স্টার খসলেও নক্ষত্র বিরাজমান, সন্দেশখালিতেই ‘বিনোদিনী’ নাম মমতার মাস্টারস্ট্রোক?
Star Theatre: স্বয়ং রামকৃষ্ণ যাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ দেখে হয়েছিলেন মুগ্ধ। ভাবস্থ রামকৃষ্ণ বিনোদিনীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে বলছেন, ‘চৈতন্য হোক'। সেই নটী বিনোদিনীর নামেই এবার নামকরণ হচ্ছে এবার স্টার থিয়েটারের।
জয়িতা চন্দ্র
নটী বিনোদিনী, ‘ফ্লাওয়ার অব দ্য নেটিভ স্টেজ’, ‘মুন অব দ্য স্টার কোম্পানি’। ব্যক্তি জীবন অন্ধকারময় হলেও মঞ্চ তিনি আলোকিত করে রাখতেন। স্বয়ং রামকৃষ্ণ যাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ দেখে হয়েছিলেন মুগ্ধ। ভাবস্থ রামকৃষ্ণ বিনোদিনীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে বলছেন, ‘চৈতন্য হোক’। সেই নটী বিনোদিনীর নামেই এবার নামকরণ হচ্ছে এবার স্টার থিয়েটারের। অভিনয় জগতে তিনি স্টার হলেও দিনশেষে মুখের রং, চরিত্রের সাজ ছেড়ে ফেললে গণিকা বই আর কিছু ছিল না তাঁর পরিচয়। যদিও তিনি সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছিলেন অদ্বিতীয়া। কথামৃতে সেই অধ্যায় আজও জ্বলজ্বল করছে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় স্টার থেকে বিনোদিনী
সাল ১৮৮৪, ২১ সেপ্টেম্বর, প্রথম রামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে পা রেখেছিলেন। বর্ণময় সে ইতিহাস আজও স্টারের প্রতিটা ইঁট-কাঠ-পাথরে। যেখানে স্টার থিয়েটারে নটী বিনোদিনী ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ২০২৪-এর ৩০ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন সেই স্টার থিয়েটারের নাম বদলে হচ্ছে বিনোদিনী থিয়েটার। সন্দেশখালির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “আমার এটা এখানে বলার কথা নয়, কলকাতাতেই বলার কথা। এইবার থেকে স্টার থিয়েটারের নাম হবে ‘বিনোদিনী মঞ্চ’।”
সোমবার সন্দেশখালির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। খবর সামনে আসার পরই ব্রাত্য বসু সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, “মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রবল অভিমানে মঞ্চাভিনয় ছেড়ে দেন তিনি। যে কারণে ছাড়েন, আজ তা রসজ্ঞ বাঙালি মাত্রেই জানেন। আমার লেখা ২০২১ সালে প্রকাশিত “অদামৃতকথা” উপন্যাসে সেই ইতিহাস বিশদে আছে। আজ প্রায় দেড়শো বছর পরে বিনোদিনীর প্রতি ঘটা চরম সেই অন্যায়ের আজ প্রতিবিধান করলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলা মঞ্চায়ন ইতিহাসের একটি বৃত্ত আজ সম্পূর্ণ হল।”
বিনোদিনীর অভিমান–
আজ থেকে ১৪১ বছর আগেই বিনোদিনীর নাম অনুসারে এই থিয়েটারের নাম বি-থিয়েটার হওয়ার কথা ছিল। কলকাতা বিশেষজ্ঞ গৌতম বসুমল্লিকের কথায়, “গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে থাকার সময়ে মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরির আচরণে বিরক্ত হয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ নতুন দল খুলতে উদ্যোগী হলেন। বিনোদিনীকে রক্ষিতা হিসেবে পাওয়ার শর্তে টাকা জোগালেন গুর্মুখ রায় মুসাদি নামে এক মাড়োয়ারী যুবক। ১৮৮৩ সালে ৬৮ বিডন স্ট্রিটে নির্মিত হল থিয়েটার ভবন। কথা ছিল, বিনোদিনীর নাম অনুসারে তার নাম হবে বি থিয়েটার, কিন্তু গিরিশচন্দ্র ও অন্য পুরুষ অভিনেতাদের চক্রান্তে থিয়েটারটি ‘স্টার থিয়েটার’ নামে রেজিস্ট্রি হল। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলেন বিনোদিনী। পরে গুর্মুখ তাঁকে ছেড়ে যান।”
বিনোদিনী দাসী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথায়’ বইতে লিখেছেন, “সকলে আমায় বলেন যে এই যে থিয়েটার হাউস হইবে, ইহা তোমার নামের সঙ্গে যোগ থাকিবে। তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটি বজায় থাকিবে। অর্থাৎ এই থিয়েটারের নাম ‘বি’ থিয়েটার হইবে। এই আনন্দে আমি আরও উৎসাহিত হইয়াছিলাম। কিন্তু কার্যকালে উহারা সে কথা রাখেন নাই কেন— তাহা জানি না!”
স্টার বনাম বিনোদিনী বিতর্ক
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই কলকাতার ইতিহাস খতিয়ে দেখছেন একশ্রেণি। গৌতম বসু মল্লিক নিজে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন, “এই স্টার থিয়েটার নটী বিনোদিনীর স্মৃতিধন্য নয়। সেই স্টার থিয়েটার ছিল বিডন স্ট্রিটে।” একই সুরে রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, “স্টারের নিজস্ব এক ইতিহাস রয়েছে। সেটাকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। এতদিনের এক সম্পদ, সেখানে বিনোদিনীদেবীর মূর্তি কিংবা অনেক কিছুই করা যেতে পারত।”
গৌতম বসু মল্লিকের পোস্টের এক নেটিজেন মন্তব্য করেন, “বিনোদিনীর নামে একটি মঞ্চ কলকাতায় হলে, অসুবিধা বা সমস্যার কিছু দেখছি না। বরং স্বাগত জানানো উচিত। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত না হলেও রবীন্দ্র সদন নাম রাখা যায়, শিশির ভাদুড়ির স্মৃতিবিজড়িত না হলেও শিশির মঞ্চ কলকাতায় থাকতে পারে, তাহলে বিনোদিনীর স্মৃতিবিজড়িত না হলেও ১৩৬ বছরের প্রাচীন মঞ্চের নাম বদল করে বিনোদিনীর নামে একটি মঞ্চ থাকলে কলকাতায় তাঁর নামটি অন্তত উদ্ভাসিত হতে থাকবে।” যার উত্তরে তিনি কলকাতার ইতিহাস আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লেখেন, “১৮৮৭ সালের পয়লা জানুয়ারি, সহকর্মীদের দুর্ব্যবহারে অভিনয় জগৎ ত্যাগ করেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী। আর ১৮৮৮ সালের ২৫ মে শুক্রবার, গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘নসীরাম’ অভিনয় দিয়ে সূচনা হল স্টার থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্বের পথচলা। অর্থাৎ, নটী বিনোদিনী মঞ্চত্যাগ করবার প্রায় দেড় বছর পরে সূচনা হয় কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বর্তমান স্টার থিয়েটারের।”
তবে সেই পুরাতন বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারের অস্তিত্ব কোথায়? সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন গৌতম বসু মল্লিক। বললেন, “বিডন স্ট্রিট ডাকঘরে আগে ছিল বেঙ্গল থিয়েটার। স্টার থিয়েটার ভেঙে তার উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ। ওই স্টার থিয়েটারে একটা শিবলিঙ্গ ছিল। রাস্তা তৈরির সময়ে সেটা রাস্তার পাশের একটা বাড়ির একতলায় স্থাপন করা হয়েছিল, এখনও সেটা আছে। পুরনো স্টার থিয়েটার যখন ভাঙা হয় তখন তার নাম ছিল মনমোহন থিয়েটার। তাই ওই শিবলিঙ্গটাকে লোকে মনমোহন শিব বলে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে এখন তর্জা বর্তমান। কেউ বিনোদিনী দাসীকে এই সম্মান দেওয়ার পক্ষে, কেউ আবার সত্যি উদ্ঘাটন করে সামনে নিয়ে আসছেন কলকাতার একাল-সেকাল। যেখানে স্টার থিয়েটারের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক বর্তমান। যে স্টার থিয়েটার উত্তর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র, সেই স্টার থিয়েটার যে আদপে স্টার নয়, ফলে তার নামকরণ বিনোদিনী থিয়েটার করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না একশ্রেণি। তেমনই কেউ কেউ বিনোদিনীর এই প্রাপ্তিতে বেজায় আনন্দিত। একজন্মদুঃখিনী নারী। যাঁর জীবনের প্রতিটা ছত্রে কেবলই কষ্ট-যন্ত্রণা-অপমান ছিল বর্তমান। সেই দিক থেকে বিচার করে তাঁদের মত, “বিনোদিনীর নামে একটি থিয়েটার তো হল!”
মমতার ঘোষণা কতটা রাজনৈতিক?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, তাঁর এই ঘোষণা কলকাতা থেকে করা উচিত ছিল। কিন্তু সন্দেশখালিতে দাঁড়িয়েই ঘোষণা করলেন। আর তাতে প্রচ্ছন্ন রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক কারবারিরা। তাঁদের মতে, সন্দেশখালি হচ্ছে সেই জমি, যেখানে বছর খানেক আগে নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগকে ঘিরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সন্দেশখালি। সারা দেশের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই দ্বীপ এলাকাটি। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গিয়েছে। নির্বাচনে সন্দেশখালির প্রভাব সেভাবে পড়েনি। শুধুমাত্র বসিরহাট লোকসভার সন্দেশখালি বিধানসভায় তৃণমূল দাঁত ফোঁটাতে পারেনি। সেই সন্দেশখালিতে প্রথম মমতা এসে নারী নির্যাতনের অভিযোগের বিরুদ্ধে মাস্টারস্ট্রোক খেললেন বলে দাবি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
বিজেপি কর্মী রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, “একমাত্র রাজনৈতিক কারণেই এটা করা হল। প্রথম কথা হচ্ছে, স্টার থিয়েটার নামটার সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। তিনি যে সন্দেশখালিতে গেলেন, সেখানে মা-বোনেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কী ঘোষণা করেছেন? বরং ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেরিয়ে এল। বেড বাড়ানো? সেটা তো এখানে বসেই করে দেওয়া যেত। ২০২৬-এ যখন বৈতরণী পার করা যাবে না বুঝতে পারলেন, তখন তিনি এসব করলেন। আমরা ওঁর থেকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব আশা করেছিলাম, উনি উলবোনা পিসিমণি হয়ে গেলেন, গল্প বলতে শুরু করলেন। তার জন্য তো আমাদের অভিভাবকেরা রয়েছেন।”
যদিও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এই ঘোষণা শোনার পর সাংবাদিকদের বলেন, নটী বিনোদিনীর নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আগেই। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এদিনই স্টার থিয়োটারের নাম সরিয়ে বিনোদিনী থিয়োটারের বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। মেয়র পরিষদ স্বপন সমাদ্দার বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষমায় আমরা খুশি। তিনি তার ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই এই পদক্ষেপ করেছেন।
তৃণমূল সাংসদ দেবের বান্ধবী অভিনেত্রী রুক্মিনী মৈত্রও খবর পেয়ে খুশি। বিনোদিনী রূপে বেশ কয়েক মাস আগে প্রকাশ্য়ে এসেছেন নায়িকা। ২০২৫ সালে মুক্তি পাবে রুক্মিণী অভিনীত রামকমল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘বিনোদিনী:নটীর উপাখ্যান’। যেখানে নটী বিনোদিনীর চরিত্রে সকলের নজর কাড়তে চলেছেন তিনি। আর ঠিক সেই সময় খবরের শিরোনামে নটী বিনোদিনীর ইচ্ছেপূরণ তাঁর যেন পলকে জীবন বদলে দিয়েছে। তিনি বলেন, “দিদি ঘোষণা করার পর থেকে আমি শুধু কেঁদেই চলেছি। চোখের জল আটকে রাখতে পারছি না। “সেদিন আমার সেই সিদ্ধান্তের প্রাপ্তি যদি এটা হয়। প্রায় ১৪১ বছরের এক নারীর লড়াই। আমার গোটা টিম দিদিকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ধন্যবাদ জানিয়েছে। উনি আমায় নিজে ফোন করেছিলেন।”