ষণীয়, দেব-শুভশ্রী প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন। তারপর বিচ্ছেদের পথে হেঁটেছেন। শুভশ্রী, দেব নয়, অন্য একজন পুরুষকে বেছে নিয়েছেন জীবনসঙ্গী হিসাবে। কিন্তু সিলমোহরের সম্পর্কের বাইরে কী রয়ে যায়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করলে, রিল-রিয়েল মিশে যাবে কোথাও-কোথাও। আবার মিশবেও না অনেক জায়গায়। কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টির এই যে খেলা, সেটাই কিন্তু ‘ধূমকেতু’ ছবিটাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এই ছবি দশ বছর আগে মুক্তি পেলে কী হতো? রিল-রিয়েল মিশে যাওয়ার খেলা এমন জমত না। তাই ছবি দেখতে বসে মনে হয়, সবার উপর প্রকৃতি সত্য, তাহার উপর নাই।
অভিনয়ের কথায় আসি। দেবের বৃদ্ধ লুকটি বহু চর্চিত। দুই লুকেই দেব নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন ছবিটা করার জন্য। তাঁর পাশে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় ভারি মিষ্টি, সাবলীল। প্রেমের গান হোক বা বিয়ের দৃশ্য, দেব-শুভশ্রী জুটির দিকে থেকে চোখ ফেরানো যায় না। দেব-শুভশ্রী বড়পর্দায় রোম্যান্টিক দৃশ্য করলে মনে হয়, এই বুঝি শহরে প্রেম করার জন্য একটা দিনের ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হবে! এর বাইরে এই ছবিতে যিনি রাজ্য জয় করে বসে রয়েছেন, তিনি রুদ্রনীল ঘোষ। তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স এটা। দেব-রুদ্রনীলের বন্ধুত্বের গল্প দেখতে-দেখতে, তাঁদের হাসি-কান্না অনুভব করতে-করতে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তা হলেই ভাবুন কীরকম অভিনেতা! কান্না তো তোলা ছিল, দেব-শুভশ্রীর জন্যই, এদিকে রুদ্রনীলও খরচ করিয়ে দিলেন…
ছবির বহু সংলাপ মনে গেঁথে যায়। দেবের মুখে বাবা-মা ডাক বুকে ধাক্কা দেয়। সিঁদুরদানে হাসি-কান্না হাত মেলায়। শেষে দেখা যায়, ছবির গল্প অসমাপ্ত। মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কলম,
”মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, এসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও…”
জানি না কত ক্ষত পেরিয়ে দেব-শুভশ্রী এই ছবির জন্য পাশাপাশি এসে দাঁড়ালেন, ‘ধূমকেতু’-র পর কিন্তু তাঁদের একসঙ্গে না-ফেরার রাস্তাটাই বুঝি বন্ধ হয়ে গেল। এই জুটিকে ফিরতেই হবে, হোক না ছুটি কাটিয়ে…
