কলকাতা: স্কুলের চৌহদ্দির ভিতরে পড়ুয়ারা নিরাপদ। মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা রয়েছেন। কিন্তু স্কুলগেটের বাইরেও কি নিরাপদ? সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মনে। এই যেমন মাটিগাড়ায় এক কিশোরীকে স্কুল থেকে ফেরার পথে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গিয়ে খুনের অভিযোগ। জলপাইগুড়ির এক স্কুল পড়ুয়াকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ। এমনকী খাস কলকাতাতেও এক পড়ুয়াকে স্কুল ছুটির পর বাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ। একের পর এক ঘটনায় যখন উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মনে, ঠিক সেই সময়ে ভাইরাল এক অভিভাবিকার অডিয়ো ক্লিপ। স্কুল পড়ুয়াদের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে ওই অডিয়ো ক্লিপটি।
সম্প্রতি সল্টলেকের এক স্কুলের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এসেছে ওই অডিয়ো ক্লিপটি। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, স্কুলের বাইরে থেকে পরিবারের লোকজনের নাম করে পড়ুয়াদের অপহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাইরাল ওই অডিয়ো ক্লিপে এক অভিভাবিকা দাবি, তাঁর সন্তান স্কুল থেকে ফিরে তাঁকে জানিয়েছেন, স্কুলের গেটের বাইরে গলিতে মুখে মাস্ক পরা এক ব্যক্তি পড়ুয়ার হাত চেপে ধরেছিল। অজ্ঞাত পরিচয় ওই ব্যক্তি বলেছিল, ওই পড়ুয়ার দাদু খুব অসুস্থ এবং তাই পড়ুয়ার বাবা তাকে পাঠিয়েছে। কিন্তু, পড়ুয়া ওই ব্যক্তিকে জানায় তার জন্মের পাঁচ বছর পরেই দাদু মারা গিয়েছেন। কিন্তু এরপরও ওই ব্যক্তি জোরাজুরি করতে থাকে। তখন পড়ুয়া বলে, হাত না ছাড়লে চিৎকার করবে। আর এরপরই ওই ব্যক্তি সেখান থেকে পালিয়ে যায় বলে ভাইরাল অডিয়ো ক্লিপে দাবি করছেন ওই অভিভাবিকা।
যদিও ওই অডিয়ো ক্লিপটি কার, সেই বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। ওই অভিভাবিকা নিজের সন্তানের নামও বলছেন অডিয়ো ক্লিপে। কিন্তু ওই অভিভাবিকার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি এখনও। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের বাকি সদস্যরা বলছেন, সেটি ফরওয়ার্ডেড অডিয়ো ক্লিপ ছিল। তবে এই অডিয়ো ক্লিপ ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্ক ও উদ্বেগ দানা বেঁধেছে অভিভাবকদের মনে।
সল্টলেকের ওই স্কুলের অধ্যক্ষ পায়েল দাসও জানাচ্ছেন, যে অডিয়ো ক্লিপটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটির বিষয়ে কেউই স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না। বলছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অনেক সময় ভুয়ো খবরও ছড়িয়ে পড়ে। এটা কতটা সত্য, তা জানার জন্য প্রশাসন যেন বিষয়টি খতিয়ে দেখে। কারণ পড়ুয়াদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
একের পর এক ঘটনায় অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মনেও দানা বাঁধতে শুরু করেছে ছেলে-ধরা আতঙ্ক। শুধু কলকাতা বা সল্টলেকের মতো জায়গাতেই নয়, জেলাগুলিতেও ছড়িয়েছে আতঙ্ক। উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। বারাসতের একাধিক স্কুলে দেখা গেল শিক্ষক-শিক্ষিকারাই উদ্যোগী হয়ে সচেতনতার পাঠ দিচ্ছেন পড়ুয়াদের। বারাসত প্যারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়, বারাসত গার্লস হাইস্কুল-সহ একাধিক স্কুলে দেখা গেল এমন ছবি। পড়ুয়াদের বোঝানো হচ্ছে, যাতে এরকম কোনও ফাঁদে তারা পা না দেয়।
বারাসত প্যারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিকাশ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের সতর্ক করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতের সময়েও পড়ুয়াদের সচেতন করে দেওয়া হচ্ছে যাতে অচেনা-অজানা কারও সঙ্গে স্কুলের বাইরে না যায়। বারাসত গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা জবা সরকারও জানাচ্ছেন, সেখানেও গল্পের ছলে পড়ুয়াদের সচেতন করার চেষ্টা চলছে।
স্কুলগুলি পদক্ষেপ করছে বটে, তবে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মন থেকে দুশ্চিন্তা পুরোপুরি কাটছে না। কিন্তু স্কুলে তো পাঠাতেই হবে। ছেলে-মেয়েদের তো বাড়িতে বসিয়ে রাখলে চলবে না। অনেকেই তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করছেন। স্কুল ছুটির পর একেবারে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
একই ছবি উত্তরের জেলাগুলিতেও। শিলিগুড়ির কলেজপাড়া গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অত্যুহা বাগচীর গলাতেও উদ্বেগের সুর। স্কুল শুরুর সময় ও স্কুল ছুটির সময় ওই রাস্তায় কারা আসছে, কারা যাচ্ছে তার উপর পুলিশের নজরদারির প্রয়োজনের কথা বলছেন তিনি। বলছেন, ওই সময়ে স্কুল গেটের সামনের রাস্তায় এমন অনেক লোকজন ঢুকে যাচ্ছে যারা অভিভাবক-অভিভাবিকা নয়। একইসঙ্গে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। পাশাপাশি অভিভাবকরা যে টোটোয় বা পুলকারে করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, সেই পুলকার বা টোটোচালক কতটা বিশ্বস্ত তাও দেখা দরকার বলে মত প্রধান শিক্ষিকার।
তবে এই সব ঘটনার মধ্যেই পুলিশ প্রশাসনের তরফেও কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কলকাতার ঘটনায় যেমন পড়ুয়াকে বাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ পড়ুয়াকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। জলপাইগুড়ি পুলিশ জেলা থেকেও অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো তথ্য না ছড়িয়ে সেই বিষয়ে যাতে দ্রুত পুলিশকে জানানো হয়। গুজব না ছড়ানো ও আতঙ্কিত না হওয়ার জন্যও অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ।