২১ ফেব্রুয়ারি যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তেমনই বাঙালির জন্য—বিশেষত সিনেমাপ্রেমী বাঙালির জন্য—আরও একটি বিশেষ দিন। এই দিন অভিন্ন বাংলাদেশে জন্মছিলেন এক নক্ষত্র: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এ বছর ৮৫ বছরে পা দিলেন এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী। এখনও দাপটের সঙ্গে পারফর্ম করে চলেছেন। এই বয়সেও তিনি ‘কিশোরী’। বর্তমান প্রজন্মের চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক ও লেখিকা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন ব্যক্তি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। নিজের জবানিতে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্মাণে অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের তাঁর জীবনকে তুলে ধরেছিলেন। TV9 বাংলা একান্তভাবে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে জানতে চাইল ‘সাবিত্রী কথা’।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী… নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন আপনি…
আমি কেবল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েই লিখেছি। আর একজনকে নিয়ে লেখার কথা ছিল। তিনি আগ্রহীও ছিলেন। কিন্তু আর এই দুনিয়ায় তিনি নেই: সৌমিত্রবাবু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)।
এই দুই ব্যক্তি—এঁদের নিয়েই কেন লিখতে চাইলেন?
তালিকায় কিন্তু মাধবীদিও (মাধবী মুখোপাধ্যায়) আছেন। তিনজনেই লেজেন্ড। বাংলার বিনোদন জগতে তাঁদের যা অবদান, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সুতরাং, সেই মানুষগুলোর কাজের জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন সাধারণ। মানুষ তাঁদের কথা জানতে চান। তাই মনে হয়েছিল জানানোটাও একটা কমিটমেন্ট। সাবুদিকে (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে তথ্যচিত্রও তৈরি করেছি। মনে হয়েছে বারবার, আমিও তো এই ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করি। সেই ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় একটা অসাধারণ জীবন কাটিয়ে চলেছেন। সেই জীবনকে ধরা সিনেমার চেয়েও অনেক বড় প্রেক্ষাপট। বিশ্বাস করো, না ধরে পারিনি।
কাজটা কীভাবে করলেন?
আমার সঙ্গে বহুদিনের কাজের সম্পর্ক সাবুদির। প্রায় ১৫-১৬ বছর তো বটেই। ওরকম নয় যে ইন্টারভিউ করে ওঁকে নিয়ে লিখেছি। ওঁকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি আর জেনেছি। অনেক কথা আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো শেয়ার করেছেন সাবুদি। সেটা মাধবীদিও করেন। হয়তো অনেক কথা লিখতে পেরেছি, অনেক কথা লিখতে পারব না। লিখব না বলেই হয়তো লিখতে পারব না। সেই কথোপকথন, দিনের পর দিনের সম্পর্ক, সেখান থেকেই লেখাটা হয়েছে। ওঁকে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতটা বলতে পারি। খুবই ক্যান্ডিড মানুষ সাবুদি। প্রায় ৯০ শতাংশই বলতে দিয়েছেন আমাকে। ১০ শতাংশ বলতে দেননি, সেটা জানা, না-জানায় দর্শকের কিছু এসে যাবে না। সেই কারণেই ওটা বাদ রেখেছি।
সব কথা সত্যিই লেখা যায় না…
আসলে সবটা লেখার প্রয়োজনও নেই। কিছু কথা বিশ্বাস করে বলেছেন। সেটা তো আমি পাবলিকের জন্য তুলে ধরতে পারি না। কিন্তু ওঁর জীবন খোলা বইয়ের মতো।
সম্প্রতি আপনার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘ধূলোকণা’-য় কাজ করছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়… ওঁর অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবে আপনি কীভাবে শিল্পী সাবিত্রীকে দেখেছেন?
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বিকল্প কেবল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আর কোনও বিকল্প নেই। ওঁর অভিনয় সম্পর্কে বলা আমার ক্ষেত্রে স্পর্ধা। কিন্তু যেহেতু আমিও ছবি পরিচালনা করেছি, আমার সেই ছবিতে তিনি পাঠ করেছেন, সেখানেও কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এত অপূর্ব ডায়লগ ডেলিভারি! কখনও মনেই হয়নি উনি অভিনয় করছেন। সময়ের জ্ঞান মারাত্মক, কখন চোখের জল পড়বে, চোখের জল ধরার মুহূর্ত… হাঁ করে চেয়ে থাকতে হয়। স্টিরিও-কমেডির ধারা তৈরি করেছিলেন এই সাবুদি, সেটার বিকল্প কোথায়?
চিত্রনাট্য হাতে পেয়ে প্রথমে কী করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়?
ছবি ও সিরিয়ালে কাজ আলাদাভাবে হয়। ছবিতে যেহেতু আগে থেকেই চরিত্র বোঝানো থাকে, গল্প বলা থাকে… ছবির দৃশ্য পড়িয়ে দিতে হয়। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন, ‘দ্যাখো তো হচ্ছে কি না!’ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আমি এখানে যদি সংলাপটা এইভাবে বলি!’ অভিনয়টা করতে পারছেন কিনা জানতে চান।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় জানতে চান?
ভাবো একবার। শুধু তাই নয়। কিশোরীদের মতো জানতে চান, ‘আমার কি হচ্ছে?’ আমারও অবাক লাগে। এত বছরের অভিজ্ঞতার পর এই প্রশ্ন! এটাই বোধহয় ওঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। এটা কিন্তু সৌমিত্রবাবুও বলতেন। মাধবীদি এখনও বলেন। আমি এই তিনজনের মধ্যে যা দেখেছি, সত্যি খুব রেয়ার। প্রকৃত অর্থে নম্র, বিনয়ী শিল্পী। সাফল্যের এই স্তরে পৌঁছেও, আমাদের মতো অনুজদের সঙ্গে কাজ করার সময় নিজেকে যেভাবে সমর্পণ করেন, সেটার কোনও জবাব নেই।
নতুন বলে সেই পরিচালকের ভাবনার কোনও দাম নেই, সেই জায়গাই তৈরি করেন না বলুন…
সৌমিত্রবাবুও একই ভাবে বলতেন, ‘দেখো তো হচ্ছে কি না, পারছি কি না’। সাবুদিও এক্কেবারে সেরকমই। আমি মনে করি, এটা আমাদের মতো ছোটদের প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া কিছু নয়।
অতি আত্মবিশ্বাসের দোষে দুষ্ট পৃথিবীতে বিরল গুণের অধিকারী বলতে হবে, অত্যন্ত শিক্ষণীয়…
দেখো, ভাল হওয়ার তো কোনও শেষ থাকে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তাঁরা যেটা করেন, সেটা নিজের সংশোধনের জন্য বলছেন, তেমনটা নয়। এমনটা বলে ছোটদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেন গুরুজনরা।
কত বড় জায়গা এটা লীনাদি…
কত বড় মানুষ হলে এটা করা যায় এখনও পর্যন্ত, এই পালটে যাওয়া পৃথিবীতেও।
সাবিত্রী-সৌমিত্রর খুনসুটি নিশ্চয়ই দেখেছেন?
তা আর দেখিনি! জানো তো, সাবুদি খুবই মজার মানুষ। ভীষণ ঠাট্টা-তামাশা করেন। আমাদের সঙ্গেও করেন। মাধবীদির স্বভাব, তিনি কখনওই প্রকাশ্যে ঠাট্টা করেন না। ওয়ান টু ওয়ান মজা করেন। আর সৌমিত্রবাবু সেটা খুবই উপভোগ করতেন। ভীষণই বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ ছিলেন সৌমিত্রদা। একটা কথাই এত ‘উইট’ নিয়ে বলতেন, সকলে হেসে কুটিপাটি। সৌমিত্রবাবুর মধ্যেও কিন্তু কিশোরসুলভ সারল্য আমি লক্ষ্য করেছি।
আপনি কিন্তু খুব ভাগ্যবতী…
সত্যি আমি ভাগ্যবতী। আমার ছবি ‘সাঁঝবাতি’তেও কাজ করেছেন সৌমিত্রদা। ‘মাটি’তে সাবুদিকে পেয়েছি। মাধবীদির সঙ্গে আমার ছবি হয়নি, কিন্তু টেলিভিশনে অজস্র কাজ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা, তিনজন ব্যক্তি মানুষেরই ব্যক্তি সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁদের বন্ধুত্ব, সখ্যতা পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি, আশীর্বাদ পেয়েছি। এটা আমার জীবনের বিরাট বড় পাওয়া।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী ‘সত্যি সাবিত্রী’তে উত্তমকুমার সম্পর্কে খোলাখুলি অনেক কথা লিখেছেন, স্বীকার করেছেন প্রেমের কথাও…
তোমাকে বলি, এই প্রেম কিন্তু দু’পক্ষেরই ছিল। একতরফা ছিল না। উত্তমকুমারও সাবুদিকে ভালবাসতেন। বইতে বিস্তারিতভাবে সবটা লেখা আছে। আমার সেই লেখা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অনুমোদন করেছেন। ওখান থেকে সরাসরি তুমি কোট করতে পারো।
লীনা গঙ্গোপাধ্যায় নির্মিত বইয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জবানিতে উত্তমকুমার:
“উত্তমদা আর আমি দু’টো আলাদা শরীর, কিন্তু এক প্রাণ… তখন নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েও মনে হত কিছু দিতে পারিনি মানুষটাকে… তখন সত্যিই ভেবে দেখেনি কী সম্পর্কের পরিণতি… অথচ আমি জানতাম উত্তমদা বিবাহিত, ওঁর সন্তান আছে… সেখানে আমি ওঁদের দু’জনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছাড়া তো কিচ্ছু না… তবু মনে হত এই যে মানুষটাকে ভালবাসি, এতেই আমি তৃপ্ত। আর কিছু দরকার নেই আমার… তাই উত্তমদা যখন কোনও দুর্বল মুহূর্তে আমাকে জোর করতেন, ‘বুড়ু তুই কথা দে। তুই আমার কাছে আসবি।’ আমি চুপ করে থাকতাম…”
এবার ৮৫তম জন্মদিন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের…
আমি জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। আমার দফতরের কাজ ছিল। দার্জিলিং যাওয়ার কথা। ওখানেই থাকার কথা ছিল। কেবল সাবুদির জন্মদিন বলেই রবিবার ফিরে এসেছি। তা হলেই বুঝতে পারছ, উনি আমার কাছে ঠিক কতটা। তোমার সঙ্গে একটা মজার কথা শেয়ার করি..
কী?
দ্য গ্রেট সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় নিজে আমার বাড়িতে এসে আমাকে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছেন। এই বয়সে। এটাও কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়।
ফোন-মেসেজের পৃথিবীতে এটাও তো বিরল… আর কী বলেছেন এসে?
শুনলে তোমার মনখারাপ হবে। বলেছেন, ‘আমার তো বয়স হয়েছে, আর জন্মদিন করতে পারব কি পারব না, তা তো জানি না। তোমাকে কিন্তু আমার জন্মদিনে আসতেই হবে’।
তাই? এসব বলেছেন…
আমার তো চোখ ছলছল করে ওঠে। আমরা তো সবসময় চাই, উনি এরকম ভাবেই আমাদের মধ্যে থাকুন। আমি তো ওঁর কাছে অতি সামান্য মানুষ। আমার বাড়ি এসে বলার তো কোনও প্রয়োজন ছিল না। অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে নিমন্ত্রণ করলেও আমার কাছে একই দাম থাকত। কিন্তু এই বয়সে বাড়িতে এসে বলে গিয়েছেন। যে করেই হোক এই সম্মান আমাকে ফিরিয়ে দিতেই হবে। পৃথিবী উলটে গেলেও সাবুদির জন্মদিনে যাবই। আর-একটা সন্ধ্যা হবে সাবিত্রীময়!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘সত্যি সাবিত্রী’ (দেজ় পাবলিশিং)।
স্নেহা সেনগুপ্ত
গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ