নোলক-নাকচাবি উবে গিয়ে এল নথ, বাঙালি বিয়ের বদলে যাওয়া অলঙ্কার-ইতিবৃত্ত

Jul 16, 2024 | 6:10 PM

History of Jewellery: কাগজের বাণ্ডিলের ভিতর থেকে তখন গুপ্তধন বের হচ্ছে এক এক করে। এমন সোনার গয়না বাপের কালে দেখেননি মিন্টুর মা। খনি থেকে যেন এক একটি রত্ন বের হচ্ছে। উঁকি মেরে দেখতে হচ্ছে। আলমারির ভিতরের এক গোপন কুঠুরিতে এতবছর ধরে এই গুপ্তধন রেখে দিয়েছিলেন কীভাবে, সেটাও ভাবাচ্ছে তাঁকে। শাশুড়িমায়ের এই সুপ্ত ইতিহাস তো কখনও শোনেননি।

নোলক-নাকচাবি উবে গিয়ে এল নথ, বাঙালি বিয়ের বদলে যাওয়া অলঙ্কার-ইতিবৃত্ত

Follow Us

বিয়ে পাকা হয়েছে অনেক আগে। এ বছরের ডিসেম্বরে পড়েছে বিয়ের তারিখ। কেনা হয়ে গিয়েছে লাল-কমলা ডুয়েল রঙের বেনারসি শাড়ি। অফ-হোয়াইট রঙের লেহেঙ্গা। তার সঙ্গে কেমন হবে অলঙ্কারের সাজ, সেটাও ঠিক করে রেখেছে মিন্টু। আগে থেকে সব কিছু গুছিয়ে রাখার অভ্যেস পেয়েছে বাবার থেকেই। কানবালা, টিকলি, চোখার, বালা, বাউটি, চুর, নাকচাবি, হার, বুক পর্যন্ত লম্বা সোনার হার, আঙুলের আংটি, পায়ের নুপূর, আঙোট, শাঁখা-পলা বাঁধানো, মাথায় লাগানো সোনার মুকুট… সব কিছু থরে থরে সাজিয়ে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে ব্যাঙ্কের লকারে। মোবাইলে রাখা ছবিগুলি বন্ধুদের, মাসতুতো দিদি-বোনেদের দেখানোর কোনও খামতি রাখেনি মিন্টু। এমনকি ভেবে রেখেছে, বিয়ের পর নিজের ব্লগে বিয়ের গয়না নিয়ে একটা কনটেন্ট করবে। বিয়ে পাকা হতেই তোরজোড় পড়ে গিয়েছে মিন্টুদের বাড়িতে।

বাড়িতে রয়েছে এক আদিকালের বদ্দি বুড়ি। ঠাকুমার মা। বয়স প্রায় ১০০ বছর ছুঁই ছুঁই। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর থেকেই মিন্টুদের বাড়িতে ঠাকুমা নিজের মাকে কাছে রেখেছেন। বয়স হলেও বুড়ির ব্যারাম নেই কোনও। কোমড়টাই যা সোজা নেই। বয়সের কারণে ঠিক করে দাঁড়াতে পারেন না আর। ডাক্তার-বদ্য়িও দেখাতে চান না তেমন। চোখের জ্যোতিও ম্লান হয়ে গিয়েছে। হাঁটতে গেলেই হাঁটুতে বেশ ব্যথা পান। খাওয়া-দাওয়াও বেশ কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রান্নাবান্নায় শখ আছে এখনও। হাতে দুগাছা পুরনো আমলের খাঁচ কাটা সোনার বালা পরেন। গলায় বড়দাদুর দেওয়া একটি সোনার হার। সেটাও বহুবছর ধরে পরার জন্য মসৃণ হয়ে গিয়েছে। সকালে উঠে নারকেল তেল মাখেন গোটা গায়ে-হাতে-পায়ে। চুলেও জবজবে করে নারকেল তেল মাখেন। মাথার চুল আর একটাও কালো নেই। পাটের দড়ির মতো চকচকে সুঁতুলির হয়ে গিয়েছে। সেই চুলেও রোজ সন্ধ্যের সময় চিরুনি দেওয়া চাই-চাই। কালো চুল বাধার দড়ি দিয়ে সুন্দর করে বেঁধে খোপা বাঁধেন। চোখের নিচের চামড়া, হাতের চামড়া, নখের চামড়া সবটাই বয়সের কারণে ঝুলে গিয়েছে। এতকিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও গায়ের রঙ কিন্তু এখনও পাকা। যৌবনে যে তিনি বেশ সুন্দরী ছিলেন তা বোঝা যায়। সাদা থান কাপড় পরেন, তবে বেশি বড় ও পার দেওয়া ভারি শাড়ি পরতে পারেন না।

মিন্টুর বিয়ে ঠিক হতেই বড়মা রোজই গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন। আদর করে ছোটবেলার নানা গল্প করতে করতে চোখ ছল ছল করে ওঠে তাঁর। কথায় কথায় বলে ওঠেন, মনে আছে তোর? রোজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলতিস, ‘বম্মা, আমাকে দুটো তিল দাও না।’ ছোট্ট বলে ওর মতো করে ছোট বলের মতো তিলের নাড়ু বানিয়ে একটি হরলিক্সের কাঁচের জারে রেখে দিতেন। ঠাকুরঘরে পুজোর সময়েও ছোট্ মিন্টু লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসত প্রসাদের লোভে। মিন্টু আচার খেতে ভালোবাসত বলে কুলের আচার বানাতেন যত্ন করে। বড্ড ভালবাসেন তিনি। ছোট্টবেলার কথা মনে করে অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠে চোখের কোণে জল চলে আসে এখন। কতটা সুর করে কখনও কখনও কান্না করেন। মিন্টু শুনত, আর চোখ দিয়ে একনাগাড়ে জল বয়ে যেত। পাশের ঘরে দৌড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, কোলের কাছে মুখ গুঁজে একপ্রস্ত কান্নাকাটি করত। মাও মেয়ের কান্না দেখে চোখের জল ফেলত। কিন্তু মনকে শক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। মেয়ে হয়ে জন্মেছে, পরের বাড়ির বৌ হিসেবেই যেতে হবে, আদি-অনন্ত-কাল ধরে একই প্রথা বিদ্যমান। রীতিনীতিতে ভোলবদল হলেও বিয়ের এই নিয়ম যে কখনও বদলায়নি। মেয়েরা জন্মেছেই পরের বাড়ি আলো করার জন্য।

মিন্টুদের বাড়িতে বড়মার সম্পত্তি বলতে একটি আদ্দিকালের বড় কাঠের আলমারি। তাতে নিজের সবকিছু সযত্নে রাখা থাকে। শাড়ি, ব্লাউজ, খাবারের কৌটো, চাদর, বিছানার চাদর, লেপ-কাঁথা, কম্বল… সবকিছু একটা আলমারিতে ধরে যায়। পুরনো আমলের হলেও কাঠের আলমারির গায়ে বেশ সুন্দর কলকা কাটা আছে। পিতলের কলকাগুলি নাকি কলকাতার এক ছুতোর নিজের কেরামতি দেখাতে গিয়ে করে ফেলেছেন। এখনকার দিনে এমন আলমারি ‘অ্যান্টিক’ হিসেবে স্বীকৃত। মিন্টুর ঠাকুমারও বয়স হয়েছে, কিন্তু বয়সকে তোয়াক্কা না করে এখনও বেশ চটপটে। মায়ের সব কাজ নিজের হাতে করে থাকেন। যখনই যা দরকার, নিজের থেকে করেন। মাকে একা রাখবেন না বলে বাড়ির সকলের অমতে দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। সেইসময় প্রায় সকলেই বলেছিলেন, মায়ের যা কিছু সম্পত্তি রয়েছে, তা হাতাবে বলেই মাকে সঙ্গে রাখার ফন্দি এঁটেছেন। বহুবছর আগের ঘটনা। কাঠের আলমারিতে হাত দেননি কখনও মিন্টুর ঠাকুমা। বাড়ির কেউই সেই আলমারিতে হাত দেননি। সকলেই জানতেন, ওতে রয়েছে বড়মার রোজকার ব্যবহারের জিনিসপত্র। সকলেই ভালবাসেন তাঁকে। ছোট্ট শিশুর মতোন জড়িয়ে ধরে মিন্টু। মিন্টুর সঙ্গে বেশ ভাব তাঁর।

পড়ার ঘরে এক মন দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল মিন্টু। মিন্টুর মা এসে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। মিন্টুকে ডেকে বলে উঠলেন, ‘বই পড়ছিস? একবার যা বড়মার কাছে। সন্ধ্যের সময় পান খেতে গিয়ে তোর নাম করছিল। একবার ঘুরে আয়। কী বলছে দ্যাখ তো। আজকাল শরীরটা বেশ ভাল যাচ্ছে না। গায়ে দেখলুম জ্বর আছে।’ মায়ের কথা শুনে খাট থেকে নেমেই সোজা চলে গেল বড়মার ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখে, ঠাকুমা বড়মাকে ধরে বসে আছে। বড়মা ইশারাতে মিনটুকে আলমারিটা খুলতে বলল। মিন্টু নির্জীবের মতো হেঁটে আলমারিটা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। হাতের ইশারাতে বললেন, আলমারির একদিকে কাঠের পাটাতনের নিচে লক আছে, সেটা খুলতে। ইশারা মতো মিন্টু বেশ গায়ের জোরে লক খুলে ফেলল। বহুবছর এই লকে হাত পড়েনি। লক খুলতেই বেরল পুরনো কলকাতার খবরের কাগজের একটি বাণ্ডিল। সেটা বের করে খাটে নিয়ে আসতেই চোখে ফেটে পড়ল সকলের। সকলেই বিস্ফারিত চোখে খাটের মধ্যিখানে রাখা খবরের কাগজে রাখা উজ্জ্বল সব জিনিসপত্র দেখেই চলেছে। কাগজের বাণ্ডিলের ভিতর ফিকে হয়ে যাওয়া গোলাপি কাগজের ভিতর থেকে জ্বলজ্বল করছে পুরনো দিনের সোনার গহনা। মনে হলে গুপ্তধন পাওয়া গিয়েছে। অবাক চোখে সকলেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে চলেছে।

গয়নার বাক্স সিনেমার একটি দৃশ্য!

বড়মার শ্বাসকষ্টটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদিন সন্ধ্যের সময় আবার হাঁফ ওঠে। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেতে চান না একদম। আয়ুর্বেদিক টোটকায় চলে নিজের শরীর সুস্থ রাখার চেষ্টা। সোনার গয়নাগুলি যে সব ভারি তা নয়। কিন্তু প্রতিটি জিনিস এখনও মজবুত ও চকচকে রয়েছে। মিন্টুর দিকে তাকিয়ে একদম নিচু সুরে বড়মা বললেন,’ মিনু, আমার বিয়ের কিছু গয়না এখনও রয়েছে। তোর বড়দা আমাকে সব গড়িয়ে দিয়েছিল গোপনে। আমার বাপ খেতে পেত না। বড়দা আমাকে বিয়ে করবে বলে গঙ্গা পেরিয়ে এসেছিল। রাজপুত্তর ছিল। সোনার গয়নাগুলো কলকাতার এক স্যাককরাকেগড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক গয়না ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছে। আর কিছু পড়ে রয়েছে। যা আছে দ্যাখ তো মা, তোর পছন্দ কিনা। ‘

আকাশ থেকে পড়ল মিন্টু। কাগজের বাণ্ডিলে যা সোনা আছে, তার অর্ধেকও নেই নিজের। ঠাকুমাও বেশ অবাক। এতদিন ধরে আলমারিতে পাট পাট করে মায়ের মনের মত শাড়ি গুছিয়ে রাখতেন, কখনও এই গোপন লকের কথা জানতে পারেননি। সোনার অলঙ্কার দেখে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছে মিন্টুর মাও। খাটের উপর রাখা সোনার গয়নাগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন তিনজনে। এক এক করে সাজিয়ে রাখছে মিন্টু। গয়নাগুলি তার কাছে বেশ অচেনা। চুড়ি, বালা ছাড়া বেশিরভাগই অদেখা। কিছু আছে, যেগুলি হাল আমলে ফের ফিরে আসছে। একটা বড় নথ চোখে পড়ল। ঠাকুমা বড়মার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘এটা কি তুমি পড়তে?’ মিন্টু সেটি নিয়ে নাকের কাছে এনে সেট করতে লাগল। থুতনি ছুঁই ছুঁই। নিরেট রুপো দিয়ে তৈরি। বেশ দেখতে। এমনটা বর্তমানে বেশ ট্রেন্ডি। তখনকার দিনেও এমনটা ছিল!

মিন্টুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল বড়মা। অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিয়ে বললেন, ‘এই নথ তো জেলেনির। তখন বাধা দিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। আমার কাছেই রাখা ছিল। ভেবেছিলাম নিয়ে যাবে। আমার একটা আছে, মাঝারি নথ। তাতে চুনি আর মুক্তো দেওয়া আছে। আর তুই পরতিস নাকের মাঝখানে, নোলক।’ কথার রেশ টেনে ঠাকুমা বলতে লাগলেন, ‘পুঁটি জেলেনি! ও তোমাকে এটা দিয়ে গিয়েছে? তখনকার দিন এতকিছু নকসা ছিল না। তেঁতুলের পাতা, টগর ফুল, বেল ফুলের মতো নকসা কাটা ছিল। কথাতেই আছে,… কলসী কাঁখে নোলক নাকে যাচ্ছে জলের ঘাটে। তখনকার দিনে নাকে নথ পরতেই হত। ছোট ছোট মেয়েরা নাকের মাঝখানে একটি রুপোর নোলক পরত। সধবারা নাকে মাঝারি মাপের একটি নথ পরত। তাতে মুক্তো, পান্না, চুনির দুল ঝুলত। আর এই বড় বড় নথ পরত ছোট জাতের সধবারা। তাদের ঝগড়ার বহর দেখলে মাথা খারাপ হওয়ার জোগার। বর বা জায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলেই নাকের নথ টেনে ফেলার প্রবণতা ছিল। রাগের মাথায় হাতের কাছে জব্দ করার জন্য নথ টানাই ছিল সেরা উপায়। কোনও এক কারণে বাড়িতে অর্থের টান পড়লে মায়ের কাছে এই নথটাই বন্ধক দিয়ে রেখেছিল। তারপর তো গ্রামছাড়া হয়ে গেলে আর কোনও হদিশ পাইনি। মায়ের কাছে আসত ওদের বাড়ির গল্প করতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ওই যে গেল, তারপর আর দেখেনি। ‘

নথ ছাড়াও চোখে পড়ল একটি গোঁটের। চুলে খোঁপায় লাগাবার জন্য। সুন্দর প্রজাপতি নকসা কাটা। এটা বড়মার নিজের। ছোটবেলায় অনেক লম্বা চুল ছিল। ঠাকুমাই বললেন, ‘এই গোঁট কিন্তু এখন দেখা যায় না। পুরনো দিনে চুল বাঁধার সময় একটি করে গোঁট দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। মাথায় ফুল দিত, কিন্তু পরে সেই গয়না আর দেখা যায়নি। খোঁপা বা বিনুনি করার সময় এই গোঁট পরা ছিল প্রথা। তবে একমাথা করে ঘোমটা দিলে গোঁট দেখা যেত না। আবার পরে মাথায় ফুল ও প্রজাপতি দেওয়া যখন শুরু হল, তখন কেউ আর ঘোমটা দিত না সেই সময়। ‘

ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া গোলাপি কাগজের মধ্যে রাখা আছে আরও ছোট বড় সোনার অলঙ্কার। পায়ের বুড়ো আঙুলে পরার ঘুঙুরওয়ালা চুটকি। আবার একটি আঙোটও রয়েছে। জোড়াটি হারিয়েছে মনে হয়। আঙোট দেখে ঠাকুমা যেন সেকালের কথা হুরহুর করে বলতে লাগলেন। মনে উত্তেজনা, কিন্তু কণ্ঠ নরম করে বললেন, ‘রূপকাঁসা দেখেছিস? এই দ্যাখ। কাঁসা আর রূপো দিয়ে তৈরি। গ্রামের দুলে-বাগদিরা পরত। কলকাতার মেয়েরা পরত না ঠিকই। কিন্তু রূপকাঁসার আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকজন পরতেন। মা মনে হয় এক দুলে বাড়ির মেয়েকে দেবে বলে বানিয়েছিল। বিয়ের গয়না। এখনকার দিনে এই গয়না পাওয়া দুর্লভ।’ একটা সোনার বড় মাদুলি দেখিয়ে বলে উঠলেন,’রুপো তখন সেকেলে হতে শুরু করে। এল সোনার মার্কেট। সোনার চলন বাড়তেই মাদুলির আকার হল বড়। তৈরি হল নতুন গয়না। সোনার তাগা, জশম তাবিজ, হাঙরমুখো, পুঁটেমুখো তাগা… এসব উঠতে শুরু করল।’ কানের গয়নাও রয়েছে। ‘ওই দ্যাখ তারাপাশা। তারার ডিজাইনে পাশা দুল। ছোট মতো দুলও আছে। মাকড়ির কানের গয়না তখন সবে সবে উঠতে শুরু করেছে। বিলিতি দুলও ছিল মায়ের। ছোটবেলায় এই গয়নাগুলো দেখেছিলাম। মা পরত। মায়ের কানে অনেকগুলো বিঁধ ছিল। এখন যেমন কায়দা মেরে সবাই কানে অনেকগুলো বিঁধোয়, তেমনি বড়মারও কানে ছেঁদা ছিল। আমার দিদারই তো ছিল আটটা ছেঁদা। ‘

আরও একটা নতুন গয়না আছে। অনেকদিন পর দেখলাম। সোনার তার। আগেকার দিনে চিক সবে উঠেছে। আর এই সোনার তার দেওয়া গলার হারকে বলা হয় তারাহার। মুখে আলপিনের মাথার মতো চ্যাপটা নকসা করা। তারটাকে ফাঁপিয়ে নকসা করে গয়নার চেহারা দেওয়া হত। মুখের কাছে জশমের মতো স্প্রিং দেওয়া থাকত। সোনার পাতলা একটি তারকে বিনিয়ে বিনিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হত। সেটাই গলায় চোখারের মত পরা হতত। আরও ছিল। বিছাহার, গোটহার… আরও অনেকরকমের।’ কাগজের বাণ্ডিলের একদিকে মোড়া অংশে উঁকি মারছে রতনচূর। বাঙালির বিয়েতে এখন খুব কম দেখা যায়। তবে পুরনো আমলের স্টাইল বলে, অনেকে পরতে চান না। জিনিসটা বেশ দামি। পাঁচটি আঙুলে পাঁচটি আঙটি। তাতে রয়েছে মুক্তো। বেশি বড় নয়, ছোটও নয়। সেই আঙটিগুলো পাঁচটি সোনার চেন দিয়ে মাঝখানে সোনার নকসা করা চাকতিতে যুক্ত করা। ‘বিয়ের সময় আমাকে দিয়েছিল মা। পরে আমিই রেখে আসি। মনেও ছিল না আমার। মা যত্ন করে রেখে দিয়েছে দেখছি। ‘

কাগজের বাণ্ডিলের ভিতর থেকে তখন গুপ্তধন বের হচ্ছে এক এক করে। এমন সোনার গয়না বাপের কালে দেখেননি মিন্টুর মা। খনি থেকে যেন এক একটি রত্ন বের হচ্ছে। উঁকি মেরে দেখতে হচ্ছে। আলমারির ভিতরের এক গোপন কুঠুরিতে এতবছর ধরে এই গুপ্তধন রেখে দিয়েছিলেন কীভাবে, সেটাও ভাবাচ্ছে তাঁকে। শাশুড়িমায়ের এই সুপ্ত ইতিহাস তো কখনও শোনেননি। পূর্ববঙ্গের তো লোক ছিলেন না কেউই। কলকাতায় ব্যবসা করতেন শাশুড়ির বাবা। সেই সূত্রেই পরিবারে রয়েছে ব্যবসার ধারা। তবে এখন সব বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। হঠাত মিন্টুর কথাতে সম্বিত ফিরল তাঁর। দেখল একে একে বের হচ্ছে নারকেলফুলের বাউটি, কানবালা। ঝুমকোও রয়েছে। আবার ঢেঁড়ি, তাসাও। সবকটি হালকা ভারী। সাবেককালের ‘কানবালা’ দেখে সত্যিই ভিমরি খেতে হয়। চামড়ের মত তেঁতুলের পাতা ঝুলছে যেন। রাজপুত ঘরানার ‘শিরোমণি’-ও একটি গয়না দেখা গেল। মিনটু লেহেঙ্গার সঙ্গে মাথার একটি সুন্দর অলঙ্কার কিনেছে। জাঙ্ক জুয়েলারি। কতকটা টায়রার মতো দেখতে। কিন্তু এতো পুরো সোনায় মোড়া। সিঁথিতে পরার ঝাপটা (টিকলির মতো দেখতে) দেখে মিন্টু পুরো লাফিয়ে উঠল।

বড়মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। ঠাকুমা, মা… সকলের চোখে জল। মিন্টুর গোটা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে চলেছেন বডমা। তিনিও কাঁদছেন। ঠোঁটের কাছে একটি দাঁত বেঁকে বেরিয়ে থাকে তাঁর। অলসভাবে মিন্টুর গালে, কপালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে মিন্টুকে আরও কাছে টেনে নিলেন। আধো গলায় মমতার সুরে, একগাল হেসে বলে উঠলেন, ‘এগুলো আমি তোর বিয়েতে পরব। রাগ করিস না বোন আমার। তারপর তুই নিস। শেষবারের মতো তোর বড়দার দেওয়া বিয়ের গয়নাগুলি পরি? তারপর তুই নিয়ে যাস।’ ঠাকুমার হাতটা চেপে ধরে বড়মা আরও একটু নেতানো সুরে বললেন, ‘তুই আমার যা করেছিস, আমি হলে করতুম না। তুই আমার বোনের বিয়েটা ভালো করে দিস, মা।’ ঠাকুমাও বাধ্য় মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দিল। মিন্টুর মা চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। শ্বাসকষ্টে আরও যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ল বাড়ির সবচেয়ে ‘বড়’ মানুষটি। রাত বাড়তেই শ্বাসকষ্ট যেন গিলে খেতে লাগল। ডাক্তার এসে কাছের নার্সিংহোমে ভরতি করতে বললেন। এমার্জেন্সি। রাজি হলেন না বড়মা। কোনও রকমে চ্য়াঙদোলা করে নার্সিংহোমে ভরতি করানো হল শেষ রাতে। পরিবারের সকলের ইচ্ছে ও প্রার্থনা, কোনও অঘটন যেন না ঘটে। মিন্টুর বিয়েটা যেন দেখে যেতে পারেন বড়মা।

 

Next Article