ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ভারতের পরিস্থিতিও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে দৈনিক সংক্রমণ।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৩৭২ জন। প্রাণ হারিয়েছেন ১০২৭ জন। রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৮১৭। মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। দেশে সক্রিয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ১ লক্ষ ১ হাজার ৬। রাজ্যে সক্রিয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৫১৯।
(উপরোক্ত তথ্যগুলির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটিই এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত)
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ঠিক কী-কী করণীয়, সত্যিই পরিস্থিতি কতটা আতঙ্কের? নতুন রূপে কতটা ভয়াবহ করোনাভাইরাস? এ সব নিয়েই TV9 বাংলা কথা বলেছে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডক্টর শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়– এর সঙ্গে। কী বলছেন শ্যামাশিসবাবু…
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও করোনা হচ্ছে, প্রথম ডোজ় নেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, এটা কেন?
শ্যামাশিস: যে দু’টো ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, তার প্রতিষেধক ক্ষমতা ৭০ শতাংশ। আর ভ্যাকসিন যে সংক্রমণ আটকে দেবে বা রুখে দেবে, তা কিন্তু নয়। সংক্রমণ কমাবে, ব্যাপারটা মারণরোগে যাবে না, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে, উপসর্গ দেখা দিলেও তা সামান্য থাকবে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ ভ্যাকসিন নিলে ভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব থেকে আপনি বাঁচতে পারবেন।
নতুন স্ট্রেনে কি নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে?
শ্যামাশিস: উপসর্গের সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। তবে গতবারের তুলনায় এবার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। স্বভাবতই তাঁরা বেশি বাইরে বেরোন, সেটা একটা কারণ। বাচ্চাদের মধ্যেও সংক্রমণের হার বাড়ছে। এটা খুব একটা অ্যালার্মিং নয়। তবে আগের বার যেমন বলা হচ্ছিল যে, বাচ্চাদের হচ্ছে না, এবার কিন্তু সেটা বলা যাবে না। এ ছাড়াও যেহেতু তরুণ প্রজন্ম এখনও ভ্যাকসিন পাননি, তাই তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
ভ্যাকসিন নেওয়া কতটা প্রয়োজন? আপনি কী বার্তা দেবেন?
শ্যামাশিস: প্রথমেই বলি ভ্যাকসিন নেওয়া মানে মাস্ক না-পরা, স্যানিটাজ়ার ব্যবহার না-করা বা সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় না-রাখা… এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। ভ্যাকসিন থাকায় একটাই সুবিধা যে, ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ রুখে দেওয়ার একটা অস্ত্র রয়েছে আমাদের হাতে। সরকারি নিয়মে যাঁরা ভ্যাকসিন পাবেন, তাঁরা ভ্যাকসিন নিন। তবে যদি আপনার ডাক্তারবাবু আপনাকে ভ্যাকসিন নিতে বারণ করেন, তাহলে বুঝবেন নিশ্চিত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সে জন্যই আপনাকে ভ্যাকসিন নিতে বারণ করা হয়েছে। পরিশেষে বলব হোয়াটসঅ্যাপ বা গুগল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় না-থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শীতে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে, আমাদের দেশে গরমে বাড়ছে, এই বিষয়ে কী বলবেন?
শ্যামাশিস: ব্যাপারটা ঠাণ্ডা বা গরমের সঙ্গে যুক্ত নয়। সংক্রমণ খানিকটা কমে যাওয়ার পরই মানুষের মধ্যে কিছুটা গাফিলতি দেখা গিয়েছিল। মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরনো, সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে অংশ নেওয়া… এইসব। ফলে আবার বেড়েছে সংক্রমণ।
ভাইরাস কি এখন চরিত্র বদল করছে?
শ্যামাশিস: আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন নতুন ঘটনা নয়। সব মিউটেশনেই যে ভাইরাসের চরিত্র বদলে যায়, তেমনটা নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। ভারতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ভাইরাসের বিভিন্ন মিউটেশন পাওয়া গিয়েছে। তা নিয়ে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি নিয়মিত গবেষণা চালাচ্ছে। তবে নতুন স্ট্রেন বা মিউটেশনে নভেল করোনাভাইরাসের চরিত্র আমূল বদলে গিয়েছে, এমনটা নয়।
এখন কী-কী উপসর্গ দেখা দিলে টেস্ট করাতে হবে?
শ্যামাশিস: আপনার জ্বর বা সর্দি-কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট হলে আগে নিজেকে আইসোলেট করুন। বাড়িতেই আইসোলেশনে থাকুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অতি অবশ্যই টেস্ট করান। পজ়িটিভ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন। এর মধ্যে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল, ব্লাড সুগার এবং প্রেশার নিয়মিত মাপতে হবে। ধুম জ্বর, তীব্র শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া… এ জাতীয় অ্যালার্মিং লক্ষণ দেখলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সঠিক ভাবে মনিটরিং হওয়াটা খুব প্রয়োজন।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কী-কী সতর্কতা নেবেন মা-বাবারা?
শ্যামাশিস: বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোভিড হলে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আগের বার দেখা গিয়েছিল করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার সময়, অর্থাৎ রিপোর্ট নেগেটিভ আসার সাত-আটদিন পরে বাচ্চারা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। আগের বারের তুলনায় এ বার বাচ্চাদের মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে। অতএব কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে সোজা ডাক্তারের কাছে যান।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে ডাক্তারবাবুরাও আগাম সতর্কতা দিয়েছিলেন, পরিস্থিতি এখন নিঃসন্দেহে কঠিন। কিন্তু সেই সঙ্গে অকারণ আতঙ্কও বাড়ছে… সাধারণ মানুষের জন্য আপনি কী বার্তা দেবেন?
শ্যামাশিস: মাস্ক পরুন। বারবার হাত ধুয়ে নিন। স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। এটুকু করলেই করোনা হারতে বাধ্য। আমরা প্রথম ওয়েভকেও হারিয়েছিলাম। সেকেন্ড ওয়েভকেও হারাব। শুধু মানুষের থেকে এইটুকু সহযোগিতা কাম্য।
গ্র্যাফিক্স ও অলংকরণ: অভিজিৎ বিশ্বাস