দেবের দৃষ্টি, হাসিতে এই পুজোয় প্রেম-ভাঙা বৃষ্টি…কেমন হলো ‘রঘু ডাকাত’
লোকে বলে রঘু নাকি মা কালীর ব্যাটা? 'রঘু ডাকাত'-এ দেবকে দেখেও মনে হয়, প্রকৃতির আশীর্বাদ আছে তাঁর উপর। না হলে বাংলা ছবির হেঁশেলে দাঁড়িয়ে এমন ছবি করার সাহস তিনি করতেন না। যা কিছুতে ঝুঁকি নেই, তা বুকে আগলে রাখতে পারেন অনেক জন। কিন্তু এমন ঝুঁকি নিতে পারেন ক' জন? এসভিএফ এবং দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেঞ্চারস এই পুজোতে দর্শকদের যা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

লোকে বলে রঘু নাকি মা কালীর ব্যাটা? ‘রঘু ডাকাত’-এ দেবকে দেখেও মনে হয়, প্রকৃতির আশীর্বাদ আছে তাঁর উপর। না হলে বাংলা ছবির হেঁশেলে দাঁড়িয়ে এমন ছবি করার সাহস তিনি করতেন না। যা কিছুতে ঝুঁকি নেই, তা বুকে আগলে রাখতে পারেন অনেক জন। কিন্তু এমন ঝুঁকি নিতে পারেন ক’ জন? এসভিএফ এবং দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেঞ্চারস এই পুজোতে দর্শকদের যা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রথমে ছবির গল্পটা ধরিয়ে দিই। রঘু ডাকাতের পা পড়েছিল সেই সময়, যখন সাহেবরা নীল চাষ করে মুনাফা লোটার চেষ্টা করছিল। গরিবের চাষের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। নীল চাষ আর চাবুক হয়ে উঠছিল সমার্থক। সাহেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল অহিন্দ্র। এই চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। নৃশংস, অত্যাচারী এই ক্ষমতালোভী প্রায় রক্ত পানের আনন্দে নৃত্যরত ছিল। শুধু মৃত্যু-ভয় ছিল রঘুর থাবা থেকে। বহু যুগ আগের এই ঘটনা। তবে শোষক আর শোষিতর সমীকরণ যে আজও বদলায়নি। তাই সাহেবের চাবুককে শোষকের চাবুক ধরলে, ছবিটাকে প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
এই ছবির জোরের জায়গা চরিত্র গঠন। রঘু ডাকাত রূপে দেব কেমন, সে কথা বলছি। তার আগে অন্য চরিত্রগুলো ছুঁয়ে আসা যাক। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির একজন ‘রূপা গাঙ্গুলি’ আছেন। দেবের পাশে ডাকাত মা রূপে তিনি অতুলনীয়। রূপার চরিত্রটির অবশ্য খুব কিছু করার নেই ছবিতে। কিন্তু গুঞ্জা চরিত্রে সোহিনী সরকার খেলার জন্য বড় মাঠ পেয়েছেন। তিনি স্বভাবচিত ভঙ্গিতেই বল মাঠের বাইরে ফেলেছেন। ডাকাত দলে রঘুর সর্বক্ষণের সঙ্গী সে। সে রঘুর প্রেমে, কিন্তু রঘু তার সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়েছে…প্রেমে পড়েনি। গুঞ্জার অসহায়তা, জেদ, কষ্ট, সহ্যশক্তি, অস্থিরতা হয়তো শুধু সেই মেয়েরাই বুঝবে, যাঁদের প্রাণের মানুষ মনের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ায়, চোখের সামনে ছটফট করে, কিন্তু কোনওদিন তাঁদের হয় না। ছবিতে ওম সাহানির চরিত্রটি চমকে মোড়া। তিনি যথাযথ। রঘু ডাকাত প্রেমে পড়ে সৌদামিনীর। এই চরিত্রে ইধিকা পাল। দেব-ইধিকার জুটির ম্যাজিক ক্রমশ বাড়ছে। তাঁরা একে-অন্যকে ছুঁলে, একে-অন্যের দিকে তাকালে, একে-অন্যকে কাছে টেনে নিলে, বুকের মধ্যেটা সেই ভালোবাসার মানুষের জন্য হু-হু করে উঠবে, যাঁর সঙ্গে এবার পুজোর অন্তত একটা দিন দেখা করার আশায় আপনি শেষ মুহূর্তে অফিসে বাড়তি কাজের চাপ সামলাচ্ছেন। আর যদি মন দেবের জন্যই ছটফট করে, তা হলে সর্বনাশ। সবাই যে রাজাকে চান, তাঁর রানি হবেন কী করে?
রঘু ডাকাত একেবারেই কল্পনা-নির্ভর। ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে একটা গল্প সাজানো হয়েছে। যেখানে চরিত্রগুলোকে রূপক হিসাবে দেখা যেতে পারে। এই রূপকথায় যুক্তি নেই, আবেগ আছে। এই রূপকথায় দশবার মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর ঘুরে দাঁড়ানো আছে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজি। কখনও তা বাস্তব জীবন থেকেই পাই, আর কখনও ‘রঘু ডাকাত’ থেকে। এই ছবির চিত্রনাট্যে কিছু অংশে ছন্দপতন আছে। গল্পের বুনোট নিয়ে আরও কিছুটা কাজ করা যেত। কিছু জায়গায় ছবির গতি ধীর হয়েছে। রঘুর সঙ্গে অহিন্দ্রর প্রথমবার মুখোমুখি হওয়ার অ্যাকশন দৃশ্যটি আরও জমতে পারত। ডাকাতির একটা দৃশ্যও রাখা যেত। তবে তিরের মতো কিছু সংলাপে আর চরিত্রদের উজ্জ্বল উপস্থিতির কারণে শেষ অবধি ‘রঘু ডাকাত’-এর রেশ রয়ে যায়। যে ইউনিভার্স তৈরি করেছেন পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়, তা বাংলা ছবিতে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল বহু দিন।
মুখোমুখি দেব এবং অনির্বাণ, শুধু এই লড়াই দেখার জন্য ছবিটা দেখা যায়। অনির্বাণের হাতে অস্ত্র কম, কারণ তাঁর চোখের দৃষ্টি আগুন জ্বালায়। খলনায়ককে কিছু সময় এত ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে, যার তীব্রতা প্রেমের সমতুল্য হয়। এবার মেগাস্টারের কথায় আসি। চোখ, হাসি, উপস্থিতি, কান্না, সংলাপে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, সব কিছুতেই মনে হয়েছে চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছেন তাঁর দিকে। প্রেমের দৃশ্যে দেব এই ছবিতে স্বর্গীয়। তিনি একটু মন দিয়ে তাকালে আর হাসলে, প্রেম-ভাঙা বৃষ্টিতে শহর ভাসিয়ে দিতে পারেন।
এই ছবির সংলাপের রেশ ধরেই বলি, পরিত্রাতা তুমি কোথায়, এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে, দেবের মুখ ভেসে উঠতে পারে এই বছরে। গোটা বছর জুড়ে দর্শক তাঁর ছবি দেখলেন। শুধু বনগাঁতে নয়, বালিগঞ্জেও। এই বছরে ‘খাদান’ আর ‘ধূমকেতু’-র ব্যবসা যোগ করলে দেখা যাবে, টলিপাড়ার বাকি নায়ক-নায়িকাদের টেক্কা দিয়ে বসে রয়েছেন তিনি। এত কিছুর পরও, রঘু ডাকাত-এর মতো এক তপস্যায় মেতেছেন দেব। বাংলা ছবিকে ‘বড়’ করার তপস্যা। রঘু ডাকাত দেখে চমক লাগে, অস্ফুটে বলি, সত্যি এত বড়! পরিত্রাতা হয়ে যিনি আসেন, তাঁর লড়াই দীর্ঘ হয়, কঠিন হয়। সবুর তাঁর সঙ্গী। কিন্তু আমরা সকলে জানি, কোনও না কোনওদিন তিনি হাসবেন…একা নয়, যাঁদের জন্য লড়ছেন, তাঁদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে।
