Singur Movement: ন্যানোর স্বপ্নের বীজ বুনেও সিঙ্গুরকে ‘টা-টা’ রতনের, ফিরে দেখা আড়াই বছরের ঘটনার ঘনঘটা

Oct 11, 2024 | 10:15 AM

Singur Movement: মাত্র এক লাখ টাকায় গাড়ি। স্বপ্ন দেখেছিলেন রতন টাটা। আর বাংলায় তার বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু, আড়াই বছরের টানাপোড়েন শেষে বাংলা থেকে ন্যানোর কারখানা পাড়ি দিল গুজরাটে। এই আড়াই বছরে কী হয়েছিল? দেখে নিন একনজরে।

Singur Movement: ন্যানোর স্বপ্নের বীজ বুনেও সিঙ্গুরকে টা-টা রতনের, ফিরে দেখা আড়াই বছরের ঘটনার ঘনঘটা

Follow Us

মাত্র মাস দুয়েকের ব্যবধান। একজন না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন গত ৮ অগস্ট। অন্যজন ৯ অক্টোবর। সিঙ্গুরে এক লাখ টাকা দামের গাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। প্রথমজন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দ্বিতীয়জন শিল্পপতি রতন টাটা। বাংলায় টাটাদের ন্যানো গাড়ির স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ২০০৬ সালের প্রথম থেকে সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু, ২ বছরের টানাপোড়েন। দফায় দফায় বৈঠক। রাজ্যপালের মধ্যস্থতা। কোনও কিছুই কাজে আসেনি। আড়াই বছরের মাথায় রাজ্য থেকে ন্যানো গাড়ির প্রকল্প গুজরাটে সরিয়ে নিয়ে গেলেন রতন টাটা। ফিরে দেখা যাক আড়াই বছরের ইতিবৃত্ত।

দেশের মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে এক লাখ টাকা দামের গাড়ি পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন রতন টাটা। আর তাঁর সেই প্রকল্প বাংলায় আনার সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর মন্ত্রিসভার শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন কথা বলে রেখেছিলেন টাটাদের সঙ্গে।

বুদ্ধদেবের শপথের দিনই ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা-

২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের সরকার গঠন করল বামেরা। ১৮ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন বুদ্ধদেববাবু। ২০০৬ সালে বামেদের স্লোগান ছিল, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। বুদ্ধদেবের শপথের দিনই পাওয়া গেল তার ঝলক। টাটা সনসের তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটা ঘোষণা করলেন ন্যানো প্রকল্পের। জানালেন, হুগলির সিঙ্গুরে হবে ন্যানো প্রকল্প।

ন্যানো কারখানার জন্য কেন সিঙ্গুরকে বেছেছিল টাটা গোষ্ঠী?

কলকাতা থেকে সিঙ্গুরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিঙ্গুরকে ন্যানো কারখানার জন্য বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ এটা। গাড়ি তৈরির পর তা সহজেই কলকাতা আনা যাবে। এবং গ্রাহকদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। কারখানার কাঁচামাল আনার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত। কারখানার পাশেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। রয়েছে রেলস্টেশনও। ফলে সহজেই কাঁচামাল কারখানায় আনা যেত। বাংলায় শ্রমিকের সংখ্যাও পর্যাপ্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারেও ন্যানো গাড়ি রফতানির ক্ষেত্রে সুবিধা হত টাটাদের। কারণ, সিঙ্গুর থেকে সহজেই বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো যেত ন্যানো।

শুরুতেই বাধা, জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা-

টাটাদের ন্যানো প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হল সিঙ্গুরে। ৯৯৭.১১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হল। এক ফসলি জমি যেমন অধিগ্রহণ করা হল, তেমনি অধিগ্রহণ করা হল বহুফসলি জমি। আর এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেই শুরু হল বিরোধিতা। তৈরি হল কৃষিজমি রক্ষা কমিটি।

সিঙ্গুরের বিধায়ক তখন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই। তখন তিনি তৃণমূলে। তাঁর নেতৃত্বে টাটার ন্যানো প্রকল্পের জন্য জমি দিতে না চাওয়া অনিচ্ছুক কৃষকরা আন্দোলনে নামলেন। ক্রমশ জোরদার হতে থাকে আন্দোলন। ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে স্তব্ধ করে চলে প্রতিবাদ। বিডিও অফিস ঘেরাও করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে আন্দোলনকারীদের।

তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশন-

অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিতে হবে। এই দাবিতে অনড় ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৬ সালের ৪ ডিসেস্বর। ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাথে অনশন শুরু করলেন তিনি। টানা ২৫ দিন। তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেন। বিষয়টি দেখার জন্য বলেন। অনশন প্রত্যাহারের জন্য মমতাকে অনুরোধও করেন কালাম। রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে একটি ফ্যাক্স বার্তা পাঠান মনমোহন সিং। সেই বার্তা পাঠানো হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অবশেষে ২৬তম দিনে অনশন ভাঙেন তৃণমূল সুপ্রিমো।

অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে অনশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

জমি অধিগ্রহণ নিয়ে মামলা হাইকোর্টে-

সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে মামলা হল হাইকোর্টে। আন্দোলনের মাঝেও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে কিছু স্বস্তি পেল তৎকালীন বাম সরকার। হাইকোর্ট জানান, জমি অধিগ্রহণ করে ভুল করেনি রাজ্য সরকার। ২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয় হাইকোর্ট। তার কিছুদিন পরই, ১৫ ফেব্রুয়ারি টাটা গোষ্ঠী জানায়, অক্টোবরেই বাজারে আসবে ন্যানো গাড়ি। টাটার এই ঘোষণা শুনে অদৃষ্ট কি হেসেছিল? কে জানে। কিন্তু, অক্টোবরেই এল বড় ঘোষণা। তবে তা ন্যানো গাড়ির বাজারে আসা নিয়ে নয়।

অবস্থানে মমতা-

জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও বাড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৮ সালের ২৪ অগস্ট। সিঙ্গুরে নির্মীয়মাণ কারখানার বাইরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের একপাশে অবস্থানে বসলেন মমতা। টানা ১৬ দিন চলল সেই অবস্থান।

রাজ্যপালের মধ্যস্থতায় মমতা-বুদ্ধদেব বৈঠক-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের একপাশে অবস্থান করছেন। রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজভবনে বৈঠকে বসার জন্য মমতাকে রাজি করালেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। ৭ সেপ্টেম্বর। রাজভবনে মমতার সঙ্গে বৈঠক করলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু, কোনও সমাধান সূত্র বেরোল না।

বাংলাকে ‘টা-টা’ ন্যানোর-

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই সিঙ্গুরে কাজ থামিয়ে দেয় টাটা গোষ্ঠী। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ প্রশ্ন উঠছিল। অবশেষে ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর সাংবাদিক বৈঠকে রতন টাটা ঘোষণা করলেন, “চূড়ান্ত অসহযোগিতার মুখে কারখানা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।” দফায় দফায় বৈঠক, রাজ্যপালের মধ্যস্থতাতেও সমাধান না হওয়ায় একটা সময় পর কারখানা গড়ার আশা হারিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন যখন ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে, তখন রতন টাটা বলেছিলেন, “কপালে বন্দুক ঠেকালেও সিঙ্গুর ছেড়ে যাব না।” আর যাওয়ার সময় বলেছিলেন, “ট্রিগারটাই তো টিপে দিলেন।” আর দিন চারেক পর টাটা গোষ্ঠী জানিয়ে দেয়, গুজরাটের সানন্দে হবে ন্যানোর কারখানা।

Next Article