স্বপ্ন ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। তবে বোর্ড পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় পরিচালক প্রভাত রায়ের হাত ধরে। মেলে টলিপাড়ায় অভিনয়ের সুযোগ। সাল ১৯৯৬, ‘পূজা’ ছবি থেকে শুরু টোটা রায়চৌধুধীর অভিনয়জীবন। বাংলায় কখনও বছরে চারটে ছবি, কখনও আবার তিনটে, সংখ্যাটা কমতে থাকে ধীরে-ধীরে। না, অভিনয় থেকে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া নয়—বরং টলিগঞ্জের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া। নিজেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে অভিনয়ের স্বাদ নেওয়া (যদিও সংখ্যায় তা নেহাত বেশি নয়)। কোথাও গিয়ে আজও টলিপাড়ার ওপর জমে থাকা অভিমানেরা মাঝেমধ্যে ভিড় জমায়। আর একটু কি সুযোগ পাওয়া যেত না? না, অন্য কাউকে নয়, সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এ ‘ফেলুদা’র ভূমিকায় অভিনয় করে আলোচিত ও সমালোচিত অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী আজ দোষ দেন শুধুমাত্র নিজেকেই—সেকথা নির্দ্বিধায় জানালেনও TV9 বাংলাকে। আজ সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ।

TV9 বাংলা: কোথাও গিয়ে কী টলিউড আপনাকে ভুলে গিয়েছিল মাঝের কিছু বছর? মাঝবয়সী টোটা কোথায় ছিলেন?
টোটা রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, অবশ্যই। এটা আমারও মনে হয়। তবে কী জানো তো, সেখানে হয়তো আমারও কিছুটা দোষ থেকে গিয়েছিল। এক কথায় যেটাকে বলে মার্কেটিং—যা একজন শিল্পীর জীবনে বড় ভূমিকা পালন করে—যেটা একটা গুরুতপূর্ণ অঙ্গও বটে, সেটা হয়তো আমি সঠিকভাবে করে উঠতে পারিনি। নিজেকে আরও একটু প্রসারিত করতে হত। সবার কাছে গিয়ে কথা বলা, কাজের খোঁজ করায় কোথাও খামতি থেকে গিয়েছিল হয়তো। পরিচালকেরা যে আমাকে নিয়েও ভাবতে পারেন, তা হয়তো আমি বুঝিয়ে উঠতে পারিনি।
TV9 বাংলা: প্রথমদিকে তো সবটা ভালই চলছিল, হঠাৎ কেন ছন্দপতন?
টোটা রায়চৌধুরী : এই প্রশ্নটা করলে একটা কথা আমার মনে হয়, আমি প্রথমদিকে হয়তো কোনও বাছ-বিচার করিনি। অনেকগুলো ছবি করেছিলাম যেখানে খলনায়কের রোল ছিল আমার, সেটাই হয়তো আমার হিরো ইমেজটা অনেকটা নষ্ট করে দিয়েছিল। বা বলা যেতে পারে প্রযোজকদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছিল। এটাই হবে হয়তো। আমি জানো তো অন্য কাউকে আজ আর দোষ দিই না। দিনের শেষে নিজেকেই দোষারোপ করি। আর এটা ভেবেই সান্তনা পাই যে, ভাগ্যেই হয়তো ছিল না। বিধাতার লিখন কে খণ্ডাবে! ভাগ্যে যা থাকবে, তা-ই তো হবে। তবে হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত তো টিকে আছি। স্টার-সুপারস্টার কোনওদিন হতে পারিনি, আর পারবও না। কিন্তু নির্ভরযোগ্য অভিনেতা হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছি, এটাই যা সান্ত্বনার।
TV9 বাংলা: টলিউড আপনাকে নিয়ে ভাবা যখন বন্ধ করল, তখন বলিউড-দক্ষিণ আপনাকে আবিষ্কার করে ফেলল, বিষয়টা আপনাকে অবাক করে?
টোটা রায়চৌধুরী : সত্যি বলতে কি আমি সব সময় চেষ্টা করি পজ়িটিভ থাকার। সবার আগে নিজের দোষটা দেখি, প্রথমেই বললাম। অন্যের দিকে আঙুল তুলে কী হবে বলতে পারো! তার থেকে ভাল নিজের খামতিগুলোই খুঁজি। তবে মিথ্যে বলব না, আমারও মনে হয়েছিল যে কেন এটা হচ্ছে! তবে এমনটা তো হয়েই থাকে। কথায় বলে ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। একটাই কথা আমি বারে বারে বলব, মাঝে বেশ কিছুটা সময় গিয়েছিল, যখন আমার মনে হয়েছিল আরও একটু কাজ পেলে ভাল হত। পাইনি গো সেটা, হয়নি সেটা। বাইরে গিয়ে কাজ করার প্রসঙ্গে বলতে পারি, ওঁরা আমার কাজ দেখেই সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই হয়তো আমায় ডাকা। যার ফলে কাজও করছি এখন, এর বাইরে আর কি বলতে পারি আমি…
TV9 বাংলা: টলিউডের থেকে কতটা আলাদা বলিউড বা দক্ষিণের কাজের ধরণ?
টোটা রায়চৌধুরী: ওঁরা কাজটাকে এবং কর্মীকে খুব শ্রদ্ধা করে। মানে যাঁরা কাজটা কাজের মত করে করতে পারে, তাঁদের ওঁরা জায়গা করে দিয়ে থাকে। অন্তত আমি সেটা পরখ করেছি। পাশাপাশি ওদের ওখানে নিয়মানুবর্তিতা, সমায়ানুবর্তিতা বিষয়গুলো ভীষণ প্রকট। কাজের প্রতি একাগ্রতা প্রবল। এক কথায় প্রাণ ঢেলে যদি কেউ কাজ করতে পারে, তাঁদের এরা সহজেই খুঁজে বের করে। ভেবেই দেখো না, আমি তো প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরে বসে আছি। কিন্তু মুম্বই থেকে তো আমায় প্রায়ই ডাকছে। আমিই অনেক সময় কাজ ফিরিয়ে দিয়েছি, যে এই ধরনের কাজ করব না, বা এটা এখন করতে চাইছি না। আসলে এখন খুবই বাছাই করে কাজ করার পক্ষপাতী আমি। কাজেই মুম্বইয়ে যে ডাকলেই আমায় যেতে হবে, তেমনটাও নয় কিন্তু। আমার মনের মত চরিত্র পেলে যাব, নয়তো যাব না।

TV9 বাংলা: এখন তো আবার ফ্রেমে আপনার দাপট, বর্তমানে কাজ আপনাকে খুঁজছে না আপনি কাজ খুঁজছেন?
টোটা রায়চৌধুরী : এখন আর টাকার পিছনে ছুটি না। ওই পয়সার পিছনে ছুটে বেড়িয়ে যে কোনও চরিত্র করার পক্ষপাতী আমি এখন আর নই। সেই তাগিদ আমি আর অনুভব করি না। ২০২০-তে করোনার প্রথম ঢেউয়ের পরে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, নিজের মত করে বাঁচাটা খুব জরুরি। কবে যে জীবনের গাড়ি থেমে যাবে, তা কেউ জানে না। যে কাজ করে এখন আত্মতুষ্টি পাই, সেই কাজই করার চেষ্টা করছি এখন। যে চরিত্রটি করে আমি আমার উৎকর্ষতা দেখাতে পারব, সেটাই করি, সেটা মুম্বই হোক বা দক্ষিণ।
(”আমরা এখন খুব রাগী একটা সমাজে বাস করছি”… সাক্ষাৎকারের পরবর্তী অংশ শুক্রবার প্রকাশিত হবে)
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ