প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে একজন নারী থাকেন-এই কথাটি বহুল প্রচলিত। নারীর অনেক রূপ। দশভূজা হয়ে যেমন পূজিত হন, তেমনি ঘরেও তিনি দশভূজা। কিন্তু দেবী আর মানবীর মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। নারী দিবস নিয়ে অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। কিন্তু বাড়ির মা, বোন, বউ, মেয়েদের স্বার্থত্যাগকে ক’জনই বা লক্ষ্য করেন। তাই একটা দিবস পালন করা শুধু মনে করানো, তাঁরা পাশে ছিলেন, আছেন, বিভিন্নরূপে।
প্রতিদিন যাঁদের সঙ্গে কাটাই তাঁরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের জীবনে, সেটাই দেখার। নারী দিবসের দিন একটু অন্যরকম করে দেখে নেওয়া যাক টেলিভিশনের পুরুষ অভিনেতাদের জীবনের অনস্ক্রিন আর অফস্ক্রিনের কোন নারী তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
কলকাতার কুমরোটুলির ছেলে শান্তনু মাহেশ্বরী। ‘গাঙ্গুবাই কাথিওয়াড়ি’ ছবির জন্য তিনি আজ প্রশংসিত। কিন্তু শুরুটা ছিল টেলিভিশনে ‘দিল দোস্তি ডান্স’ ধারাবাহিক দিয়ে। তাঁর অফস্ক্রিন আর অনস্ক্রিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন-
“আজ আমি যেখানে পৌঁছতে পেরেছি, তার পিছনে সবচেয়ে বড় হাত পালকি ম্যামের (পালকি মলহোত্রা)। আমার প্রথম শো ‘দিল দোস্তি ডান্স’-এর প্রজেক্ট হেড ছিলেন তিনি। আমার উপর ভরসা করেছিলেন বলেই আজ আমি গাঙ্গুবাইতে।
একটু অদ্ভুত মনে হলেও অনস্ক্রিন যে ব্যক্তি আমাকে প্রভাবিত করেছেন তিনি ‘গাঙ্গুবাই’। উনি যে কোনও মানুষের জন্যই অনুপ্রেরণা। ওই সময় দাঁড়িয়ে শুধু নিজের জন্য নয়, নিজের মতো পীড়িত মানুষদের জন্য লড়াই উদ্বুদ্ধ করে। অভিনয় করতে গিয়ে তাঁকে যত জেনেছি, ততই লড়াই করার শক্তি ভিতর থেকে এসেছে।
আর একজন মানুষ হলেন আমার প্রথম ধারাবাহিকের সহ-অভিনেত্রী শ্যারন। আমাদের জুটিকে সকলে খুব পছন্দ করতেন। কোনও জুটিই জনপ্রিয় হয় না, যদি তাঁদের মধ্যে ঠিক মতো রসায়ন তৈরি না হয়। আমাদের বন্ধুত্বই আমাদের জুটির সাফল্যের কারণ। ওর কাজের প্রতি ডেডিকেশনও শিক্ষনীয়।’’
এই মুহুর্তে তিনি ব্যস্ত ‘সোনা রোদের গান’ মেগা ধারাবাহিকে। টেলিভিশনের এই অভিনেতার জনপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁর যে কোনও নতুন ধারাবাহিক নিয়েই একটা আগ্রহ থাকে দর্শকদের মধ্যে। ঋষির জীবনে অন আর অফস্ক্রিনে কারা রয়েছেন-
“অবশ্যই মা এবং স্ত্রী আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আজ আমি অভিনয় জীবন বেছে নিয়েছি, তার জন্য আমার মা সবসময় পাশে থেকেছেন। স্ত্রী এখন আমার সব ঝক্কি সামলায়। এই দুই নারী আমার জীবনে ছিল বলেই আমি নিশ্চিন্তে নিজের কাজ করতে পারি।
অনস্ক্রিন দু’জন মহিলার কথা বলব। প্রথমে পিয়াদি (অনুজা চট্টোপাধ্যায়) আর অদিতিদি (মজুমদার) কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের লেখনীতে ‘একদিন-প্রতিদিন’, ‘এখানে আকাশ নীল’ দু’টো মেগা ধারাবাহিকের জন্য আজও দর্শক মনে রেখেছেন।
তারপর আমার কেরিয়ারকে অন্যমাত্রা দিয়েছেন লীনাদি (গঙ্গোপাধ্যায়)। তাঁর সঙ্গে তিনটে কাজ করেছি। কাছ থেকে দেখেছি। অনেক কিছু শিখেছি।’’
ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। এক যুগ ধরে নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছেন। তাঁর জীবনের ঘরে-বাইরে কারা আছেন-
“অফস্ক্রিন অবশ্যই আমার মা। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মা নিজে পড়াতেন আমায়। তাঁর পুরো জীবন জুড়ে শুধুই আমি। আমি চাকরি ছেড়ে অভিনয়ের মতো অনিশ্চিত জীবন বেছেছিলাম যখন তিনি পাশে ছিলেন। যেকোনও ঝড় সামলাতে পেরেছি তাঁর জন্যই।
আমার অনস্ক্রিন দু’জন মা- মমতা শঙ্কর এবং মাধবী (মুখোপাধ্যায়) আন্টি। প্রথম ধারাবাহিকে মমতা আন্টি মা হয়েছিলেন, সেই থেকে আমাদের সম্পর্ক শুরু। আজও জন্মদিনে ফোন করা ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। কোনও কাজের প্রস্তাব পেলেই ফোন করে জানতে চান, কত টাকা পারিশ্রিমক নেবেন। বাড়িতে আড্ডা দেওয়া তো আছেই। আর মাধবী আন্টির সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। আমি একটি কাশ্মিরী গান করেছি। তার ভিডিয়োতে একমাত্র উনি আছেন। সেই কাজের বিষয়ে কথা বলার জন্য কোভিডের পর ফোন করে জানতে চাই বাড়ি যাব কি না, বললেন কাউকে আসতে দিচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আমার জন্য কোনও বারণ নেই। উনি বলেন আমায় খালি তিনি গর্ভে ধারণ করেননি। আমি তাঁর ছেলে।“
‘রানি রাসমণি’ মেগা ধারাবাহিকের ‘রামকৃষ্ণ’ সৌরভ সাহা। এর আগে তাঁকে ‘বামাক্ষ্যাপা’ রূপেও দর্শক পেয়েছেন। তাঁর জীবনে মা তারা, মা কালীর ভূমিকা অপরিসীম। এমনটাই মনে করেন তিনি।
“আমার বাস্তব জীবনে জন্মদাত্রী মা এবং ভগবান মা-দু’জনেরই অপরিসীম আশীর্বাদ রয়েছে। দুই মায়ের সঙ্গেই আমি ভীষণভাবে জুড়ে রয়েছি। সব মনের কথা মাকে না বললে চলে না। এরসঙ্গে অবশ্যই আমার স্ত্রী সুস্মিতার (মুখার্জি সাহা) কথা না বললেই নয়। ও বয়সে অনেক ছোট আমার থেকে। ধারাবাহিক করতে গিয়েই আলাপ। আমার আর আমার পরিবারের জন্য ও নিজের পেশাকে ছেড়েছে। আমাদের জন্যেই ও পুরো বাড়িতে, তাই ওর কথা আলাদা করে বলতে চাই।
অনস্ক্রিন অনেকেই আছেন। কিন্তু রাখীদি মানে শাশ্বতী ঘোষ না থাকলে আমার ঠাকুর রামকৃষ্ণ হয়ে ওঠা হতো না। তাঁর লেখনী থেকে যেন ঠাকুর চোখে সামনে জ্বলজ্বল করে উঠতেন। ঠাকুর কতটা আধ্যাত্মিক হবেন আর কতটা সামাজিক, তা তিনি তাঁর লেখনীতে স্পষ্ট করতেন। শুধু লেখা নয়, আমাকে সব সময় কী করতে হবে গাইড করেছেন। আমাকে দর্শক যে পছন্দ করেছেন, তাঁর কৃতিত্ব আমি ওঁনাকেই দিতে চাই।’’
‘গুড্ডি’ মেগা ধারাবাহিক দিয়ে বহুদিন পর পর্দায় ফেরা। তাঁর জীবনে কে কতটা জায়গা করে রেখেছেন, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, দু’ক্ষেত্রেই একাধিক মানুষ তাঁর জীবনে বেড়ে ওঠায়, বড় হওয়ায় পাশে রয়েছেন।
“আমি আমার দিদাকে মা বলে ডাকতাম। নিজের জন্মদাত্রী মায়ের থেকে দিদাই ছিলেন সব কিছু। আর আমার তিন মাসি। তাঁরা আমাকে বড় করার জন্য বিয়ে করেননি। আমাকে ঘিরেই তাঁদের জীবন। দিদার পর আসবে বড় মাসির কথা। তিনি প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। স্কুল থেকে ফিরে যেতেন নাচের ক্লাসের টিউশন নিতে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা। আবার পরের দিন একই রুটিন। শুধু এত কষ্ট করা আমার সুখের জন্য। আমার অন্য মাসিরাও কষ্ট করতেন আমার জন্য। নিজেদের রোজগার করা অর্থ জমিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। আসলে বলতে দ্বিধা নেই, আমি খুব নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। আজকে তাঁদের জন্যই আমি নিজের পছন্দের পেশায় আসতে পেরেছি।
অনস্ক্রিন সরাসরি না হলেও সোহিনী (সরকার) আর লীনাদিকে (গঙ্গোপাধ্যায়) দেখে খুব উদ্বুদ্ধ হই। আমার মতো সোহিনীও কলকাতার মেয়ে নয়। অনেকদিনের বন্ধু আমরা। কাছ থেকে দেখেছি ওর লড়াই। কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছে, তা শেখার মতো। ‘গুড্ডি’তে কাজ করতে গিয়ে কাছ থেকে দেখছি লীনাদিকে। একটা মানুষ এক সঙ্গে চার-পাঁচটি মেগার গল্প লিখছেন। সঙ্গে মহিলা কমিশনের কাজ করছেন। শুনেছি নিয়মিত যান দপ্তরে। নর্থ বেঙ্গলে শুটিংয়ে ব্যস্ত। তার মধ্যে দপ্তরের কোনও খবর পেয়ে তার কাজ করছেন। এটা অবশ্যই শেখার মতো।’’
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস