সায়ন্ত ভট্টাচার্য
প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরও গা শিউরে উঠছে। লিখতে গিয়ে ভাবছি, কীভাবে বেঁচে ফিরলাম। আর এই যে অক্ষত রয়েছি, এর জন্য কাকে ধন্যবাদ জানাব। খবর সংগ্রহ করাই পেশা। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে, চোখের সামনে এখনও প্রতি মুহূর্ত ভেসে উঠছে। গিয়েছিলাম ‘রাত দখল’ আন্দোলন কভার করতে। সেখানে গিয়ে যে এমন মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসতে হবে, তা ভাবিনি।
আরজি করে ‘তিলোত্তমা’-র নৃশংস পরিণতির প্রতিবাদে বুধবার ‘রাত দখলে’ নেমেছিলেন মহিলারা। কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়াই। তাঁদের সেই প্রতিবাদ আন্দোলন কভার করতেই রাত পৌনে এগারোটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম আরজি করে।
গত শুক্রবার থেকে আরজি করের উল্টোদিকে স্টেজ বেঁধে বিক্ষোভ চলছে বাম ছাত্র-যুব মহিলা সংগঠনগুলির। বুধবার রাতে তারা মশাল মিছিল করে। আরজি কর থেকে শ্যামবাজারের কিছুটা আগে পর্যন্ত তারা মিছিল করে যায়। আবার ফিরে আসে। তারপর মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ সেলিমরা বক্তব্য রাখেন। সেইসময় দেখা যায়, আরজি করের সামনে যে ব্রিজটা রয়েছে, সেখানে প্রায় হাজার তিনেক লোক জড়ো হয়েছে।
তারা ধীরে ধীরে আরজি করের দিকে এগিয়ে আসে। তা দেখে বাম নেতা-কর্মীরা বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করে নিজেদের আলাদা করে নিলেন। আর ওই ভিড় থেকে উই ওয়ান্ট জাস্টিস বলে চিৎকার শুরু হল। ভিড়ের মধ্য থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গালিগালাজও শুরু করে তারা। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি। এরপর যেটা দেখলাম, তার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলাম না।
পুলিশ ওই জনতার দিকে তেড়ে যেতেই তারা হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারপর শুরু হল সেই তাণ্ডব। এমারজেন্সি বিল্ডিংয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালাতে শুরু করে। অবাক হয়ে দেখলাম, অনেকের কাছে গ্যাস কাটারও রয়েছে। সেইসময় আমি ও আমার ক্যামেরাপার্সন অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়, সহকর্মী লিমা ও তাঁর ক্যামেরাপার্সন সমর দাস এমারজেন্সি বিল্ডিংয়ে ঢুকি। তাদের সেই তাণ্ডব দেখে অবাক হয়ে যাই। হাসপাতালে রাখা পুলিশের পোশাকও পোড়াতে দ্বিধাবোধ করেনি তারা।
সেই ছবি করতে প্রথমে বাধা দেয়নি তাণ্ডবকারীরা। যেই বুঝল যে আমরা সংবাদমাধ্যমের কর্মী, তখনই তেড়ে এল আমাদের দিকে। লাঠি দিয়ে আমায় আঘাত করে। ধাক্কাধাক্কি করে। পিঠে ঘুষি মারে। সমর ও অর্ঘ্যকে ধাক্কা দেয়। সমরের ক্যামেরার একটা অংশ ভেঙে দেয়। আমরা প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে দৌড়াই। লিমা ঢুকে পড়ে শৌচাগারে। আমি কোনও একটা রুমে ঢুকি। তবে ঠিক কোন রুমে ঢুকে পড়েছিলাম মনে নেই।
কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে আসি। ট্রমা কেয়ার সেন্টারের সামনে দাঁড়াই আমরা। সেইসময় আমার আর এক সহকর্মী রিমি ও তাঁর ক্যামেরাপার্সন মৃন্ময় চক্রবর্তী সেখানে। আর কোনও রিপোর্টার নেই। সেইসময় দেখি পুলিশ আমাদের পিছনে। এমনকি, এক পুলিশকর্মী আমার দুই মহিলা সহকর্মীকে বলেন, আপনারা আগে থাকুন। তাহলে ওরা আসবে না।
এর কিছুক্ষণ পর দেখি, পুলিশের গাড়ি উল্টে ভাঙচুর চালাচ্ছে তাণ্ডবকারীরা। আর সেই খবর করতে যেতেই…। হাতে রড নিয়ে তেড়ে আসছে কয়েকজন। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌড়ালাম। ট্রমা কেয়ারে ঢুকে পড়ে লিমা ও রিমি। আর আমি গিয়ে লুকোলাম একটা অন্ধকার ঘরে।
অন্ধকারে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ওটা মর্গ। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলাম। পরে দুর্গন্ধের জেরে বুঝলাম ওটা মর্গ। কিন্তু, সেইসময় আমার অন্য কিছু মাথায় নেই। মৃতদেহের মাঝে থাকা নিয়ে ভয় লাগছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, ওরা যদি আমায় খুঁজতে এখানে ঢুকে পড়ে। এক-এক মিনিট তখন যেন কয়েকঘণ্টা। একসময় মনে হল, ওরা চলে গিয়েছে। বেরিয়ে এলাম অন্ধকার ঘর থেকে। ঘড়ি দেখে বুঝলাম মিনিট ১৫-১৬ ছিলাম ওই ঘরে।
তারপর খবর পেলাম, লালবাজারের স্পেশাল ফোর্স আসছে। তারা এসে লাঠি চালিয়ে উন্মত্ত ওই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। তবে তারা আবার ফিরে আসে। আবার লাঠি চালানো শুরু হয়।
‘রাত দখলের’ খবর করতে গিয়েছিলাম। আর সেই খবর করতে গিয়ে যেখানে মৃতদেহ থাকে, সেখানে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, মর্গ ভয়ের জায়গা নয়। কখনও কখনও মানুষের প্রাণও বাঁচে মর্গে।
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)