‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব‘। বাঙালির রক্ত ফুটে উঠেছিল এই ডাকে। শুধু বাঙালিরই নয়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (Netaji Subhash Bose) ছিলেন গোটা দেশের গর্ব। মহাত্মা গান্ধীকে জাতির জনক বলা হলেও, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতাজির ভূমিকা বা অবদান কতটা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে ওঠার কাহিনি কম-বেশি সকলের জানা। তবে যে বিষয়টি ঘিরে আজও রহস্য রয়ে গিয়েছে, তা হল নেতাজির অন্তর্ধান। সত্যিই কি নেতাজি তাইপেইয়ের বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন নাকি তিনি গুমনামী বাবা হিসাবে ফিরে এসেছিলেন, নেতাজির জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই তত্ত্বগুলিই।
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশার কটকে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। স্কুলশিক্ষা কটকেই, এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে যান সিভিল সার্ভিসের পড়াশোনা করতে। ১৯২০ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করলেও, ব্রিটিশদের সেই চাকরি হেলায় ছেড়ে দেন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য। সেই সময় বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যে শুধুমাত্র চাকরি করা জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। মাতৃভূমির প্রতি তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে।
এরপরে কংগ্রেসে যোগ, গান্ধীজির সঙ্গে দূরত্ব, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন- এই ঘটনাক্রম সকলের জানা। ভারত যখন স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়তে উদ্যত নেতাজি। এদিকে, তার উপরে কড়া নজর রাখছে ব্রিটিশরা। কিন্তু তাদের চোখে ধুলো দিয়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বিহার, পেশওয়ার, আফগানিস্তান, রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) হয়ে পৌঁছন জার্মানিতে। সেখান থেকে সাবমেরিনে চেপে তিনি জাপানে যান। ওখানেই আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নেন এবং আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেন। ১১টি দেশ নেতাজির তৈরি এই সরকারকে স্বীকৃতিও দেয়।
নেতাজির সেনা আরাকান, ইম্ফল জয় করে কোহিমা পর্যন্ত পৌঁছয়। এদিকে সেই সময়ই আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে। জাপান আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। নেতাজি সিদ্ধান্ত নেন সিঙ্গাপুরে ফিরে যাওয়ার। সিঙ্গাপুর থেকে ফের তিনি টোকিও যাওয়ার মনস্থির করেন। সেই উদ্দেশেই ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানের (তৎকালীন তাইপেই) তাইহোকুর বিমানে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে ছিলে কর্নেল হাবিবুর রহমান ও জাপানের সেনাকর্তারা। বলা হয়, ১৮ অগস্ট ওই বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয় নেতাজির। তাঁর দেহের ৯০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। দুই দিন পর নেতাজির দেহ সৎকার করা হয়। সেই চিতাভস্ম টোকিওর রেনকোজি বৌদ্ধ মন্দিরে রাখা রয়েছে এখনও।
তবে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্ব মানতে নারাজ অনেকেই। নেতাজির অন্তর্ধানের পর একাধিক জায়গায় তাঁকে দেখা গিয়েছিল বলেই দাবি করা হয়। এমনকী, ২০১৬ সালে সরকারের প্রকাশিত ১০০টি গোপন গোয়েন্দা ফাইলে দাবি করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট নেতাজির অন্তর্ধানের পর রাশিয়ায় তাঁর উপস্থিতি ও ভারতে ফিরে আসার প্রমাণ মিলেছিল। সন্দেহ যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই তথ্যে যে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নেতাজির পরিবারের উপরে গোয়েন্দারা নজরদারি করেছিল। এই ফাইলগুলি দিল্লির জাতীয় আর্কাইভে রাখা রয়েছে।
১৯৪৭ সাল। সবে স্বাধীনতা লাভ করেছে ভারত। এই সময় এক সাংবাদিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সামনে শিকাগো ট্রিবিউনের একজন সাংবাদিক দাবি করেন, দুর্ঘটনার ঠিক পরে, ১৯৪৫ সালের ২১ অগস্ট নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে সায়গনে দেখা গিয়েছিল। এরপরই একের পর এক জায়গায় নেতাজির দর্শনের তত্ত্ব সামনে আসে। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন নেহরু সরকার নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটন করতে শাহনাওয়াজ কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি জানায়, বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। তবে শাহনাওয়াজ কমিটির সদস্য নেতাজির ভাই সুরেশ চন্দ্র বসু কমিশনের রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি। তিনি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছিলেন।
পরে ১৯৭০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারও খোসলা কমিশন গঠন করে। সেই কমিটিও বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই মান্যতা দেয়। একমাত্র প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের নির্দেশে তৈরি বিচারপতি এম কে মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয় তদন্ত কমিশন দাবি করে যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি জীবিত ছিলেন।
মুখার্জি কমিশনকে লেখা চিঠিতে তাইওয়ান সরকার জানিয়েছিল, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তো দূর, সারা বছর তাইওয়ানে কোনও বিমান ভেঙে পড়েনি। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাইওয়ানের হাসপাতালের লগবুকেও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। হাবিবুর রহমান বা তার সঙ্গে থাকা জাপানি সেনাকর্তাদের মৃত্যুর কোনও নথিও পাওয়া যায়নি।
১৮ অগস্ট, যেদিন নেতাজির বিমান ভেঙে পড়েছিল বলে দাবি করা হয়, তার দুইদিন পর এক জাপানি সৈনিকের সৎকারের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তার মৃত্যু হৃদরোগে হয়েছিল বলে উল্লেখ ছিল। এই সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করেই মুখার্জি কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। এই রিপোর্টকে সমর্থন জানিয়েছিলেন বসু পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যও।
বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তত্ত্ব নিয়ে যেমন ধোঁয়াশা রয়েছে, তেমনই অনেকে আবার বিশ্বাস করেন, রাশিয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন নেতাজি। সেখানে তাঁকে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দি করে রেখেছিলেন খোদ স্তালিন। রাশিয়ার কারাগারেই তাঁর মৃত্য়ু হয়। এই নিয়ে ১৯৬১ সালে অর্ধেন্দু সরকার নামক এক ভারতীয় দাবি করেছিলেন যে তাঁর কোম্পানির এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার নেতাজিকে সাইবেরিয়ায় দেখেছিলেন।
নেতাজি নিয়ে গবেষক পুরবী রায় রাশিয়াতেও গিয়েছিলেন এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। সেখানে তিনি এমন কিছু তথ্য পান, যাতে স্পষ্ট ছিল যে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নেতাজি সেখানেই ছিলেন। এই সংক্রান্ত তথ্য তৎকালীন সাংসদ চিত্ত বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লি যাওয়ার পথেই রাজধানী এক্সপ্রেসে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় চিত্ত বসুর। তার সঙ্গে থাকা যাবতীয় নথি গায়েব হয়ে যায়।
১৯৬৬ সালে রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের) তাসখন্দে গিয়ে মৃত্য়ু হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। তিনি সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই রাতেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু হয়। তবে রহস্য দানা বাঁধে অন্য জায়গায়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর স্ত্রী দাবি করেছিলেন, মৃত্যুর আগে শেষবার যখন তিনি বাড়িতে ফোন করেছিলেন, তখন বলেছিলেন, একজন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছেন, যার জন্য গোটা ভারতবর্ষ অপেক্ষা করে রয়েছে। আগামিকাল দেশে ফিরে গোটা জাতিকে চমকে দেওয়ার মতো উপহার দেবেন।
ওই ফোন কলের পরই লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু হয়। হোটেল থেকে গায়েব হয়ে যায় তাঁর ডায়েরি। মনে করা হয়, ওই বিশেষ ব্যক্তি আর কেউ নয়, নেতাজিই ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই সম্ভবত লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে কেউ বা কারা হত্যা করেছিল। যদিও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুও রহস্যই রয়ে গিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটির সাক্ষী, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর চিকিৎসক ও সচিবও পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। ফলে নেতাজির রহস্যও অজানাই রয়ে যায়।
তবে যে তত্ত্বটি সবথেকে বেশি জোরাল হয়েছিল, তা হল গুমনামী বাবা। বহু গবেষক দাবি করেন যে ১৯৪৫ সালে অন্তর্ধানের কয়েক বছর পর নেতাজি ভারতে ফিরে এসেছিলেন। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে, ভিন্ন বেশে। নেতাজির উধাও হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পর উত্তর প্রদেশের ফৌজাবাদের রামভবনে থাকতে শুরু করেন এক বাঙালি সন্ন্যাসী। তাঁর নাম ছিল ভগবানজি। মতান্তরে মহাকাল ও গুমনামী নামও শোনা যায় তাঁর। গুমনামী বাবা বিশেষ কারোর সঙ্গে তিনি দেখা করতেন না। তবে তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নাকি অদ্ভুত মিল ছিল নেতাজির। মুখার্জি কমিশনও এই কথা স্বীকার করেছিল। তবে নেতাজি ও গুমনামী বাবার হাতের লেখা মেলেনি। সিএফএসএল কলকাতার রিপোর্টে ম্যাচ হয়নি নেতাজির ডিএনএ-র সঙ্গে গুমনামী বাবার দাঁতের ডিএনএ। যদিও এই রিপোর্ট নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।
উত্তর প্রদেশের ওই আশ্রমে থাকা গুমনামী বাবাকে যারা দেখেছেন, তারা অনেকেই দাবি করেন যে নেতাজিই গুমনামী বাবা ছিলেন। নেতাজী মা কালীর ভক্ত ছিলেন। উত্তর প্রদেশের ওই আশ্রমেও কালী পুজো হত। নেতাজির জন্মদিনে ওই আশ্রমে আসত মিষ্টি ও ইলিশ মাছ। শোনা যায়, নেতাজির বাড়ি থেকেই ওই মাছ ও মিষ্টি আসত।
১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গুমনামী বাবার মৃত্যু হয়। এরপর আরও জোরাল হয় নেতাজিই গুমনামী বাবা ছিলেন, এই তত্ত্ব। নেতাজির ভাইঝি ললিতা বসু পরের বছরই ওই আশ্রমে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুমনামী বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে দাবি করেন, এগুলি তাঁর রাঙা কাকারই।
ললিতা বসুর আবেদনেই ফৈজাবাদের ট্রেজারিতে গুমনামী বাবার জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়। গুমনামী বাবার ট্রাঙ্ক খোলা হয় মুখার্জি কমিশনের সামনে। দাবি করা হয়, ওই ট্রাঙ্কে নেতাজির মা-বাবা ও পরিবারের ছবি ছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ছবিও ছিল। সঙ্গে ছিল গোল ফ্রেমের চশমা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ফ্ল্যাশ লাইট, জার্মান বাইনোকুলার, রোলেক্স ঘড়ি, পোর্টেবল বেলজিয়ান টাইপরাইটার, জাপানিজ ওয়াটার ফিল্টার। নেতাজি যে যে দেশে ছিলেন, সেখানকারই এই জিনিসপত্র।
পাওয়া যায় একাধিক চিঠিও, যেখানে নেতাজির বেঁচে থাকার প্রমাণই মেলে। নেতাজির বউদির হাতে লেখা একটি চিঠি মিলেছিল, যাতে লেখা ছিল ‘পরম কল্যাণীয় দেবর, চিরজীবেষু। প্রাণাধিক স্নেহ আশীর্বাদ।’ এই প্রমাণগুলিই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে ভগবানজি বা গুমনামী বাবাই নেতাজি ছিলেন। তবে এই রহস্যের উদঘাটন আজও হয়নি। আজও প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে, নেতাজি কি সত্য়িই স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসেছিলেন? কোন চাপা অভিমানে তিনি দেশের সবথেকে প্রিয় নেতার পরিচয় ত্যাগ করে অজ্ঞাত এক সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন?