সুচরিতা দে
৯ অগস্ট। শুক্রবার। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার আগের দিন প্রয়াত হয়েছেন। আর ওইদিন তাঁর মরদেহ এনআরএসে দান করা হবে। সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের চোখের জলে শেষযাত্রার মিছিল এনআরএসের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর ওই সময়ই কিছুটা দূরে আরজি কর হাসপাতালে এক মহিলা জুনিয়র ডাক্তারের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে হইচই শুরু হয়। আরজি করের সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় তাঁর দেহ। ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। ‘তিলোত্তমা’-র নৃশংস পরিণতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। তেমনই এক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে গত ২১ অগস্ট, বুধবার কলকাতায় আসেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। তাঁর আগামী ছবি ‘দিল্লি ফাইলস’ এর জন্য গবেষণার কাজে ব্যস্ত তিনি। তারই ফাঁকে কলকাতায় আসা। মিছিলে অংশ নেওয়ার পর টিভি৯ বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন কাশ্মীর ফাইলসের পরিচালক। মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন আরও অনেক বিষয়। কলকাতার মেয়ের জন্য ন্যায় বিচার চেয়ে কলকাতার জনগণের সঙ্গে মিছিল করে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন টিভিনাইন বাংলার কাছে। শহরের পাঁচতারা হোটেলে নিরাপত্তার বলয় টপকে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় উঠে এল নানা প্রসঙ্গ।
কেন তিনি কলকাতার মিছিলে হাঁটলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, “আমি জানি না কেন এলাম কলকাতা! অস্থির লাগছিল। মন চাইল তাই কলকাতা চলে এলাম। আমার মনে হয়েছিল এই রকম একটা নৃশংস ঘটনা যেটা সকলকে নাড়া দিয়ে গেছে, আমারও এই প্রতিবাদের অংশ হওয়া উচিত। এছাড়াও সকলেই জানে আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকি। এর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আক্রান্ত হই। সেই সময় আমার কাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। গাড়ির উপর হামলা হয়েছিল। তারপর থেকেই বহু ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কলকাতা আসতে থাকি। নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকি। এছাড়াও গত চার-পাঁচ বছর ধরে আমি বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি।”
২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনার সময় সকলেই এক সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ দিল্লি যান। সেকথা উল্লেখ করে তিনি জানালেন, “সেই সময় আমি নিজেও ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছিলাম। তিন-চার মাস ছিলাম। তবে এই ঘটনা কলকাতাতে হয়েছে। তাই প্রত্যেক সাধারণ মানুষ থেকে তারকারা সমাজ মাধ্যমে দু’কলম লিখেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তবে শহরে আসছেন না। আমার মনে হয়েছে এটা তো একদম সঠিক কাজ নয়। আসা উচিত। সামনে থেকে বিরোধিতা করা উচিত। এটা আমি জানি না, এই বিরোধিতা করার জন্য কিছু প্রভাব পড়বে কি না ঠিক জানি না। সরকার শুনবে কি না, সুপ্রিম কোর্ট শুনবে কি না, ঠিক জানা নেই। তবে আমার আসার জন্য আমারই ক্ষতি। কারণ আমার আসা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি নানা ধরনের কথা সমাজ মাধ্যমে লিখে চলেছে। তবে এসব তো চলতেই থাকবে। আমাকে নিয়ে সমালোচনা হতেই থাকবে। এটা আটকানো যাবে না। আমার সেটা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। রাজনীতিতে আমার কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। সবকিছুই ঘুরেফিরে রাজনৈতিক হয়ে যায়, সেটা আলাদা কথা। আমার ইচ্ছা বাংলায় আবার নবজাগরণ আসুক। ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে বাংলায় মহিলাদের ধর্ষণ, খুন ও অপরাধকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ও আমরা দেখি যে মহিলাদের উপর হিংসা নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে এই সব রাজনৈতিক দল বদলালেও এরা থেকেই যায় সমাজে। এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরাই রাজনৈতিক ভোট পরিচালনা করতে থাকে। এবং ভোট ব্যাঙ্ক নির্ধারক হয়ে উঠেছে। হিংসার সঙ্গে যুক্ত ক্রিমিনাল রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় বড় হয়। আমার মনে হয় এটাই কারণ বাংলাতে ভোট পরবর্তী হিংসা সবথেকে বেশি হয়ে থাকে।”
রাজনৈতিক দলগুলিকে আক্রমণ করে কাশ্মীর ফাইলসের পরিচালক বলেন, “কেউ মানতে পারে বা অস্বীকার করতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গে পার্টি ওয়ার্কাররাই মহিলাদের শোষণ করে থাকে। খুব সাম্প্রতিক সন্দেশখালির মহিলারাই সামনে এসে প্রতিবাদ করেছে। কোর্টও সেই কথাই বলছে। এমনিতে তো মহিলারা সামনে এসে ভুল বলতে পারে না। কলকাতা শহর তো অনেক নিরাপদ জায়গা। প্রত্যন্ত গ্রামে সব মহিলারাই জানে তারা নিরাপদ নয়। এটাই হয়ে চলেছে। সেই কমিউনিস্ট পার্টির সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। এর পরে কোন দল ক্ষমতায় আসবে জানি না। তবে আমার ধারণা, তারাও এই ট্র্যাপে পড়বে।”
তিনি জানান, “মহিলারাই টার্গেট হয়। মহিলাদের উপর অত্যাচার কোনও আইন শৃঙ্খলার বিষয় নয়। এটা একটা সাংস্কৃতিক ইস্যু। সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এর পিছনে কাজ করে থাকে। মহিলাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। নিগ্রহ করা, ইভটিজিং হতেই থাকছে। সমাজ এর জন্য দায়ী। শুধুমাত্র বাংলাতে নয়, ভারতের সব প্রান্তেই নারী সুরক্ষিত নয়। প্রত্যকটি মেয়ে সেটা জানে। অনুভব করতে পারে। তবে বাংলাতে দেখা যাচ্ছে, যখন মহিলারা সামনে এসে প্রতিবাদ করছে, নিজের উপর হওয়া অন্যায় নিয়ে মুখ খুলছে, তখন বাংলার প্রশাসন সেই বিষয় বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। তার জন্যই বাংলার লোকের মধ্যে এত রাগ।” বিবেক অগ্নিহোত্রী এই প্রসঙ্গেই বললেন, “কদিন আগেই বদলাপুরে এইরকম জঘন্য অপরাধ হয়েছে। হাথরসে হয়েছে। উন্নাওতে হয়েছে। কেউ বলতে পারবে না, দেশের অন্য প্রান্তে মহিলারা সুরক্ষিত। আপনিও বলতে পারবেন না।”
তিনি জানালেন, “রাজস্থানে এখনও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। মহিলা সন্তান, মহিলা ভ্রূণ হত্যা করা হয়। এই দেশে মহিলাদের বেঁচে থাকা খুব সহজ নয়।” তবে তিনি জানালেন, “সব জায়গায় মহিলাদের সুরক্ষার প্রশ্ন থাকলেও রাজনৈতিক আশ্রয় থাকে না। অন্য জায়গায় সমস্যা থাকলেও বাংলাতে যা হচ্ছে, খোলাখুলি চলছে। কলকাতার মানুষ রাস্তায় হাঁটছে। আমার সঙ্গে বাংলার বাইরে থেকে মানুষ আসেনি। আমি শুনেছিলাম, প্রাক্তন সাংসদ তথা অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন বলে সমাজ মাধ্যমে তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সবাই বলছে ,আমি রাজনীতি করছি। আমি কেন রাজনীতি করব? কলকাতার জনতাই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে। আমি শেষে এসেছি। আমার আসার কারণ আমি আমার বন্ধুদের, ছাত্রদের মহিলাদের পাশে আছি এটা বোঝাতে। আমার মনে হয়েছে এখানকার মানুষের মনে ধর্ষণ ও খুন নিয়ে রাগ আছে। তবে সব থেকে বেশি রাগ আছে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত দোষীদের আড়াল করা হচ্ছে বলে। আমি বারবার বলছি, বাংলা ধর্ষণ-খুনের রাজধানী নয়। অন্য জায়গাতেও হয়ে থাকে, তবে আমার মতে বাংলা এমন হবে যে মহিলাদের সুরক্ষার রক্ষাকবচ হবে।”
বাংলার ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে কাশ্মীর ফাইলসের পরিচালক বলেন, “বাংলাই এমন জায়গা যেখানে ‘বন্দেমাতরম’ লেখা হয়েছে। মা ভারতী এখান থেকেই প্রথম পূজিত হন। দেশাত্মবোধ বাংলা থেকেই সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। যে সাংবাদিকতা আজ আমরা দেখছি তার শুরু হয়েছিল এই বাংলাতেই। বন্দেমাতরম খবরের কাগজের সম্পাদনা করেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। এতটাই জোরালো ছিল লেখা যে বিভক্ত বাংলাকে জুড়তে হয়েছিল। সারা দেশ একত্রিত হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে।”
তিনি বলেন, “বাংলাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য রচনায় মহিলাদের সমাজে এগিয়ে রেখেছেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি সিনেমাতে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা দেখিয়েছেন। দেবী দুর্গা সারা ভারতে পূজিত হন। কিন্তু বাংলাতে মা কালী রূপের পুজো হয়। যেখানে নারী যোদ্ধা, ভয়ঙ্কর রূপে রয়েছেন। এখানে সকলের মানসিকতা অনেক বেশি উদার। ভারতের অন্যত্র শিবাজি, মহারাণা প্রতাপের কথা বলা হয়, কেবল বাংলায় নারী শক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতে এখনও যেখানে মহিলারা ঘোমটা টেনে থাকে, সেখানে বাংলার মহিলারা পোশাক পরিচ্ছদেও অনেক এগিয়ে। প্রথম ক্যাবারে এই শহর থেকে এসেছে, মহিলারা ক্লাবে যাওয়ার স্বাধীনতা পায়, অনেক আলাদা বাংলা দেশের তুলনায়। সেই কারণেই মনে হয় উত্তর ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এই বাংলায় সাফল্য পায় না। কারণ তারা এই রাজ্যের মানসিকতা বুঝতে পারে না।”
পরিচালক বিবেক জানালেন, “আমি যা বলি, তাই রাজনৈতিক নয়। গত দুশো বছরের ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে বাংলাই পথ প্রদর্শক ছিল। এখান থেকেই সব ধরনের রেনেসাঁ হয়েছে। সতীপ্রথা বন্ধ করা থেকে বিধবা বিবাহ এই বাংলা থেকেই এসেছে। স্বামী বিবেকানন্দ মহিলাদের নিয়ে বই লিখেছেন। আমি পড়েছি।”
পরিচালক বলেন, “এই মাটির গুণ এমন যে বাচ্চা জন্মেই সে সঙ্গীত, সাহিত্যি, দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। বলিউডে সব নামী সঙ্গীত শিল্পী থেকে চিত্র শিল্পী সকলেই বাংলার। আমি এটাই বলতে চাই বাংলা এমন সুরক্ষিত হবে যে বাবা মা বাচ্চাদের বাংলাতে পাঠাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি শিখতে। জীবনের শেষ সময় শান্তিনিকেতনে এসে কাটাবে সবাই। এটাই আমার স্বপ্ন। তবে মন ভেঙে যায়, যখন দেখি এখানকার মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের অপদার্থতাকে আড়াল করেন। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের অন্যায়কে আড়াল করেন। এর পর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাস্তায় নেমে নিজের বিরুদ্ধেই বিরোধিতা করছেন। এটা তো এমন হয়ে গেল যে সব পুলিশ রাস্তায় নেমে চোরদের বিরোধিতা করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমার মন ভেঙে গিয়েছে। তাই আমি কলকাতার মানুষের পাশে এসেছি। আমি লজ্জিত মহিলাদের সঙ্গে এমন ব্যবহারে। বাংলার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। পাঁচ বছর ধরে রিসার্চ করছি আমার আগামী ছবি ‘দিল্লি ফাইলস’ এর জন্য। যেখানে বাংলার ইতিহাস থেকে বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় উঠে আসবে।”
এই ছবির শ্যুট কবে থেকে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্ষার পরই শ্যুট শুরু করবেন তিনি। বাংলাতে এসে কি শ্যুট করবেন? এই কথার উত্তরে হতাশার সুরে বলেন, কাশ্মীর আর বাংলাতে তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হবে না। আরও বলেন, কলকাতার রাস্তায় তাঁকে যেকোনও মুহূর্তে গ্রেফতার করাতে পারে এই সরকার। তবুও তিনি কলকাতা আসা ছাড়বেন না। তাঁর দেশ এটা। তাঁর বাবা মা অনেকটা সময় এই বাংলায় ছিলেন।
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)
এই প্রসঙ্গেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কাশ্মীর ফাইলস, তাশখন্দ ফাইলস, তাঁর সব সিনেমাকে বলা হয় প্রোপাগান্ডা ফিল্ম। যে কারণে কলকাতার সিনেমা হলে কাশ্মীর ফাইলস প্রদর্শনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এর উত্তরে বিবেক অগ্নিহোত্রী বলেন, তাঁর খারাপ লেগেছিল। তবে কিছু করার ছিল না। সঙ্গে তিনি আরও জানান, সত্যি কথা বললেই সকলে সেটাকে প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বলে দাগিয়ে দেয়। সত্যি যদি প্রোপাগান্ডা হত তাহলে আজ কাশ্মীরি পণ্ডিত কাশ্মীর ফিরে যেতে পারত। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুরহস্য সামনে আসত। সব শেষে তিনি জানালেন, তাঁর কাজকে রাজনৈতিক রং দিলেও তিনি সত্য বলার চেষ্টাই করবেন।