জয়িতা চন্দ্র
টলিউডের বর্তমান ছবিটা ঠিক কেমন! স্বজনপোষণ-ই হোক বা আধিপত্য, নতুনদের জায়গা করে দেওয়ায় আজ কতটা সহজ এই ইন্ডাস্ট্রি? কোথায়ই বা থেকে যাচ্ছে গভীর ক্ষত? বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এ কোন যুগ—TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুম্বইনিবাসী বাঙালি অভিনেতা জয় সেনগুপ্ত।
রাজনীতি টলিউডের মজ্জায়-মজ্জায়
রাজনীতি সাধারণত দু’রকমের হয়। একজন শিল্পী সেই রাজ্যনীতির বিষয়ে সজাগ। এই বিষয়ে চর্চা করা, সজাগ থাকাটা কিন্তু আলাদা বিষয়। এটার মানে সমাজচেতনা। এটার অর্থ: আমাদের চারপাশে সমসাময়িককালে ঠিক কী ঘটছে, সে বিষয় খবরাখবর রাখা। কখনও-কখনও তুমি সাধারণের গলা হয়ে রাস্তায় নামছ—সেটাই হচ্ছে রাজনীতির চেতনা। আর রাজনীতির ক্ষমতার সঙ্গে বিবাহ করা, সেটা চেতনা নয়—সেটা সুবিধাবাদী, ক্ষমতাভোগী চিন্তা। যার মধ্যে চেতনা থাকবে, সে কখনওই ক্ষমতার কাছে যাবে না। আর যে ক্ষমতাভোগী হতে চায়, সে সোজা ক্ষমতার মাথায় গিয়ে বসে। এই পার্থক্যটা এখন প্রকট।
অতীতের টলিউড ও রাজনীতি
অতীতে যে রাজনীতি চোখে পড়ত, সেখানে সকলের রাজনীতির চেতনা বর্তমান। তাঁরা মিছিলে হাঁটতেন, তাঁরা ময়দানে গিয়ে প্রতিবাদ করতেন, পথনাটক করতেন, কিন্তু তাঁরা কি টিকিটের প্রত্যাশা করতেন? ভোটে দাঁড়িয়ে পড়তেন? না। তাঁরা কি প্রচারের মুখ হতেন? না। তাঁরা কি ক্ষমতার থেকে টাকা নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন? না। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা বিকাশ রায়—এরা কোন পাওয়ারে ছিলেন বলতে পারেন? বর্তমানে রাজনীতির রঙটা ভীষণ প্রকট। প্রযোজনার ক্ষেত্রেই হোক বা পরিচালনা, ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রেই হোক বা প্রতিভার ক্ষেত্রেই হোক—এটা খুব খারাপ।
‘নন্দন’ মানে এখন যোগ্য ছবি জায়গা পাবে না
‘নন্দন’ যে কারণে তৈরি হয়েছিল, সেই সংজ্ঞাটাই এখন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ‘নন্দন’ তৈরির পিছনে মূল কারণ, যে ছবি বড় প্রেক্ষাগৃহে জায়গা পাবে না, যে ছবি সেভাবে দর্শক টানতে পারবে না, যার কাছে কোনও সামর্থ নেই বাজারকে হাতে রাখার, সেই ছবিকে জায়গা করে দেওয়া। এ তো সাধারণের টাকায় রাজ্যের তৈরি একটি প্রেক্ষাগৃহ, যেখানে গিয়ে ছবি-বোদ্ধারা সস্তায় গিয়ে একটা ছবি দেখবেন, সেটাই ছিল পরিকল্পনা। এখন সেটাকে যদি বাণিজ্যিক ছবির ‘হাব’-এ পরিণত করা হয়, তাহলে মুশকিল। যে ছবি অনায়াসে দর্শক টানতে পারে, সেই ছবি কেন চলবে ‘নন্দন’-এ? যে ছবি পিছিয়ে পড়ছে, হল পাচ্ছে না, সেই ছবিকে জায়গা করে দেওয়ার কথা ছিল ‘নন্দন’-এর।
শিল্পীর রাজনীতি মানেই কম্প্রোমাইজ়, আপোস
যখন-যখন শিল্পীর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির মিলন হবে, তখন-তখনই আপস হবে। তখনই শিল্পের বহিঃপ্রকাশ মুক্ত হস্তে হবে না। অন্যের পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়াই নিয়ন্ত্রণ করবে শিল্পীর এক্সপ্রেশনকে। তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, সেখানেই তো আবারও সেই আপোস। এই পরিস্থিতিতে ভাল আর্ট তৈরি হতে পারে না—অসম্ভব। এক্ষেত্রে সুরক্ষিত বলয়ের মধ্যে কাজ হবে। যেমন ব্যোমকেশ, ফেলুদা, এগুলোকে বলে ‘সেফ’ কাজ। সকলেই পছন্দ করবে, আর কিছু কাজ হবে, যেগুলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা না-বলে, তালে-তাল মিলিয়ে চলবে। এখানেই ঘটছে পতন।
সপাটে গালে চড়-মারা ছবি কোথায়
বর্তমানের ছবি সমাজকে নাড়া দেয় না, প্রশ্ন তোলে না, মানুষকে ভাবতে শেখায় না, সাধারণ মানুষের কলার ধরে টানে না। ফিল্ম গণমাধ্যমের একটি বড় অঙ্গ, কোথায় হারাল তার ভূমিকা? ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির গালে একটা সপাটে চড় মারার মত ছবি কোথায়? হচ্ছে কি আর? ‘পদাতিক’ হচ্ছে কি? ‘জন-অরণ্য’ হচ্ছে কি? ‘পার’ হচ্ছে কি? ‘চোখ’ হচ্ছে কি? ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ হচ্ছে কি? ‘গরম ভাত’ হচ্ছে কি? ‘গণদেবতা’ হচ্ছে কি?
নতুন শিল্পী কোথায়? নতুন প্রজন্ম এখন ‘রিল’-এ ঢুকে গিয়েছে
একটি গ্রামের মেয়ে, একটি ছোট শহরে থাকা মেয়ে ও স্টারডার্মের স্বপ্ন দেখা একটি মেয়ে—তিনজনেই কিন্তু আজ ‘রিল’ বানাচ্ছে। মুহূর্তে হাজার-হাজার ভিউজ় দেখে তারা দিব্যি আছে। তারা যে নতুন কোনও বার্তা দিচ্ছে না, সৃষ্টি করছে না, এ বোধ তাদের নেই। তারা বোঝে লাইকস-ভিউজ়। তারা কি চিন্তিত যে বনফুল কেউ পড়ছে কি পড়ছে না? তারা কি কেউ ভাবছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে ছবি হচ্ছে কি হচ্ছে না? তারা বরুণ ধাওয়ান, আলিয়া ভাটকে নিয়ে সুখে আছে। তাঁদেরও পরিশ্রম আছে, কিন্তু তার কোনও সুফল নেই। সেলসম্যান আর ইনফ্লুয়েন্সরের মধ্যে ফারাক বুঝতে হবে।
ফাইট কিন্তু বর্তমান
লড়াই বর্তমান, সেটা লম্বা হতে পারে। যে বানানোর সে ঠিকই বানাবে। ভাল ছবি, তথ্যচিত্র যে বানানোর সে তার কাজ করেই যাবে। যে সবকিছু বিক্রি করেই হোক বা বন্দক রেখেই হোক। আমরাও প্রয়োজনে তাঁদের পাশে থাকি, পারিশ্রমিক কম নিয়ে থাকি, কষ্ট করে শুট করি, এ লড়াই তো অনন্তের।
এখন আমরা অনুকরণে ব্যস্ত, অরিজিনালিটি কোথায়?
আগে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম করপরেশন ছিল, যেখানে ভাল ছবিকে সাহায্য করা হত, বছরে অন্তত দু’টো। এখন সেসব নেই। আর তার প্রয়োজনও নেই কারণ এখন মাথারা ঢুকে বসে আছে অন্দরমহলে। তাঁদের এখন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আগে ছবি হয়তো কম হত, তবে বাঙালি হিসেবে গর্ব হত যে, আমি বাঙালি, বাংলা ছবির জগতের সঙ্গে যুক্ত। ৬০ থেকে ৮০-র দশক—এক কথায় স্বর্ণযুগ—হিন্দি তখন বাংলার অনুকরণে ব্যস্ত, আর এখন আমরা অন্যের অনুকরণে ব্যস্ত। ‘অরিজিন্য়ালিটি’ কোথায়? উত্তম কুমার তো আর অমিতাভ বচ্চন ছিলেন না, উত্তমবাবু উত্তমবাবুই ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো আর রাজেশ খান্না ছিলেন না, সৌমিত্রবাবুই ছিলেন। সুপ্রিয়াদেবী তো আর মীনাকুমারী ছিলেন না, তিনি তো তিনিই ছিলেন। সকলের নিজস্বতা বজায় ছিল। তাই উত্তমবাবুকে বলতে হয়নি: ‘‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান।’’
কেন বলতে হচ্ছে ‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’
অনেক সুন্দর গল্পকে ছোট স্কেলে ফেলা যায়, সুন্দর করে গল্পকে ফুটিয়ে তোলা যায়। ফলে বাজেটটাই সবকিছু নয়। অনেক বিগ বাজেট ছবি রয়েছে, যেখানে হয়তো বলার মতো কোনও গল্পই নেই। ছবির ভীত বাজেট নয়—ছবির ভীত আর্ট, দর্শন। সেটার যখন অভাব ঘটে, তখন আমি এক অর্থহীন ছবি বানাব। সেই ছবি আশা করব ভাল চলবে। যখন ছবিটা চলবে না, তখন আমি বলব ‘বাংলা ছবির কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছে না’। কিন্তু কেন দাঁড়াচ্ছে না, সেটা কে ভাবছে? দর্শক যে বার বার অতীতে ঠকেছে… তুমি-আমি-আমরা ঠকিয়েছি। সে পরিশ্রমের টাকা খরচ করে এসে মনের মতো ছবি পাচ্ছে না, তাই-ই যাচ্ছে না। হয়তো পরের ছবিটা সত্যিই ভাল, কিন্তু ততদিনে দর্শকের মনে একটি ভুল ধারনা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এটার পিছনে থাকা কারণটা হল: আমরা সস্তা জিনিস বেচার চেষ্টা করছি, টানটান ট্রেলার, মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউজ়ের গান, দর্শকের মনে ঝড় তুলে, তাঁদের প্রেক্ষাগৃহে টেনে এনে একটা ভাল গল্প উপহার দিতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হচ্ছি। ছবির অভিব্যক্তিটাই তো পাল্টে গিয়েছে। আবার দর্শকদের দিকে তাকাই… তখন উল্টো ছবিটা বর্তমান। বারে বারে নিম্নমানের কাজ দেখে দর্শকের স্বাদও সেরকমটাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে হঠাৎ কোনও ভাল ছবি আসলে তাঁদের আর ভাল লাগছে না, কারণ তাঁরা তো উচ্চমানের কাজ দেখে অভ্যস্ত নন। তাঁরা তো সেই স্বাদটাই পাননি কখনও। ফলে বলতে হচ্ছে ‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’। আমিও বলছি।