মুখ থেকে কথা আর ধনুক থেকে তির বেরিয়ে গেলে, তা আর ফেরানো যায় না। এটি বাংলার বহু পুরনো প্রবাদবাক্য। আর সেই কথা নিয়েই যত কাণ্ড। কথার জালে জড়িয়ে পড়লেই বিপদ। কাকে কী বলবেন, কতটুকু বলবেন, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে আইনের জালেও। আপনার বলা কথায় কারও সম্মানহানি হচ্ছে না তো? ভারতীয় আইন অনুযায়ী সে ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। টাকা দিয়ে করতে হতে পারে ‘ক্ষতি’ পূরণও। প্রতিনিয়ত শোনা যায়, কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতা মানহানির মামলা করছেন। কখনও ডাক পড়ছে রাহুল গান্ধীর, কখনও কেজরীবালের। আদলে কতটা কঠিন এই মামলা?
২০২৪-এই পশ্চিমলঙ্গের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস একটি মানহানির মামলা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। সিঙ্গল বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল একটি নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল সম্পর্কে সম্মানহানিকর মন্তব্য করতে পারবেন না। এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য ছিল, এ তো মুখ্যমন্ত্রীর বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ! এ কথা শুনে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ ছিল, “মানুষের বাকস্বাধীনতা খর্ব করা যায় না। যদিও এই বাকস্বাধীনতার কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মন্তব্য করার সময় মনে রাখতে হবে, সেটা যেন মানহানির যে সংজ্ঞা বা মানহানি সম্পর্কিত যে আইন আছে তাকে লঙ্ঘন না করে।” এই মানহানি আর বাক স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব বরাবরের। ভারতে মানহানির জন্য কি সত্যিই শাস্তি পেতে হয়? দিতে হয় জরিমানা?
বাক স্বাধীনতাও আছে আবার মানহানিও!
ভারতের সংবিধানে প্রাধান্য পায় বাক স্বাধীনতা। তবে মানহানি হবে, এমন স্বাধীনতাও দেওয়া হয়নি। সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বাক স্বাধীনতার কথা। তবে ১৯(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের মানহানির আইনের কথা মাথায় রেখে বাক স্বাধীনতার বিষয়টির সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থাৎ বাক স্বাধীনতার নামে ‘যা খুশি’ বলা যায় না। যার উদ্দেশে বলা হচ্ছে, তার সম্মান বা মর্যাদা যাতে ক্ষুন্ন না হয়, সে দিকে নজর রাখতে হবে।
মান বা সম্মান হল এমন একটি বিষয়, যা নষ্ট হলে বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের পক্ষে। কোন ব্যক্তি বা সংস্থা- দুই ক্ষেত্রেই ভাবমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনও ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষ বা পরিবারের ওপরেও প্রভাব পড়ে। সংস্থার ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রভাবিত হন কর্মীরাও। সিনিয়র অ্যাডভোকেট প্রতীর ধর বলছেন, ভারতে দুই ধরনের মানহানির মামলা হয়, একটি সিভিল ও অপরটি ক্রিমিনাল। প্রথমটির ক্ষেত্রে শাস্তিস্বরূপ দিতে হয় টাকা, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে জেল ও জরিমানার শাস্তি ধার্য করা আছে।
এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিচ্ছেন বিশিষ্ট আইনজীবী প্রতীক ধর। তিনি জানান, বাক স্বাধীনতা আর সম্মান রক্ষা- দুটোই নাগরিকদের অধিকার। ধরা যাক কেউ বললেন, ‘ও চুরি করেছে’। এটা বলা বাক স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু, কেউ যদি চুরি না করেন, তাহলে তিনি মানহানির অভিযোগ করতে পারেন। আর যদি সেই ব্যক্তি সত্যিই চোর হন, তাহলে আর কোনও মামলার অবকাশ থাকবে না।
ফেসবুক-টুইটারে কি লাগাম ছাড়া মন্তব্য করা সম্ভব?
মানহানি নিয়ে প্রতিনিয়ত গুচ্ছ গুচ্ছ মামলা হচ্ছে দেশের কোনও না কোনও আদালতে। কারও সম্পর্কে অপমানজনক কথা বললে, তা নিয়ে ভারতীয় আইনে অভিযোগ জানানোর উপায় আছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, কিছু পোস্ট করার ক্ষেত্রে লাগাম রাখে না কেউ। কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে একেবারে প্রকাশ্যে বার্তা দিতে দেখা যায় অনেককেই। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে এমন কিছু করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকা দরকার।
সোশ্যাল মিডিয়ায় মানহানিকর বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রেও রয়েছে বাধ্যবাধকতা। আদালতও সতর্ক করেছে এ ব্যাপারে। সম্প্রতি একটি মামলায় দিল্লি হাইকোর্টে রিটুইট-এর প্রসঙ্গ ওঠে। কারও টুইট রিটুইট করেও কি মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া যায়? বিচারপতি স্বর্ণকান্ত শর্মা এই প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণে বলেন, “কারও ভাবমূর্তি বা সম্মান নষ্ট হলে, সেই রিটুইট সবসময় শাস্তিযোগ্য।” তবে ডিসক্লেমার বা সতর্কীকরণ থাকলে, তা গ্রহণযোগ্য। আদালত উল্লেখ করে, ‘কন্টেন্টটির সত্যতা যাচাই করা হয়নি’, এমন সতর্কবার্তা দিলে আইনি জটিলতায় জড়াতে হবে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৪-এ এক সাংবাদিকের করা মামলায় একাধিক রাজনৈতিক নেতাকে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ডিলিট করার নির্দেশ দেয় দিল্লি হাইকোর্ট। কংগ্রেস নেতা রাগিনী নায়েক, জয়রাম রমেশ ও পবন খেরা ওই সাংবাদিকের ব্যবহার করা ভাষা নিয়ে অভিযোগ তুলে পোস্ট করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাংবাদিক মানহানির মামলা করাতেই ওই পোস্ট মুছে ফেলতে হয় আদালতের নির্দেশে।
ভারতীয় আইনে মানহানি সম্পর্কে কী বলা আছে?
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৩৫৬ ধারায় মানহানির বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এর আগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির বিষয় ও ৫০০ ধারায় মানহানির অভিযোগে শাস্তির কথা উল্লেখ ছিল।
ক্রিমিনাল ডিফেমেশন বা মানহানির ক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কোনওভাবে অপমান করেন, অন্য কাউকে অপমান করার জন্য উস্কানি দেন, শান্তি নষ্ট হতে পারে, এমন কোনও মন্তব্য করেন, তাহলে কারাদণ্ডের শাস্তি হতে পারে। সর্বাধিক ২ বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা দুটোই জারি করা হতে পারে।
কী কী ভাবে হতে পারে মানহানি?
কারও অপমান হয়, এমন কোনও কথা বললে, কোনও ভঙ্গিমা করলে, কোনও লিখিত বার্তা দিলে মানহানির অভিযোগ উঠতে পারে।
-কারও মৃত্যুর পর যদি সেই ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কোনও মন্তব্য করা হয়, যাতে তিনি বেঁচে থাকলে অপমানিত হতে পারতেন, সে ক্ষেত্রে মানহানির অভিযোগ উঠতে পারে।
-সরাসরি না বলে, কাউকে কটাক্ষ করা হলে, বা পরোক্ষভাবে অপামানজনক কথা বলা হলে, সেটাও মানহানির আওতায় পড়বে। যেমন প্রথম ব্যক্তি যদি ‘চোর’ ইঙ্গিত করে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলে, ‘ও তো খুব সৎ, চুরি করতেই পারে না’, তাহলে মানহানির অভিযোগ উঠতে পারে।
-কেউ যদি ছবি এঁকে চুরির ইঙ্গিত দেয়, তাহলেও মানহানির অভিযোগ ওঠে।
আদৌ কি শাস্তি হয় মানহানির মামলায়?
সিনিয়র অ্যাডভোকেট প্রতীক ধর বলছেন, আমাদের দেশে এই বিষয়টা একটা ‘টুল’ (উদ্দেশ্য) হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মামলা করে সবাইকে জানান দেওয়া হয়। তিনি জানিয়েছেন, সিভিল-এর ক্ষেত্রে কোনও শাস্তি হবে না, টাকা দিতে হবে। আর ক্রিমিনাল-এর ক্ষেত্রে সাজা দিতে পারে আদালত। তবে তিনি জানান, আইনে থাকলেও আমাদের দেশে মানহানির মামলায় শাস্তির নজির খুব বেশি নেই।
মানহানির মামলা করলে দিতে হবে টাকাও!
২০২৩ সালে বিধায়ক পুলক রায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন। আবার ২০১৪ সালে শুভেন্দু অধিকারী ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেছিলেন কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে। তবে এইসব ক্ষেত্রে মামলাকারীকেও দিতে হয় টাকা, যাকে বলা হয় কোর্ট ফি। সাধারণ ভিন্ন ভিন্ন কোর্টে সেই কোর্ট ফি-র আলাদা আলাদা হিসেব রয়েছে।
তবে ভারতে মানহানির মামলায় অভিযুক্তকে জেল খাটতে হয়েছে, এমন উদাহরণ মনে করছে পারছেন না আইনজীবীরা। পলিটিক্যাল টুল হিসেবেই এর ব্যবহার বেশি।