‘পুড়ছে মরা, আমরা শ্মশানে বসে ভাত খেয়েছি,’ টলিউডের অন্ধকার সত্যি চলে এল সামনে!

MAY DAY SPECIAL: চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে হাজার-হাজার তারকা তৈরির কারিগরদের কি আপনি চেনেন? বোধ হয় অধিকাংশের ক্ষেত্রেই উত্তরটা, 'না'। তাঁদের কথা কেউ জানেন না, কেউ চেনেন না। তাঁরা সিনেমাপাড়ার রূপসজ্জা শিল্পী, কেশসজ্জা শিল্পী। আজ মে দিবসে তাঁদের অক্লান্ত শ্রমকে কুর্নিশ জানাচ্ছে TV9 বাংলা ডিজিটাল। কেন কুর্নিশ, সে গল্প শোনাতেই এই প্রতিবেদন।

'পুড়ছে মরা, আমরা শ্মশানে বসে ভাত খেয়েছি,' টলিউডের অন্ধকার সত্যি চলে এল সামনে!
নিজস্ব চিত্র, গ্র্যাফিক্স: শুভ্রনীল মিত্র।
Follow Us:
| Updated on: May 07, 2024 | 5:04 PM

স্নেহা সেনগুপ্ত

ওই যে চুল উড়িয়ে নায়িকা যাচ্ছেন। দেখামাত্র মনের মধ্যে হাজার ভোল্টের কারেন্ট খেলে যাচ্ছে। কিন্তু চুল তাঁর কবে আর এত সুন্দর ছিল! ওই সাদামাঠা চুলে এক চুলও খামতি রাখতে না দিয়ে সম্পূর্ণ কারুকার্যটা যাঁরা করেন, আজ তাঁদের গল্প বলার দিন। সকালবেলা আধপেটা খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে স্টুডিয়োপাড়ায় ছুট দেন তাঁরা। চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে হাজার-হাজার তারকা তৈরির কারিগরদের কি আপনি চেনেন? বোধ হয় অধিকাংশের ক্ষেত্রেই উত্তরটা, ‘না’। তাঁদের কথা কেউ জানেন না, কেউ চেনেন না। তাঁরা সিনেমাপাড়ার রূপসজ্জা শিল্পী, কেশসজ্জা শিল্পী। আজ মে দিবসে তাঁদের অক্লান্ত শ্রমকে কুর্নিশ জানাচ্ছে TV9 বাংলা ডিজিটাল। কেন কুর্নিশ, সে গল্প শোনাতেই এই প্রতিবেদন।

এই খবরটিও পড়ুন

প্রথমেই আসা যাক সোমনাথ কুণ্ডুর প্রসঙ্গে। ২৮-৩০ বছর ধরে সিনেমার দুনিয়ায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেকআপ করাচ্ছেন সোমনাথ। নায়ক-নায়িকাদের গালে রুজ়, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখিয়ে, নানা রং ব্যবহার করে তাঁদের পারফেক্ট তৈরি করে পর্দার সামনে পেশ করছেন তিনি। একদিন সেই সোমনাথই ঠিক করলেন, গতের বাইরে বেরিয়ে আসতেই হবে। না হলে আর নতুন কী হল! এমনিতে ২০০ টাকা, ৩০০ টাকা পকেটে গুঁজে দিয়ে প্রোডাকশন বলত, “বাড়ি এসো বাবা।” সেই থেকেই ছকভাঙার কাজে লিপ্ত হলেন সোমনাথ। কী সেই কাজ? ওই যে দেখতে একরকম মানুষকে একেবারে অন্যরকম রূপ দেওয়া। প্লাস্টিক সার্জারির বিকল্প–প্রস্থেটিক মেকআপ। বলতে পারেন, মেটামরফসিসিও।

হঠাৎ করে তো আর নিজেকে স্বতন্ত্র করার ইচ্ছা মনে জাগেনি সোমনাথের? ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চাচি ৪২০’ ছবিতে কমল হাসানের ছেলে থেকে মেয়েতে রূপান্তরিত হওয়ার মেকআপ দেখে সোমনাথের মনে প্রবল ইচ্ছা জাগে, “এই মেকআপটা আমাকেও শিখতে হবে।” সেই থেকে পরিকল্পনা চলে। কিন্তু এই মেকআপের জন্য সোমনাথকে কেন কেউ বিশ্বাস করবেন? তাই প্রথমে নিজের কাজ প্রমাণের প্রচেষ্টায় ব্রতী হলেন এই রূপসজ্জা শিল্পী। সোমনাথ বলেছেন, “আমাকে তো এই ইন্ডাস্ট্রি প্রস্থেটিক মেকআপ করার সুযোগই দেবে না। কেন দেবে? তাই নিজেকে প্রমাণ করতে লেগে গেলাম।”

ইন্ডাস্ট্রির কিছু পরিচালকের নজরে এসেছিলেন সোমনাথ। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ই প্রথম ভরসা করেছিলেন। তাঁর প্রতিভা দেখানোর একটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন ‘জ়ুলফিকর’ ছবিতে। তারপর ‘ইয়েতি অভিযান’-এ। ‘ভিঞ্চিদা’তেও। ‘ভিঞ্চিদা’র প্রধান চরিত্রটি আবার এক প্রস্থেটিক মেকআপ শিল্পীরই। লোকের নজরে চলে আসেন সোমনাথ কুণ্ডু। পরপর কাজ আসতে থাকে তাঁর। ‘গুমনামী’তে প্রসেনজিতের নেতাজি লুক, ‘অপরাজিত’তে জিতু কামালের সত্যজিৎ রায় লুক, ‘এক যে ছিল রাজা’তে যিশু সেনগুপ্তর লুক, ‘আগন্তুক’ ছবিতে অভিনেত্রী সোহিনী সরকারকে বৃদ্ধা তৈরি করা থেকে শুরু করে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’-এ শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের লুক… সব তৈরি করেছেন সোমনাথ। আর আজ আত্মবিশ্বাসী তিনি বলে ওঠেন, “এই লুকগুলো ভাইরাল হয়েছিল বলেই আজ আপনারা আমার কথা জানেন… না হলে জানতেও পারতেন না। এক কোণে পড়ে থাকতাম। TV9 বাংলা শ্রমিক দিবসে আমাকে ফোনটাও করত না।”

মেকআপ করছেন সোমনাথ কুণ্ডু।

বলতে-বলতে গলাটা ধরে আসে সোমনাথের। ইন্ডাস্ট্রির মেকআপ আর্টিস্টরা ঠিক কেমন আছেন, জানতে চাওয়ায় সোমনাথের সহজ স্বীকারোক্তি, “আছি এক রকম। কিন্তু বড্ড অভাব এই ইন্ডাস্ট্রিটার। অনেককিছু নেই। একজন শ্রমিক হিসেবে আমার একটা অভিযোগ আছে। লিখবেন দিদিমণি (TV9 বাংলার প্রতিবেদককে ‘দিদিমণি’ সম্বোধন করেন সোমনাথ)?”

সোমনাথের তারপর যা বললেন যেন আঁতকে ওঠার মতো বিষয়। রূপসজ্জা শিল্পীর স্পষ্ট বক্তব্য, “দিদি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একটা গোলমেলে ব্যাপার হল, সময়। সিরিয়ালে ১২ ঘণ্টা কাজ হয় আমাদের মতো মেকআপ আর্টিস্টদের। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে বিষয়টা যেন জুত হওয়ার মতো না। ১২ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা–বিরমহীন শুটিং। মাঝে ৬ ঘণ্টার জন্য যদি কেউ বাড়ি চলেও আসেন, ফ্রেশ হয়ে আবার শুটিং যাওয়ার মাঝে বিশ্রামের অবকাশ নেই বললেই চলে।”

সোমনাথের নালিশ থামতেই চায় না। তাঁর বক্তব্য, একটু যদি কাজের সময়সীমার বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন কেউ…মুম্বই এবং দক্ষিণে ১২ ঘণ্টা কাজ হয়। টালিগঞ্জে হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেছেন সোমনাথ। সেই সঙ্গে শিল্পীর সংযোজন, “আমি কিন্তু তারকাদের সঙ্গে জুনিয়র আর্টিস্টদেরও মেকআপ করি। বেশি না হলেও টাচআপ করে দিই। জুনিয়র আর্টিস্টদের অবস্থা দেখে আমি স্তম্ভিত। যুগযুগ ধরে এই আর্টিস্টগুলো অবহেলিত। ওদের যদি সম্মানের সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করা হয়, ভাল লাগবে। চেয়ার না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিংবা মাটিতে বসেন।”

কেবল বসার ব্যবস্থাপনা নয়, শুটিংয়ের আধঘণ্টা খাওয়ার সময়টাও যাতে ঠিক মতো বসার ব্যবস্থা করা হয়, সেদিকটাও দেখার অনুরোধ করেছেন সোমনাথ। বলেছেন, “আসলে ওরাও শ্রমিক। বহু সময় নিজেরা বলতে পারে না নিজেদের কথা। ওদের হয়ে মুখ খোলাটা মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ। বাকি আমরা তো পুড়ছে মরা, শ্মশানে বসে ভাতও খেয়ে নিই।”

এটা কী বললেন সোমনাথ? শ্মশানে বসে খাওয়াদাওয়া! বললেন, “করতে হয়তো। নিমতলা শ্মশানের সামনে শুটিং ছিল ‘ভিঞ্চিদা’র। উপায় নেই, কী করব? আমরা শ্মশানে বসেও খেয়েছি। আবার পাঁচতারা হোটেলেও খেয়েছি।”

আর পারিশ্রমিক? সে ব্যাপারেও বললেন সোমনাথ। “বাংলা বাজারে টাকা নেই, সোজা কথা জানেন, আমি তাই টাকাই চাই না বেশি। কিন্তু মুম্বইয়ে কাজ করলে ওদের থেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিকটাই চেয়ে নিই। একটুও কমাই না।” TV9 বাংলা খোঁজ নিয়ে জেনেছে পরিচালক সুজয় ঘোষের ‘জানে জা’ ছবির জন্য কলকাতার চেয়ে চারগুণ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সোমনাথ। বলেছেন, “মুম্বইয়ের লোকেরা এখন জানে কলকাতায় একটা লোক আছে, যে প্রস্থেটিকটা করতে পারে। ভেবে ভাল লাগে, সেই সম্মানটা মুম্বই আমাদের দিচ্ছে। কলকাতায় শুটিং হলে বাইরে থেকে লোক নিচ্ছে না। আমাদেরও ডাক পড়ছে। করিনা কাপুর খানের মতো তারকারা আমাদের কদর করছেন।”

কেশসজ্জায় ব্যস্ত হেমা মুন্সি এবং রূপসজ্জা শিল্পী মহম্মদ আলি।

আর তো তেমন উল্লেখযোগ্য প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট নেই কলকাতায়। নিজের মেকআপ প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমি তৈরি করছেন কি সোমনাথ? তাঁর জড়তাবিহীন উত্তর, “যে মেকআপটা করি, সেটা কাউকে শেখাতে চাই না। ওটায় অনেক ধরনের অপরাধের জন্ম হতে পারে। এই মেকআপে লোকের চেহারা পাল্টে ফেলা যায় সহজেই। প্রস্থেটিকের সাহায্যে সত্যি-সত্যি কেউ অন্য কারও মতো সেজে খুন-ডাকাতি করতে পারে। অপহরণ করতে পারে…”

একদিকে যেমন সোমনাথ মনে করছেন রূপসজ্জা শিল্পীদের কদর বাড়ছে বাইরের দুনিয়ার কাছে, অন্যদিকে কেশসজ্জা শিল্পী হেমা মুন্সি তুলে ধরেছেন অন্য এক চিত্র। হেমার বাবাও ছিলেন এক রূপসজ্জা শিল্পী। বাবার হাত ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর কাজের সুযোগ এসেছে। হেমার সঙ্গে অনেক নামী হিরোইন দুর্ব্যবহার করেছিলেন শুরুর দিকে। এমনও কথাও সুধিয়েছিলেন মুম্বইয়ের নামজাদা অভিনেত্রী, “টয়লেট করে ফ্লাশ করতে পারো তো?”

সেই হেমা তিন দশক পার করেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। শ্রমিক দিবসে কেশসজ্জা শিল্পীদের হয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন হেমা। বলেছেন, “আগে আমাদের একটি কার্ড দিত কেন্দ্রীয় সরকার। সেই কার্ডটিতে কিছু সুবিধা পেতাম। শরীর খারাপ, মেয়ের বিয়েটিয়েতে টাকা দিত সরকার। সেই কার্ড আমার কাছে আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে মোদী সরকার আসার পর সেই কার্ডের রেজিস্ট্রেশন হয়নি ঠিক মতো। আমরা এখান থেকে সব করে পাঠাই, ওখানে কিছুই হয় না। ফলে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন অনেকেই।”

শ্রম নিয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকেন হেমা। প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে তাঁর মনে। বলেন, “আমারা কিন্তু পিছিয়ে পড়েছি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে। আমি নিজে কাজের সুযোগ পাই। কিন্তু আমার সহকর্মীরা তা পান না সকলে। একটা কথা বলি শুনুন, কিছুদিন আগে আমাদের এখানে একটা ফরাসি ছবির শুটিং হয়েছে। তাতে মুম্বইয়ের মেকআপ আর্টিস্ট এবং হেয়ার ড্রেসারদের ডাক পড়েছিল। কেন আমাদের ছেলেমেয়েগুলো কাজ পারেন না নাকি?”

হেমা জানালেন বিস্ফোরক তথ্য। বললেন, “আমাদের এখানকার কেশসজ্জা শিল্পীদের কুকুর-বিড়ালের মতো বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল টাবু খাটিয়ে। যাতে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কাজ করছেন এখানকার শিল্পী নিয়ে। টাকাও দিচ্ছেন। কিন্তু কাজ করানোর সময় বাইরের শিল্পীদের দিয়ে করাবেন। এটা কি ঠিক কথা?”

হেমার কাজের পরিধি অনেকটাই। সইফ আলি খানের চুল ব্যাকব্রাশ করে দিয়েছিলেন বলে তাঁর মা অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেয়েছিলেন হেমা। লুক দেখে সইফ আপ্লুত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “আমার লুক ভাল লেগেছে। পরের ছবিগুলোতেও এই লুকটাই রাখব।” হেমার কথায়, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর চুল দারুণ ভাল। লাবণী সরকারের চুলও সুন্দর। বাকি অনেককেই চুলে এক্সটেনশন লাগাতে হয়।

একসময় না হলেও আজ হেমার কদর রয়েছে। তিনি শ্রম দিয়ে মর্যাদা অর্জন করেছেন। সোমনাথও তাই। হাল ছাড়েননি। কিন্তু অনেকেই পারেননি জেদটা ধরে রাখতে। লকডাউনে কর্মহীনতার কারণে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে এসেছিলেন অনেক কেশ এবং রূপসজ্জা শিল্পীই। বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, কসবায় আলু, পটলের দোকান দিয়েছেন। লেক মার্কেটে ফুলের ব্যবসাও করেন কেউ-কেউ। প্রতিকূলতাকে প্রতিরোধ করে টিকে থাকতে পারেননি কম পারিশ্রমিকের ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু হেমা-সোমনাথরা বলেন, লেগে থাকাই হল বেঁচে থাকা। বিন্দু-বিন্দু জুড়ে সিন্দু তৈরিতে আজও মন তাঁদের। শ্রমিক দিবসে তাই তাঁদের উপলব্ধি, হাল ছেড়ো না বন্ধু, কাজ করো হাতে-হাত রেখে…।