কলকাতা : সমাজে মূলত রেড লাইট এরিয়া বা নিষিদ্ধ পল্লি হিসেবেই পরিচিত। অপেক্ষাকৃত কম আলো। গলিতে দাঁড়িয়ে সুগন্ধী ফুলের মালা বেঁধে ‘খদ্দেরের’ অপেক্ষায় কিছু ঝলমলে শরীর। নিছক একটা ব্যবসা বা পেশা মাত্র। ‘খদ্দের’ রয়েছে। রয়েছে পরিষেবা প্রদানকারীও। যৌনপেশা। কিন্তু আইনের চোখে স্বীকৃতি মেলেনি। এই ব্যবসার মাঝে পুলিশের চোখ রাঙানি তো থেকেই যায়। কেউ স্বেচ্ছায় এই পেশায় এলেও হেনস্থা করা হয় তাঁকেও। আন্দোলন হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই রীতির বিরুদ্ধে স্লোগানও উঠেছে। একজোট হয়ে সেই আন্দোলনে সুর মিলিয়েছেন শয়ে শয়ে যৌনকর্মী। নিজেদের অধিকার দাবি করে পথে নেমেছেন। অবশেষে আলোর মুখ দেখতে চলেছেন তাঁরা। বুধবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত যৌনপেশাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। আদালত জানিয়েছে, যৌনকর্মীদের হেনস্থা করতে পারবে না পুলিশ। উল্টে তাঁরা কোনও অভিযোগ নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হলে আর পাঁচটা নাগরিকের মতো তাঁদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে পুলিশকে। এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করতে হবে। সুপ্রিম সুপারিশের পর এই বিষয়ে দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করে টিভি৯ বাংলা।
সুপ্রিম কোর্টের এই সুপারিশে আশার আলো দেখছেন কলকাতার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। তাঁদের কথায়, যৌনপেশাকে কেন্দ্র পেশার স্বীকৃতি দিলে তাঁরা স্বাধীনভাবে এই কাজ করতে পারবেন। স্বেচ্ছায় কোনও সাবালিকা এই পেশায় আসলেও তাঁদের হেনস্থা করা হয়। যখন খুশি এই এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ যৌনকর্মী ও ‘খদ্দেরদের’ আটক করে বিভিন্ন উপায়ে তাঁদের উপর চাপ সৃ্ষ্টি করে। কিন্তু সুপ্রিম সুপারিশে এহেন পুলিশি অত্যাচার বন্ধ হতে পারে। সোনাগাছির প্রায় ৬৫ হাজার যৌনকর্মীকে নিয়ে একটি সমষ্টিগত দল হল দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি। এই সমিতির সভাপতি বিশাখা লস্কর জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের সকল যৌনকর্মী দিল্লিতে গিয়ে পার্লামেন্টের হিয়ারিং কমিটিতে তাঁদের দাবি ও আবেদন জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ, এই আন্দোলনের সূত্রপাত বহুদিন আগেই। তিনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই সুপারিশে খুশি তাঁরা। এতদিনের একটা লড়াই মান্যতা পেতে চলেছে। তাঁরা আশাবাদী যে, সুপ্রিম কোর্টের এই সুপারিশে সম্মতি জানাবে কেন্দ্র। তবে আইনি স্বীকৃতিতে সমাজ থেমে থাকে না। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে ৩৭৭ ধারা প্রত্যাহার। প্রায় চার বছর হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলের এই ধারা অবলুপ্ত হয়েছে। সমকামীদের ইচ্ছেকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে এদেশের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এই আইনি পদক্ষেপে সামাজিক পরিবর্তন আসেনি। এখনও অনেক জায়গায় সমকামীদের বিভেদমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। তাহলে যৌনপেশা আইনি স্বীকৃতি পেলেই সমাজে কী তাঁদের নিয়ে ধারণা বদলানো সম্ভব! এই প্রশ্নে ‘দুর্বার’-র সভাপতির অকপট উত্তর, “আমরা কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছিলাম সুপ্রিম কোর্ট যৌনপেশাকে আইনি স্বীকৃতি দিতে পারে। কিন্তু এরই সুপারিশ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। পট পরিবর্তন হবে। একদিনে হবে না। অনেকদিন লাগবে এই ভাবমূর্তি পরিবর্তনে।”
বিশাখা লস্কর আরও জানিয়েছেন, আগের থেকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলেছে। তাঁর কথায়, আগে পুলিশে কোনও অভিযোগ নিয়ে গেলে যেরকম তাচ্ছিল্য করা হত, তার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। আগামিদিনে যৌনপেশা আইনি স্বীকৃতি পেলে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশা দেখছেন এই পেশার কর্মীরা। তবে তাঁদের নতুন বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে সুপ্রিম সুপারিশে। সুপ্রিম কোর্ট সুপারিশ করেছে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক এই পেশায় নিজের ইচ্ছায় আসলে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করতে পারবে না। আদালত জানিয়েছে, স্বেচ্ছায় যৌনপেশা কোনও অপরাধ নয়। তবে যৌনপল্লি চালানো বেআইনি। বিশাখার কথায়, ‘যৌনপেশার জন্য পল্লি তো দরকার। তাই এই নিয়ে পরবর্তী আলোচনা করা হবে।’ আপাতত সোনাগাছিতে উদযাপনের আবির উড়ছে। সুপ্রিম সুপারিশে খুশি হয়ে বিভিন্ন রঙের আবিরে মেতেছেন তাঁরা। বলাই বাহুল্য, এটা তাঁদের কাছে একটা বড় জয় বা প্রাপ্তি।