কলকাতা: চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে জোট। বিভিন্ন রাজ্যে আসনরফা নিয়ে শরিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। একাধিক রাজ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই। লোকসভা ভোটের পর জোটের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন। এবার ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে চাপানউতোর। তৃণমূল চাইছে, ‘ইন্ডিয়া’-র নেতৃত্ব দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ইগো ছেড়ে জোটের শরিকদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া উচিত। সত্যিই কি তা হবে? গত কয়েকমাসে একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের পর কি ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেসের প্রভাব কমছে?
‘ইন্ডিয়া’-র আত্মপ্রকাশ-
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের তখনও কয়েকমাস বাকি। বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীরা একজোট হওয়ার চেষ্টা করছে। ২০২৩ সালের ২৩ জুন। জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে পটনায় মিলিত হন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। ১৬টি দল ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল। সেখানেই বিরোধী জোট গড়া নিয়ে আলোচনা করেন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। তবে তার আগে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিরোধী দলগুলিকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। ফাতেহাবাদে এক জনসভা থেকে তিনি কংগ্রেস-সহ সব বিরোধীদের একজোট হওয়ার আহ্বান জানান। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “বিরোধীরা একজোট হলেই বিজেপি হারবে।”
মাসখানেক পর বেঙ্গালুরুতে আবার বৈঠকে বসে বিরোধী দলগুলি। ১৭ এবং ১৮ জুলাই বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধী। দু’দিনের বৈঠকে বিরোধী জোট নিয়ে সম্মত হন নেতা-নেত্রীরা। আরও দশটি দল সেই জোটে যোগ দেয়। বেঙ্গালুরুর ওই বৈঠকের পরই বিরোধী জোটের নাম দেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স। ‘ইন্ডিয়া’। বেঙ্গালুরুর ওই বৈঠকের মাস দেড়েক পর ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা ফের বৈঠকে বসেন। এবার মুম্বইয়ে। ২০২৩ সালের ৩১ অগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর। দু’দিনের এই বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন উদ্ধব ঠাকরে।
মুম্বইয়ের সেই বৈঠকের প্রায় সাড়ে তিনমাস পর দিল্লিতে হয় ইন্ডিয়া জোটের চতুর্থ বৈঠক। ১৯ ডিসেম্বর সেই বৈঠকে আসনরফা, একসঙ্গে জনসভা-র মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ভার্চুয়ালি হয় পঞ্চম বৈঠক। সেই বৈঠকে একাধিক নেতা অংশ নেননি। ভার্চুয়ালি ওই বৈঠকের পর কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেকে ইন্ডিয়া জোটের চেয়ারপার্সন ঘোষণা করা হয়। নীতীশ কুমারকে জাতীয় আহ্বায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে এনডিএ-তে ফিরে যান নীতীশ। জোর ধাক্কা খায় ইন্ডিয়া জোট। কারণ, বিরোধী জোট তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন নীতীশ।
আসনরফা নিয়ে দ্বন্দ্ব-
বিরোধী জোট হলেও রাজ্যে রাজ্যে শরিকদের মধ্যে আসনরফা নিয়ে মতপার্থক্য শুরু হয়। ইন্ডিয়া জোটে থাকলে বিভিন্ন রাজ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরিকরা। বাংলাতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয় কংগ্রেস। আবার ইন্ডিয়া জোটের আর এক শরিক সিপিএম বাংলায় কংগ্রেসের হাত ধরে তৃণমূলকে আক্রমণ করে। সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতারা রাজ্যে তৃণমূলকে লাগাতার আক্রমণ শানাতে থাকে। অন্যদিকে, বাম-কংগ্রেসকে নিশানা করে তৃণমূল। সেইসময় এক নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ইন্ডিয়া নাম তাঁর দেওয়া।
ইন্ডিয়া জোটে প্রধানমন্ত্রী মুখ কে, তা নিয়ে খোঁচা দেয় বিজেপি। প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ইন্ডিয়া জোটের নেতা-নেত্রীরা লড়াই শুরু করেছেন বলে আক্রমণ করে। এমনকি, পদ্ম শিবির এই নিয়ে ব্যঙ্গ করে ভিডিয়োও বানায়।
লোকসভা নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া’-র ফল-
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২৩৪টি আসন পায় ইন্ডিয়া জোট। বিরোধী জোটে সবচেয়ে বেশি আসন পায় কংগ্রেস। ৯৯টি। তারপর অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি পায় ৩৭টি আসন। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি আসন পায়। তবে তৃণমূলের চেয়ে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি অনেক বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সরকার গঠন করতে না পারলে বিরোধী জোটের শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় উচ্ছ্বসিত হন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হন রাহুল গান্ধী।
লোকসভার পর ইন্ডিয়া জোটের অবস্থান
লোকসভা নির্বাচনের পর ইন্ডিয়া জোটে শরিকদের মতামতকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, জোটে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার মনোভাব দেখা যায় কংগ্রেসের মধ্যে। লোকসভার পর বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে আসনরফা নিয়ে শরিক দলগুলির মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। হরিয়ানায় আসনরফা নিয়ে আপের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত হরিয়ানায় একা লড়ে আপ। জম্মু ও কাশ্মীরেও কংগ্রেসের হাত না ধরে প্রার্থী দেয় অরবিন্দ কেজরীবালের দল।
হরিয়ানায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি কংগ্রেস। জম্মু ও কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে জোট করে তারা লড়েছিল। সেখানে সরকার গড়লেও কংগ্রেসের আসন কমেছে।
২ দিন আগে মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে। মহারাষ্ট্রে মুখ থুবড়ে পড়েছে কংগ্রেস। পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ও শরদ পাওয়ারের এনসিপির সঙ্গে জোট করে ভোটে লড়েছিল কংগ্রেস। সেখানে বাকি দুই শরিকের চেয়ে তারা বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এখানেও আসনরফা নিয়ে তিন দলের মধ্যে টানা আলোচনা হয়েছে। ঝাড়খণ্ডে জেএমএম-র সঙ্গে জোট করে ক্ষমতা দখল করেছে কংগ্রেস। তবে এই রাজ্যে জোটকে নেতৃত্ব দিয়েছে জেএমএম। সবমিলিয়ে লোকসভা ভোটের পর বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনে কংগ্রেসের ফল খারাপ হয়েছে। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ইন্ডিয়া জোটেও কংগ্রেসের প্রভাব ধীরে ধীরে কমছে।
এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইন্ডিয়া জোটের মুখ করার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মহারাষ্ট্রে যখন কংগ্রেস মুখ খুবড়ে পড়েছে, তখন বাংলায় ৬টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনে বিজেপিকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল। ৬টি আসনে তৃণমূলের জয়ের পর কল্যাণ বলছেন, “সারা ভারতব্যাপী কংগ্রেস পিছিয়ে পড়ছে। অন্যান্য বিরোধী দল পিছিয়ে পড়ছে। ইগো ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়া জোটের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে আনা উচিত। তাঁকে সামনে এনে লড়াই করা উচিত। যাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের স্বীকার করতে হবে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। হরিয়ানার পর মহারাষ্ট্রেও ব্যর্থ হয়েছেন। দ্বিধাহীন কণ্ঠে সমস্ত বিরোধীদের আপিল করব, ইগো ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেনে নিন নেত্রী হিসেবে। মেনে নিন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়া কিছু হবে না।”
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, লোকসভা ভোটের সময় জোট থাকলেও বিভিন্ন রাজ্যে সেই জোটের প্রভাব দেখা যায়নি। উল্টে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছে। লোকসভার পর ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা কতটা একজোট রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ইন্ডিয়া জোটের মুখ হিসেবে মমতাকে শরিকরা কতটা মেনে নেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, অখিলেশের যাদবের সমাজবাদী পার্টি কংগ্রেসের পরই জোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। হেমন্ত সোরেনের জেএমএম ঝাড়খণ্ডে ভাল ফল করেছে। সবমিলিয়ে ইন্ডিয়া জোটকে কে নেতৃত্ব দেবেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।