সালটা ২০০৬। তারিখ ৬ জানুয়ারি। জমি আন্দোলনে তপ্ত নন্দীগ্রামে প্রথম প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। ৭ জানুয়ারি সকালে শঙ্কর রায় এবং শেখ সেলিমের মৃত্যুর খবর হাওয়ার থেকেও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ্যের প্রতিটা কোণায় কোণায়। এদিকে ওই দিনই ব্রিগেডের মঞ্চে তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল ‘‘কৃষি আমাদের ভিত্তি। শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’’ যা আজ বাম কর্মীদের মুখে ঘুরে ঘুরে কার্যত স্লোগানে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের অগণিত বাম কর্মী-সমর্থকদের কাছে আজও তিনি অক্সিজেন, তিনিই প্রাণবায়ু, তিনিই অতীত, তিনিই বর্তমান, তিনিই ভবিষ্যত। ফেসবুকের দেওয়াল হোক বা ব্রিগেডের লাল পতাকায় ঢাকা পড়া মাঠ, তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠস্বর শুনলে আজও লালফৌজের রক্ত টগবগ করে ফোটে। সশরীরে তিনি আর নেই। কিন্তু, রয়ে গিয়েছেন অগণতি বামপন্থীদের মনের মণিকোঠায় থাকা সেই বিশাল ব্রিগেডে। লাল গালিচা পাতা ‘ঠাকুর ঘরে’। ‘ঈশ্বর’ সেখানে একজনই, বুদ্ধদেব ভট্টচার্য। যিনিই ফেরাতে পারেন পদ্ম পুরষ্কারের মতো সম্মানও। ২০০০ সালে মসনদে বসা থেকে ২০১১ সালে মসনদ থেকে বিদায়। বিতর্ক কিন্তু পিছু ছাড়েনি তাঁকেও।
জ্যোতি বসুর পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই শুরু মার্কসবাদী চিন্তাকে পাথেয় করে জোর দিয়েছিলেন দু’টি বিষয়ে। শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান। শুরু থেকেই পাখির চোখ করেছিলেন দু’টি বিষয়কেই। পেয়েছিলেন সাফল্যও। নতুন আইটি নীতির পাশাপাশি রাজ্যে প্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নও ঘটান। এই ক্ষেত্রে বড়সড় কর্মসংস্থানও দেখা যায়। নয়াচরে কেমিক্যাল হাব-সহ একাধিক কারখানা গড়তেও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালে রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী, পরের বছরেই মুখ্যমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। তারপর শুরু এক লম্বা উড়ানের। জ্যোতির আলোয় ‘আলোকিত’ না হয়েও তিনি ক্রমেই উঠে আসতে থাকলেন দলের মধ্যমণি হয়ে। জয় করলেন জনপ্রিয়তার এভারেস্ট, ভাসলেন জনপ্লাবনে। বাংলায় তৈরি হল ব্র্যান্ড বুদ্ধ। যে ব্র্যান্ডের ব্রান্ড অ্য়াম্বাসাডারকে দেখতে কদিন আগেও ব্রিগেডে উপচে পড়ত ভিড়। যে ব্রান্ডের ‘মালিক’কে নিয়ে কোনও ‘কু-কথা’ শোনা যায়নি খোদ ‘পালাবদলের’ কাণ্ডারীর গলাতেও।
২০১০ সালে জ্যোতি বসুর প্রয়ানের পর তিনিই ছিলেন ব্রিগেডের প্রথম ও শেষ কথা। ২০১১ সালে মমতার কাছে হারের পরেও দমে যাননি তিনি। খাতায়কলমে মুখ্যমন্ত্রীত্ব চলে যাওয়ার পরেও দলের কর্মীদের মনে মুখ্য ‘মন্ত্রী’ ছিলেন তিনিই। চুল থবথবে সাদা হলেও তাঁর তেজে বারবার উদ্ভাসিত হতে দেখা গিয়েছে দলের তরুণ-তুর্কিদের। শেষ কয়েক বছর সময়টা থুড়ি শরীরটা আর সঙ্গ দেয়নি তাঁর। তবে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তাঁকে। ‘ভুলও’ স্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকারের যে কয়েকটা ভুল আমার চোখে পড়েছে, তার মধ্যে প্রথম হল, আমাদের শিল্প নিয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।’ যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মনে হয় এমন এক বিষয় যাঁকে ঠিক-ভুল, সাফল্য-ব্যর্থতার বাইনারিতে ফেলা যায় না। বুঝে নিতে হয় নিজের নিজের মতো করে।
যদিও এত বিতর্কের মধ্যেও কিন্তু, তাঁকে নিয়ে দলের কর্মীদের আবেগে ভাটা পড়েনি কখনও। ২০১৯-এ বামেদের ব্রিগেডে অল্প সময়ের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর ওই স্বল্প উপস্থিতিই অক্সিজেন জুগিয়েছিল বাম কর্মী সমর্থকদের। মঞ্চে উঠতে পারেননি। নাকে ছিল অক্সিজেনের নল। হস্তমুদ্রায় ছিল ‘ইনকিলাব’ সংকেত। সেদিনই যেন আরও একবার যেন ‘বিপ্লব’ স্পন্দিত বুকে গোটা ব্রিগেড বলে উঠেছিল ‘লাল সেলাম, লাল সেলাম,লাল সেলাম কমরেড’।
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)