কলকাতা: শেষ পর্যন্ত তাঁরা নামলেন। মান-অভিমান, গোঁসা-অপমান, সব অধ্যায়ে আপাতত ইতি। গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়ার দীর্ঘ ১৬ মাস পর এদিন প্রথমবার বিজেপির (BJP) কোনও কর্মসূচিতে যোগ দিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় (Sovan Chatterjee)। বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Baishakhi Banerjee) পাশে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার গোলপার্ক থেকে হুডখোলা জিপে উঠে বসলেন। বিজেপির মিছিল এগিয়ে চলল ঢাকুরিয়া ব্রিজের অভিমুখে। মিছিল যত এগিয়ে যেতে লাগল, ক্রমশ যেন এতদিনের আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করলেন শোভন। মুখে ফিরে এল চওড়া হাসি, পাশে থাকা বৈশাখীকেও দেখা গেল বেশ খুশি। মিছিল এসে থামল সেলিমপুরে। সেখানে সভামঞ্চে উঠেই সোজা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) নিশানায় নেওয়া শুরু করলেন জল শোভন।
ইদানীং তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করতে খুব একটা আক্রমণ করতে বিজেপি নেতাদের দেখা যায়নি। উল্টে অভিষেককেই নিশানায় নিয়ে থাকেন দিলীপ-মুকুলরা। কিন্তু এদিন মমতার একদা ‘কাননের’ লক্ষ্যে ছিলেন কেবলমাত্র একজন। তিনি খোদ মমতা। একের পর এক অভিযোগ তুলে বিদ্ধ করতে থাকেন প্রাক্তন দলনেত্রীকে। পাশাপাশি তাঁর নিশানায় ছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও।
২০১৮ সালে সুষ্ঠুভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন না হওয়া যে শাসকদলের ভাবমূর্তি জনমানসে আরও নেতিবাচক করে তুলেছিল, শোভনের কণ্ঠে এদিন সেই কথা উঠে এসেছে। পুরভোট না হওয়া নিয়েও তিনি কটাক্ষ করেছেন সরকারকে। তিনি বলেন, “১২০ টি পুরসভার ভোট হচ্ছে না। এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে ভোটই হচ্ছে না। পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে দেননি মমতা বন্দোপাধ্যায়। এটাই কি সোনার বাংলা তৈরি হয়েছে? আপনার কালীঘাটে শতরঞ্চির খোঁচা ধরে টেনেছে বিজেপি। ১৮ টি সিট নিয়ে গিয়েছে।” নাম না করে বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে তাঁর তোপ, “রাজ্যের এমন মন্ত্রী এসেছেন যে যিনি মানুষের কাছে যেতে পারছেন না। কেন যে মিনি পাকিস্তান গড়তে গিয়েছিলেন। এখন পাকিস্তান বিরোধী বলতে হচ্ছে।”
তাঁর দলত্যাগ এবং তৃণমূল ছাড়ার সময়কালীন ঘটনাপ্রবাহের কথাও এদিন বলতে শোনা গিয়েছে শোভনকে। অতীতের ঘটনা যে এখনও তাঁর মনে দাগ কেটে রয়েছে তা স্পষ্ট হয় বাচনভঙ্গিতেই। শোভন বলেন, “আমায় মন্ত্রিত্বের কথা বলছে। আমি ওরকম মন্ত্রিত্ব হাওয়াই চটির মত ফেলে আসতে পারি।”
আরও পড়ুন: সোমবার রাজপথে নামার আগেই শোভন বৈশাখীর পোস্টারে অশালীন চিরকূট!
তৃণমূল সুপ্রিমোকে তাঁর আরও তোপ, “যে পার্টির নামে কুৎসা করছেন, তাদের সঙ্গে নিয়েই ১৯৯৮ সালে সরকার গড়েছিলেন। আপনারা এতটাই প্রতি হিংসাপরায়ণ। তিনি কীভাবে ঢুকেছেন কোন কোন মন্ত্রিসভায়, তা আমি জানি। তদন্তে কেন সিবিআই-এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট সঙ্গে শামিল হচ্ছে না আপনি? আয়ুষ্মান ভারত আপনরা করতে দিচ্ছেন না? খুব খারাপ লাগল, ঘাসফুলের পতাকা লাগিয়ে স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে হাসপাতালগুলোকে লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। এটাই কি সোনার বাংলার অন্যতম উদাহরণ?”
শোভনের সভা শেষে পাল্টা মুখ খুলেছে তৃণমূলও। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “লজ্জা করে না শোভনের? এত বড় বড় কথা আসে কোথা থেকে? ২২ বছর ধরে যে মাতৃসম মানুষটার ছত্রচ্ছায়ায় থাকলি, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথাগুলো বলতে বুক কাঁপলো না? অন্য দলে গিয়েছিস বলে কি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়েছিস? এই দলের জন্যই শোভনের পরিচিতি। কে চিনত ওকে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি না প্রার্থী করত, নেতা করত কেউ ওকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না। আমার সম্পর্কে যা যা বলেছে, তা নিয়ে কী আর বলব। একদা ভাই ভাবতাম। সেটাই লজ্জা লাগে আমার।”
অন্যদিকে দমদমের সাংসদ সৌগত রায়কে বলতে শোনা যায়, “অনেক কিছু দিয়ে মমতা ওকে ভরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ওর আরও দাবি ছিল। পঞ্চায়েত ভোট করতে দেয়নি বলছে এখন ও। তখন তৃণমূলের সৈনিক ছিল। তখন প্রতিবাদ করেনি কেন? এখন নাটক করছে। আসলে টাকার লোভে শোভন গেরুয়া শিবিরে পা বাড়িয়েছে। একইসঙ্গে দলের কিছু দক্ষ নেতার উন্নতিতে ওর হিংসা হতো। তাই আর থাকতে না পেরে পদ্মফুলে নাম লিখিয়েছে।”
তৃণমূল কংগ্রেস গঠন হওয়ার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে যাদের আসা-যাওয়া ছিল, তাঁদের তালিকা তৈরি করলে প্রথম তিনেই নাম থাকত শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। স্নেহ ভরে মমতা তাঁকে ‘কানন’ বলে ডাকতেন। শোভন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরও তাঁদের সম্পর্ক যে শেষ হয়ে যায়নি, তা ২০১৯ সালের ভাইফোঁটার সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায়। কালীঘাটের বাড়িতে ভাইফোঁটা নিতে যান শোভন। কিন্তু তারপর থেকে সেই যে সম্পর্কের ভাঙন শুরু হয়েছে, তা সম্ভবত আজকের সভার পরই পূর্ণতা পেল।