‘ঘৃণা না ঈর্ষা’! ‘কালো অভিনেত্রী’ নিয়ে এই ট্যাবু ভাঙবে কবে? উত্তর খুঁজলেন পার্নো-সৌরসেনীরা

Feb 04, 2021 | 7:03 PM

টেলিভিশন ধারাবাহিকে 'কালো' মানেই যেন কুচুটে। আর ফর্সা মানেই যেন 'সততার প্রতীক'। এই চিরাচরিত ট্র্যাডিশন ভাঙেন যাঁরা, তাঁরা 'ট্রেন্ড সেটার' না 'রেবেল'?

ঘৃণা না ঈর্ষা! কালো অভিনেত্রী নিয়ে এই ট্যাবু ভাঙবে কবে? উত্তর খুঁজলেন পার্নো-সৌরসেনীরা
গ্রাফিক- অভীক দেবনাথ।

Follow Us

টেলিভিশন ধারাবাহিকে ‘কালো’ মানেই যেন কুচুটে। আর ফর্সা মানেই যেন ‘সততার প্রতীক’। এই চিরাচরিত ট্র্যাডিশন ভাঙেন যাঁরা, তাঁরা ‘ট্রেন্ড সেটার’ না ‘রেবেল’? সম্প্রতি ‘দেশের মাটি’ ধারাবাহিকের মুখ্য় অভিনেত্রী শ্রুতি দাস ‘কালো’ হওয়ার ফলস্বরূপ ট্রোলড হন সোশ্য়াল মিডিয়ায়। ‘আলকাতরা’, ‘পেত্নী’… এই ধরনের অশ্লীল বিশেষণে নেটিজেনদের একাংশ বিদ্ধ করে শ্রুতিকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মানুষের মজ্জাগত রেসিজিমের ভূতে সজোরে আঘাত করেন যাঁরা, তাঁরা কতটা সফল? কেন একের পর এক জর্জ ফ্লয়েড, এরিক গার্নারের ঘটনার পরেও বিপাশা বসুকে তাঁর সহকর্মী করিনা কাপুরের থেকে শুনতে হয় ‘কালি বিল্লি’? আর কেনই বা টলিউডে লীনা গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক ধারাবাহিকে ‘কালো মেয়ে’ শ্রুতিকে কাস্ট করলে শ্রুতির বিচার হয় রঙের নিরিখে? এইসব ‘কেন’র উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল TV9 বাংলা।

রিমা মুখোপাধ্যায়, পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। জানালেন, শুধু মেয়েরাই নন, রঙ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় ছেলেদেরও। চিকিৎসক জীবনে এমন নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাঁরও। সে রকমই একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে রিমা বলেন, “একটি ছেলে কিছু দিন আগে আমার চেম্বারে আসে। ছেলেটির রঙ কালো বলে তাকে স্কুলে বিভিন্ন নামে খ্যাপানো হত। বাড়িতে তাকে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো, ‘তুমি ছেলে। ছেলেদের রঙ নিয়ে এত চিন্তা করে কী হবে?’ অর্থাৎ, রঙ নিয়ে যে তাকে ছোট করা হচ্ছে এবং সেটা যে ঠিক নয়, সেটা কিন্তু বাড়ির লোকেরা বলতেন না।”

রিমার সংযোজন, “ছেলেটিকে বোঝানো হচ্ছে না যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাউকেই তাঁর শরীরের কোনও অংশ নিয়ে ‘শেমিং’ আসলে অপরাধ। ছেলেটি শিখছে পুরুষ কালো হলে পার পাওয়া যায়। মেয়ে কালো হলেই সমস্যা।”

ইন্ডাস্ট্রিতে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে প্রমাণ করেছেন অভিনেত্রী । শ্রুতির ঘটনা শুনে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ পার্নো। স্মৃতি উস্কে দিল নিজের জীবনেও ঘটে যাওয়া এমনই কিছু ঘটনা। ইন্ডাস্ট্রির ফুটফুটে নায়িকার তালিকায় পার্নো নেই। তাঁর কথায়, “মুখে দাগ হয়েছে বলে আমার পেজ-এ গিয়েও দেখবেন একগাদা কমেন্ট। শ্রুতির ট্যালেন্ট আছে, ওর শো হিট। ব্যাস। সেটাই যথেষ্ট।  সোশ্যাল মিডিয়ার যেমন ভাল দিক আছে তেমন খারাপ দিকও রয়েছে। এইগুলিই খারাপ দিক।  ” শ্রুতির উদ্দেশে পার্নোর বার্তা, “যে মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোমায় নিয়ে ট্রোল হবে, সে মুহূর্তে বুঝবে তুমি হিট। অনেকে অনেক রকম খারাপ কথা বলবে। সে সবে কান দিও না।”

অন্যদিকে শ্রুতি বলছেন, “যতই বলি একদিন সব বদলে যাবে, পাল্টে যাবে সব কিছু। মনে হয় না জানেন। মুখেই বলি শিক্ষিত সমাজে বাস করি আমরা… কোথাও না কোথাও গিয়ে সবাই পিছিয়ে… জানি না, বাংলার বাইরে কী হয়…যেখানে এই রেসিজিম নেই, যেখানে মানুষ বিচে গিয়ে ইচ্ছাকৃত ট্যান্ড হয়…সেখানে চলে যেতে চাই খুব তাড়াতাড়ি, এ দেশে বা হয়তো বিদেশেই…।”

তবে সমস্যাটা শুধু যে ‘দেশীয়’ তা নয়। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ২০০৭-এ ‘বিগ ব্রাদার’-এ অংশ নিয়েছিলেন অভিনেত্রী শিল্পা শেট্টি। সেখানেও সহ-প্রতিযোগীদের উপর বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ এনেছিলেন শিল্পা। তাঁর ইংরাজি বলার ধরন থেকে শুরু করে তাঁর রান্না, গায়ের রঙ… সবই ছিল অন্য়দের হাসির খোরাক।

সেলেব বলে যে তিনি ছাড় পেয়েছেন, তা নয়। কিংবা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। যুক্তরাষ্ট্রে ছোটবেলা কাটানো প্রিয়াঙ্কাকে স্বদেশে ফিরতে হয়েছিল বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েই। হাইস্কুলে তাঁকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রাউন’ বলে। নিজের নাম, পরিচয়ের আগেও জ্বলজ্বল করত তাঁর গায়ের রঙ।

কিন্তু যে দেশে বেশিরভাগ মানুষের গায়ের রঙই কালো, সে দেশে মেনস্ট্রিম ধারাবাহিকে কালো মেয়েকে মেনে নিতে আজও ট্যাবু কেন? জি বাংলায় অপর একটি ধারাবাহিকের নায়িকাকেও সিরিয়ালের স্বার্থে কালো দেখানো হয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে সে ফর্সা। ধারাবাহিকে তাঁর রঙ নিয়ে আজ পর্যন্ত ট্রোলিং হয়নি। রিল-নায়িকার চরিত্রের স্বার্থে ডার্ক শেড মেক-আপ করে কালো হলে মানতে অসুবিধে নেই। অথচ সে রিয়েল লাইফে কালো হলেই ‘সমস্যা’। রিমা মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই মনস্তত্ত্বের পিছনে কাজ করে এক অবদমিত ঈর্ষা। যার শিকড় প্রোথিত অনেক দূরে।

রিমার কথায়, “যে বা যারা ট্রোল করছেন, তাঁরা যে ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ ফর্সা এমনটা কিন্তু না-ও হতে পারে। যারা ব্যক্তিগত জীবনে ফর্সা, তাঁদের মধ্যে কাজ করছে ঘৃণা আর যারা চাপা রঙের হয়েও ট্রোল চালিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে কাজ করছে এক চাপা ঈর্ষা।” সেটা কীরকম? রিমা বললেন, “গায়ের রঙ নিয়ে জীবনের কোনও না কোনও সময়ে তাঁরাও শুনে এসেছেন নানা কুকথা। ফলত তাঁদের কোথাও না কোথাও গিয়ে মনে হয় আমি কালো বলে সারাজীবন এত অপদস্থ হয়ে এসেছি অথচ ওই মেয়েটি কী করে কালো হয়েও এত প্রচার, এত জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল?” রিমা মনে করেন, এর জন্য দায়ী সমাজব্যবস্থা, ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে সুচারুভাবে ‘ফেয়ার’ শব্দের পরিবর্তে ‘হোয়াইটনিং’ শব্দ ব্যবহারের কৌশল।


শুধু যে সংবাদমাধ্যমের পাত্র-পাত্রীর পাতায় ‘ফর্সা-সুন্দরী পাত্রীর’ খোঁজ চলছে এমনটা ভাবা কিন্তু ভুল। সিনে ইন্ডাস্ট্রির ভেতরেও এখনও খোঁজ চলে টুকটুকে ‘লক্ষ্মী মুখ’-এর। না হলেই দাগিয়ে দেওয়া হবে ‘আর্ট ফিল্ম মেটেরিয়াল’, বলছেন অভিনেত্রীরাই… যে ছবিতে চটক নেই, গ্ল্যামারের ঝলকানি নেই, হাতিয়ার শুধুই কনটেন্ট। এই কনটেন্টধর্মী ছবির পরিচিত মুখ সৌরসেনী মৈত্র। দুধে-আলতার লিস্টে নিজেকে ফেলতে চান না তিনি। তাঁর কথায়, “মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়ালে কাস্ট করা হয়নি আমাকে। বলা হয়েছে আমি কনভেনশানালি প্রিটি নই। বলা হয়েছে, ‘তোমায় দিয়ে একটু অন্য ধরনের ছবি করাই’। কিন্তু কারও অধিকার নেই রঙের নিরিখে কাউকে বিচার করার। একটা সহজ উত্তর। করতে এসেছে কী? অভিনয়। কেন তাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছে? কারণ সে অভিনয়টা পারে। ব্যস, সেটাই যথেষ্ট। চিরকাল মুভিতে দেখেছি ফর্সা মেয়েটা ভাল, কালো মেয়েটা খারাপ। আরে আমাদের আপনার পর্দার ওপারে দেখেন বলে এমন নয় যে আমাদের অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খারাপ আমাদেরও লাগে।”।

নিউ এজ অভিনেত্রী অনুষা বিশ্বনাথনের কথায়, “আমি খুব তাড়াতাড়ি ট্যান হয়ে যাই। একটা সময় ছিল, মনে হতো, রোদে বেরবো না। যদি ট্যান হয়ে যাই। এখন সত্যি কথা বলতে আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। বিশ্বাস করুন, আই লাভ মাই কমপ্লেকশন। আর একটা জিনিস বুঝে গিয়েছি সোশ্যাল মিডিয়ার এই সব বুলিগুলোকে সহ্য করতে হলে গণ্ডারের চামড়া করে নিতে হবে।” বডিশেমিংয়ের বিশবাষ্প এই বয়সে দমবন্ধ করেছে তাঁরও। তবে এখানে রঙ নয়, তাঁর ওজন নিয়ে উঠে এসেছে নানা টিপ্পনি। অনুষা মোটা নন, তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘বড্ড রোগা’, ‘উড়ে যাবে’ ইত্যাদি।

এ তো গেল সিরিয়াল-সিনেমার কথা। অ্যাড ফিল্মের ক্ষেত্রেও কি চিত্রটা এক? কালো হলে কনফিডেন্স কমে যায়, ক্রিম মেখে ফর্সা হলেই জামা-কাপড়ের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে চেহারারও চকচকে ভাবে… দেখেননি এমনটা? একবিংশ শতকে কি এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি তাতে? অ্যাডমেকার অরিন্দম নন্দী যদিও বলছেন, “এ ভাবে সাদা-কালো হিসেবে তো দেখিনি কখনও। তবে হ্যাঁ, রঙ নিয়ে এই ট্যাবু তো অস্বীকার করা যায় না। এর জন্য আমরাই দায়ী। আমরা বলতে বিজ্ঞাপন এবং ফিল্ম। সাদা-কালো ছবিও যখন হয়েছে, তখনও কিন্তু এক ব্যাপার ছিল। সাদা ভালো, কালো খারাপ। ঠিক যেমন মহিষাসুরের রঙ সবুজ-কালো, মা দুর্গার মুখ হলুদ-সাদা।” অরিন্দম আরও যোগ করেছেন, “এই যে রঙ নিয়ে এত চর্চা, এ তো একদিনের নয়। রামায়ণ-মহাভারতের যুগের থেকেই। আর সে কারণেই অসুর সম্প্রদায় তথা রাবণ মানেই কালো।” নিজের বিজ্ঞাপনে কাস্ট করার সময় কালো মুখ বেছে নেবেন তিনি? “বেশ কয়েক বছর আগে এক বিজ্ঞাপনে আমার অ্যাডের মুখ ছিল পাওলি (দাম)। পাওলি তখনও কিন্তু আজকের পাওলি হয়নি। শি ওয়াজ জাস্ট আ মডেল। পাওলিকে কাস্ট করা নিয়ে কিন্তু কোনও অসুবিধেই হয়নি,” উত্তর অরিন্দমের।

রক্তে মিশে যাওয়া চিন্তা-ভাবনার আমুল পরিবর্তন না ঘটলেও বেশ কিছু বিপণন কোম্পানি ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবছেন হালফিলে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। শহরের এক গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা কিন্তু তাঁদের মুখ হিসেবে বেছে নিয়েছে ইন্ডাস্ট্রির আরও এক কালো মেয়ে তুহিনা দাসকে। শহরের সাইনবোর্ডে, ব্যানারে সোনার গয়নার থেকেও ছাপিয়ে যায় কোঁকড়া চুল আর কাজল টানা চোখের তুহিনার সৌন্দর্য। ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী তাঁর ব্রাইডাল সিরিজের জন্য বেছে নেন ‘কৃষ্ণকলি’দের।

সেলিব্রিটি মেক-আপ আর্টিস্ট অনিরুদ্ধ চাকলাদারের অকপট স্বীকারোক্তি, “আমি নিজে ডাস্কি কমেপ্লেকশন ভীষণভাবে পছন্দ করি। অনেকসময় এমনও হয়েছে কোনও ব্রাইডের ক্ষেত্রে অথবা কোনও মডেলের ক্ষেত্রে তাঁর যা রঙ, তার চেয়ে একটু চেপে যেন মেক-আপ করেছি। আমার কেন যেন মনে হয়, আমাদের ভারতীয় মুখে বাঁ শরীরের গঠনে একটু চাপা রঙ ভাল লাগে, বিশেষত বাঙালিদের। আমার মনে হয় না আজকের দিনে এস্থেটিক দিক দিয়ে বিচার করলে রঙ একটা বিষয় হতে পারে।

” ‘মানাবে না’– এই কারণে আজও অ্যাড শুটে বাদ পড়েন কালো মেয়েরা? আবারও সোজা-সাপ্টা উত্তর তাঁর, “ধরুন, আমি একটা পোশাকের ব্র্য়ান্ডের জন্য় শুটিং করছি। হতেই পারে জামা-কাপড়ের এমন কিছু রঙ বেছে নেওয়া হল যা হয়তো ডাস্কি রঙের উপর ভাল লাগবে না। উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে সাদা-কালো কোনও রঙকে অসম্মান করা হচ্ছে।”

অনিরুদ্ধ বললেন ঠিকই। তবু কোথাও গিয়ে এক পংক্তিতে হয়তো বসানো যায় না হালফিলের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি। ‘ঈর্ষা নাকি ঘৃণা’… বারবারই ট্যাবু ভাঙার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কী? প্রশ্ন একটাই, ‘তা সে যতই কালো হোক’, কিংবা ‘কালো কিন্তু মুখটা মিষ্টি’– এই বাক্য নয়, ‘কালো এবং মিষ্টি’ বলতে পারা যাবে কবে?

গ্রাফিক এবং অলংকরণ- অভীক দেবনাথ।

Next Article