ভালবাসার সাতরঙা সন্ধ্যায় ‘মিলেনিয়াল’দের ভ্যালেন্টাইন-উদযাপনের গল্প

Sohini chakrabarty |

Feb 14, 2021 | 2:40 PM

ওঁরা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন, "সময় এসেছে ভয়কে জয় করার। সময় এসেছে উদযাপনের।"

ভালবাসার সাতরঙা সন্ধ্যায় ‘মিলেনিয়াল’দের ভ্যালেন্টাইন-উদযাপনের গল্প
উত্তরবঙ্গের জুটি বিনন্দন এবং রবি।

Follow Us

শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরশুম…

আজ ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে উদযাপনে মাতবেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। অনেকে বলেন প্রেমের রঙ নাকি নীল। কেউ বা বলেন লাল। তবে আদতে প্রেম একমাত্রিক নয়, একরঙাও নয়। বরং প্রেম রামধনুর মতো সাতরঙয়ের মিশেলে তৈরি এক পবিত্র অনুভূতি।

এমনটাই বিশ্বাস করেন বিনন্দন-রবি, দেবজিৎ, চিত্রাঙ্গদা, সুস্মিতা-আদিত্যরা। তাই প্রেম দিবসের আগের সন্ধ্যায় নিজেদের সম্পর্কের ছক ভাঙা গল্প বলতে এক ছাদের তলায় জড়ো হয়েছিলেন ওঁরা। সমাজ-সম্প্রদায়-পরিবার সকলের বাঁকা চাউনিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওঁরা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন, “সময় এসেছে ভয়কে জয় করার। সময় এসেছে উদযাপনের।”

আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে, যদি এই পথেই আসি আবার…

ওঁরা মিলেনিয়ালস। বেশিরভাগেরই জন্ম হয়েছে ২০০০ সালে বা তার পরে। বয়সে অনেকের থেকে অনেক ছোট হলেও ওঁরা নির্ভীক। ওঁরা জানেন, নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়তে। আর সবচেয়ে বেশি করে ওঁরা জানেন ভালবাসতে। প্রিয়জনের চোখে চোখ রেখে মনের কথা বলতে ওঁদের বুক কাঁপে না। বরং ওঁরা স্বীকার করতে ভালবাসেন নিজেদের পরিচয়। হাজার টিটকিরি উপেক্ষা করে হাসি মুখে ওঁরা বলতে পারেন, “আমরা ট্রান্সজেন্ডার ক্যাটেগরিতে পড়ি।” নচিকেতার গানের সূত্র ধরেই এক হাজার বসন্ত পরেও তিলোত্তমা ওঁদের সাহসকে কুর্নিশ করবেই।

রামধনু বসন্ত উৎসব

ওঁদের কেউ ট্রান্সম্যান। কেউবা নন-বাইনারি। কেউ ট্রান্সওম্যান। ‘চুমু দিবস’-এর সারাদিন ওঁরা একে অন্যকে ভালবেসেছেন। ভালবাসা-প্রেমের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছেন। প্রেমের নতুন রঙ আবিষ্কার করেছেন। শহরের বুকেই এক রেস্তোরাঁয় আয়োজিত হয়েছিল ‘রামধনু বসন্ত উৎসব’। সৌজন্যে বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর সংগঠন ‘প্রান্তকথা’। প্রেম যে রামধনুর মতো রঙিন, সকলের সেই রঙে নিজেকে রাঙানোর অধিকার রয়েছে, একথা বোঝাতেই গতকাল সকাল থেকে চলেছে ওয়ার্কশপ। সন্ধ্যায় ছিল নাচ-গান-গল্প-কবিতার আসর। সেখানেই নিজেদের জীবনের নান গল্প শোনালেন জুটিরা।

বাপ্পাদিত্যর কথায়, “আমরা আজ সকলে গোল করে বসে আলাপচারিতা সেরেছিলাম। যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চালু করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। স্কুলের ক্লাসরুমেও তো আমরা সামনে-পিছনে বসি। শিক্ষক থাকেন উঁচু পোডিয়ামে। কেমন যেন বিভেদ সৃষ্টি করে এই চিত্র। তাই আমরা গোল করে বসেছিলাম।” এই ওয়ার্কশপের সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল ‘ব্লাইন্ড ডেট’। শহরতলি আর শহুরে আদবকায়দায় বেড়াজাল ভেঙে সকলে হাজির ছিলেন এক ছাদের তলায়। ভালবাসা আদানপ্রদানের সঙ্গে সঙ্গে একে অন্যের অন্যান্য ভাবনাচিন্তাও শেয়ার করেছেন। একজনের চরম লড়াইয়ের মুহূর্ত থেকে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সময়টুকুর সাক্ষী থেকেছেন আর একজন অচেনা-অপরিচিত অথচ কাছে মানুষ।

সমাজ-সম্প্রদায় নাকি পরিবার? সবচেয়ে বড় বাধা কে বা কারা?

উনিশ বছরের দেবজিৎ। ছোটবেলাতেই বুঝেছিল শরীর পুরুষ হলেও আসলে সে মেয়ে। শাড়ি তার সবচেয়ে পছন্দের পোশাক। কিন্তু একথা বাড়িতে জানাজানি হতেই শুরু হয় অত্যাচার। মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় দেবজিৎকে। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ ছিল যে লকডাউনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করে দেবজিৎ সকলের কাছে একটাই অনুরোধ করেছিল, “আমি সসম্মানে বাড়ি ফিরতে চাই।”

দেবজিৎ

মা-বাবা-দিদিকে সাময়িক ভাবে বোঝাতে পারলেও আত্মীয়-প্রতিবেশীরা খোঁটা দিতে ছাড়েনি। আজও চলছে সেসব। তবে আড়ালে। কারণ এখন পুলিশের ভয় আছে। দেবজিতের কথায়, “শাড়ি পরা অন্যায়। পুরুষ শরীরে নারীসত্ত্বা থাকা অসুস্থতার লক্ষণ। দিনের পর দিন এসব বলে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্যে বাড়িতে ফিরেছি। এখন আমি কাউকে পাত্তা দিই না। নিজের পছন্দ মতো শাড়ি পরি, সাজগোজ করি। এখনও লোকে আমার পিছনে নানা কথা বলে। বিশ্বাস করুন তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না।” আসলে সাহসের কোনও বয়স হয় না।

সঞ্চালক বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুস্মিতা এবং আদিত্য

‘দ্য স্প্রিং ফেস্টে’ আগত অনেক জুটিই জানিয়েছেন তাঁদের জীবনের গল্প। আর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই শোনা গেল সবচেয়ে বড় বাধা-সমস্যা এসেছে পরিবার থেকে, আত্মজদের থেকে। শহরতলির জুটি সুস্মিতা-আদিত্য (ট্রান্সম্যান)। অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছেন সুস্মিতা। পরিবারের চাপে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার ছাড়া কিছুই জোটেনি। সেখান থেকে তাঁকে বের করে আনেন একদা স্কুলের বান্ধবী, বর্তমানে তাঁর প্রেমিক আদিত্য। সাহায্য করেছিলেন সুস্মিতার বাবা। কিন্তু আদিত্যর পরিবার? মেয়ের শরীরে পুরুষসত্ত্বা মেনে নেননি তাঁরা। আজও তাঁকে বিপদে ফেলার জন্য নানা ভাবে ফন্দি-ফিকির করে চলেছেন তাঁরা। তবে হার মানতে শেখেননি সুস্মিতা-আদিত্য। তাই রোজ কঠিন লড়াইয়ের পরেও জীবনকে উদযাপন করেন তাঁরা।

(বাঁদিকে) বিনন্দন-রবি (ডানদিকে)

বিনন্দন আর রবির গল্প আরও ভয়ঙ্কর। তাঁরা দু’জনেই আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে দমদমের বাসিন্দা। ছোট একটা ঘরভাড়া থেকে উঠে এসেছেন একটা ফ্ল্যাটে। তাঁদের জীবন তাঁরা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছেন। নিজের পরিবারের থেকেই প্রাণ সংশয় এসেছিল বিনন্দনের জীবনে। পছন্দের সাজপোশাক পরার স্বাধীনতা ছিল না রবির। তবে নিজেদের চেষ্টায় আর ‘প্রান্তকথা’-র সহযোগিতায় জীবনের উত্তরণ ঘটিয়েছেন তাঁরা।

গত সন্ধ্যার শো-স্টপার চিত্রাঙ্গদা-

চিত্রাঙ্গদা

বয়স কুড়ি পেরিয়েছে হয়তো। কিংবা তারও কম। পরনে ব্ল্যাক চিনোস, চেক শার্ট আর একটা দোপাট্টা। সাজসজ্জা বলতে ডার্ক লিপস্টিক-ছোট্ট টিপ, নিপুণ হাতে আঁকা ভ্রূপল্লব। সঙ্গে একটা নথ। সাজপোশাকের ফিউশনের পাশাপাশি, নিজের দৃঢ় বক্তব্যে চিত্রাঙ্গদা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সমাজের আলাদা একটা অংশ নন। বরং ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা আমার-আপনার মতোই আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ। ‘ওই ওরা যেখান থেকে আসে’, ‘আসলে তো শিক্ষাদীক্ষা নেই’, ‘ওরা তো আসলে অসুস্থ’—– এইসব মিথ একঝটকায় ভেঙে দিয়েছেন চিত্রাঙ্গাদা। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, “আমি নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত নই। জোর গলায় সবাইকে জানা দিতে পারি। বাবা বলেছিলেন তুমি না পুরুষ, সিংহ হয়ে ওঠো। আজ বাবাকে জোর গলায় বলতে পারি আমি সিংহ নয় সিংহবাহিনী হতে চাই। যদি আজীবন লড়তে হয় তাও লড়ব। কিন্তু নিজের সত্ত্বা, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবই। এটা তো আমারই লড়াই। তাই লড়তে আমাকেই হবে।”

প্রেমিক-প্রেমিকার তথাকথিত বাইনারির ছকের ঊর্ধ্বে উঠে শনিবারের সন্ধ্যায় শহর যেন উষ্ণ হয়ে উঠল ভিন্ন ইশকিঁয়ার ছোঁয়ায়।

Next Article