ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (NFHS)-এর পঞ্চম রাউন্ডের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মহারাষ্ট্রে বেড়েছে কন্ডোমের ব্যবহার। রিপোর্ট অনুযায়ী, পরিবার পরিকল্পনায় (ফ্যামিলি প্ল্যানিং) ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করছেন মহারাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ। জন্ম নিয়ন্ত্রণের দিকেও নজর দিয়েছেন তাঁরা।
চার বছর আগে ২০১৫-২০১৬ সালে যখন এই সমীক্ষা হয়েছিল, তখন মহারাষ্ট্রে ৭.১ শতাংশ পুরুষ কন্ডোম ব্যবহার করতেন। বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কন্ডোম ব্যবহার করা পুরুষের সংখ্যা ১০.২ শতাংশ। অর্থাৎ গত চার-পাঁচ বছরে মহারাষ্ট্রে ৩.১ শতাংশ কন্ডোমের ব্যবহার বেড়েছে। রিপোর্ট বলছে, গ্রামীণ এলাকার তুলনায় শহুরে অঞ্চলে কন্ডোমের ব্যবহার বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে কমেছে কন্ট্রাসেপটিভ পিল এবং ফিমেল স্টেরিলাইজেশনের পরিমাণও।
সমীক্ষা অনুযায়ী, মুম্বইয়ে গত পাঁচ বছরে ১১.৭ শতাংশ থেকে কন্ডোমের ব্যবহার বেড়ে হয়েছে ১৮.১ শতাংশ। ১০ জন দম্পতির মধ্যে প্রায় সাতজন আজকাল পরিবার পরিকল্পনায় মন দিয়েছেন। তবে এই সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে যে, শহরাঞ্চলে কন্ট্রাসেপটিভ পিল নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। গ্রামীণ বা শহরতলি এলাকায় পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ভয়ে মহিলারা সেভাবে কন্ট্রাসেপটিভ পিল ব্য়বহার করেন না।
কন্ডোমের ব্যবহার বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। ২০১৫-২০১৬ সালের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ৫.৯ শতাংশ পুরুষ কন্ডোম ব্যবহার করতেন। চার বছর পরের সমীক্ষায় সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭ শতাংশ। NFHS-এর রিপোর্ট বলছে, শহরাঞ্চলে এখন কন্ডোমের ব্যবহার ১০.১ শতাংশ, আর গ্রামাঞ্চলে ৫.৬ শতাংশ। ২০১৯ সালের ২১ জুন থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ (আইআইএইচএমআর) এই সমীক্ষা করেছিল। মোট ১৮,১৮৭টি বাড়ি, ২১,৪০৮ জন মহিলা এবং ৩০২১ জন পুরুষের উপর এই সমীক্ষা করা হয়েছে।
কিন্তু একুশ শতকে দাঁড়িয়েও সভ্য সমাজ কন্ডোমের ব্যবহারে কতটা পিছিয়ে রয়েছে? পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দম্পতিদের মনোভাবই বা কী? জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাঁরা কতটা সচেতন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই TV9 বাংলার সঙ্গে আলোচনা করেছেন গায়নোকোলজিস্ট ডক্টর মিতালি মুখোপাধ্যায় এবং ডক্টর অমিত কুমার শীল।
প্রশ্ন- একুশ শতকে এসেও কন্ডোম ব্যবহারে কেন এত পিছিয়ে সমাজ?
মিতালি- যেহেতু মহিলারা গর্ভবতী হন এবং সন্তানের জন্ম দেন, তাই অধিকাংশ পুরুষ এখনও মনে করেন যে এই গোটা প্রক্রিয়াটাই মহিলাদের দায়িত্ব।
অমিত কুমার- আমরা পিছিয়ে কারণ সঠিকভাবে কাউন্সেলিং হয় না। মানুষের কাছে ঠিক বার্তা পৌঁছয় না। কন্ডোম ব্যবহারের পজিটিভ দিক, কখন কীভাবে ব্যবহার করব, এই তথ্যগুলো অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না। এর পাশাপাশি এখনও আমাদের সমাজ, বিশেষত নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবার পুরুষ নির্ভর। মহিলারা চাকরি করলেও তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় না। কখন সন্তান ধারণ করা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা অনেকাংশেই মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্রশ্ন- কন্ডোম ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে কী করা উচিত?
মিতালি- রেডিয়ো, সংবাদপত্র এবং সামগ্রিকভাবে মিডিয়া এদের আরও সক্রিয় হতে হবে। মানুষ যত বেশি রোজ শুনবে, দেখবে ততই সচেতনতা বাড়বে। পাশাপাশি অবশ্যই সরকারেরও উচিত আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া। এই যেমন এখন স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, এই ধরনের উদ্যোগ নিলে বোধহয় ভালই হবে। যেমন মেল স্টেরিলাইজেশন করলে সরকারের তরফে কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে বা এই জাতীয় উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি ডাক্তারদের আলাদা করে কাউন্সেলিং করা দরকার।
অমিত কুমার- কখন কীভাবে কন্ডোম ব্যবহার করতে হবে, এটা জানা ভীষণ জরুরি। নয়তো ফেলিওর রেট বেড়ে যাবে। ঠিকঠাক পদ্ধতি মেনে না চললে ফেলিওর রেট ২ থেকে ৩ গুণ বেড়ে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে (ফেলিওর রেট অর্থাৎ প্রক্রিয়া মেনে কন্ডোম না-ব্য়বহার করার ফলে যদি কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়েন)। এই ফেলিওর রেট বেড়ে গেলে কন্ডোম ব্য়বহারের গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরও তা ব্য়বহার না-করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইসব বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সেইসব স্বাস্থ্যকর্মীদের যাঁরা কন্ডোম দিচ্ছেন এবং অতি অবশ্যই ডাক্তারদের। তাই সঠিকভাবে কাউন্সেলিং এবং সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রেডিওর বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কারণ এফএম আজকাল সকলেই শুনে থাকেন। ফলে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হতে পারে রেডিয়ো।
প্রশ্ন- ফিমেল স্টেরিলাইজেশন কতটা সমস্যার?
মিতালি- দেখুন আমার কাছে একজন মহিলা এসে ফিমেল স্টেরিলাইজেশনের কথা বললে আমি সবসময় তাঁর পুরুষ সঙ্গীকে বলি অস্ত্রোপচার করাতে। কারণ সেই মহিলার যদি দুটো সি-সেকশন (সিজা়রিয়ান ডেলিভারি বা অস্ত্রোপচারের মাধ্য়মে সন্তান প্রসব) থাকে বা ধরুন দু’টো নরম্য়াল ডেলিভারিও হয়ে থাকে, তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর।
প্রশ্ন- একুশ শতকের সমাজেও ওষুধের দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কন্ডোম কিনতে গেলে ফিসফিসিয়ে বলতে হয়। এটা বদলানো সম্ভব?
মিতালি- এই সমস্যা তো রয়েইছে। অ্যান্টাসিড চাইলে সাধারণ প্যাকেটে দেওয়া হয়। আর স্যানিটারি ন্যাপকিন চাইলে প্রথমে কাগজে মুড়ে তারপর কালো পলিথিনে দেওয়া। কন্ডোমের ক্ষেত্রেও রাখঢাকের ব্যাপার আছে। এটা এক ধরনের মানসিকতা। বদল তো অবশ্যই প্রয়োজন। এক্ষেত্রেও বলব রেডিয়ো, টিভি, সংবাদপত্র যত বেশি প্রক্রিয়া হয়ে প্রতিদিন মানুষকে আরও বেশি করে এগুলো নিয়ে বিভিন্ন বার্তা দেবে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে তার ফলে সমাজেরই লাভ। ব্রেনওয়াশ হয়ে যাওয়া মানসিকতার বদল হবে।
অমিত কুমার- গত ২ থেকে ৩ বছরে, বিশেষত বেশকিছু সিনেমা হওয়ার পরে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে সোশ্যাল ট্যাবু কিন্তু অনেকটাই ভেঙেছে। তাই প্রচারটা প্রয়োজন। তবে সেটা যেন সফট পর্ন না-হয়ে যায়। বরং স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতোই কন্ডোমের ক্ষেত্রেও হাইজিন এবং উপকারিতা মাথায় রেখে প্রচার প্রয়োজন। সেটা টেলিভিশনের পাশাপাশি রেডিয়োতেও হওয়া দরকার। প্রচার ঠিকঠাক হলে সোশ্যাল ট্যাবু দূর হবে। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু হবে।
প্রশ্ন- এরকম দম্পতি কি আপনার কাছে আসে যে তাঁরা কন্ডোম ব্যবহার করতে চায় না?
মিতালি- হ্যাঁ এরকম কেস তো আছেই। নারী-পুরুষ দু’তরফেই এটা বলতে শুনেছি যে কন্ডোম পরে সেক্স করা ‘নট প্লেজারেবল’। এক্ষেত্রে আরও দু’টো বিষয় আছে। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা কন্ট্রাসেপটিভ পিল-এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। মানে সঠিক তথ্য জানেন। আর অনেকে আছেন, যাঁরা ঠিকঠাক তথ্য জানেন না। যাঁরা এই পিলের ব্যাপারে সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল নন, মানে যাঁরা ভাবেন যে এই ধরনের পিল খেলে সাময়িক ভাবে স্টেরিলাইজেশন হয়ে যাবে বা পুরোপুরি স্টেরিলাইজেশন পর্যায় এসে যাবে, তাঁদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।
অমিত কুমার- অনেক কাপল এসে বলেন যে, তাঁরা কন্ডোম ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না। ফিমেল পার্টনার অনেকসময় বলেন যে, তাঁর পুরুষ সঙ্গী কন্ডোম ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ নন। তবে পুরুষ এসে বলছেন তাঁর মহিলা সঙ্গী কন্ডোম ব্যবহার করতে চান না, এমনটা কমই হয়।
সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে স্থগিতাদেশ আনবে বলে শোনা গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে কী বলবেন?
মিতালি- নিষিদ্ধ হওয়া কখনই উচিত নয়। মানুষ যত দেখবে, তত সচেতন হবে। তবে হ্যাঁ বিজ্ঞাপন কী ধরণের হচ্ছে সে দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। কারণ ভালগার বিজ্ঞাপন ছাড়াও কিন্তু সমাজকে বার্তা দেওয়া সম্ভব।
অমিত কুমার- যে ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, সেটা যৌনতায় সুড়সুড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আমার ব্যক্তিগত মত। সেখানে কন্ডোম কীভাবে, কখন ব্যবহার করব, এর কতটা যৌক্তিকতা আছে, সেসব নিয়ে কতটা তথ্য দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ওটা সফট পর্নের মতো, দেখতে ভাল লাগে বলে অনেকে দেখেন।
যদি সত্যিই জনতার স্বার্থে বিজ্ঞাপন তৈরি করতে হয় তাহলে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার।
১। কন্ট্রাসেপটিভ ইজি টু ইউজ অর্থাৎ সহজে ব্যবহার করা যায়।
২। কার্যকরী হবে, অর্থাৎ ফেলিওর রেট কম থাকবে।
৩। দাম কম হবে।
৪। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম থাকবে।
৫। এছাড়াও বেশ কিছু সুবিধা থাকতে পারে। যেমন অনেকে বলেন কন্ডোম সেক্সের প্লেজার নষ্ট করে দেয়। অথচ আজকাল এমন অনেক প্রোডাক্ট আছে যেগুলো বরং প্লেজার এনহ্যান্স করে অর্থাৎ বাড়িয়ে দেয়।
এইসব তথ্য মাথায় রেখে এর ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন তৈরি করলে বোধহয় সেটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে অনেক বেশি লাভজনক হবে।
অলঙ্করণ- অভীক দেবনাথ