Israel and Lebanon Conflict: ইজরায়েল-লেবানন যেন শুন্ডী আর হাল্লা রাজা! গুপী-বাঘা নেই বলে যুদ্ধ যুদ্ধ ‘খেলছে’ সাত দশক ধরে?

Israel and Lebanon Conflict: সাত দশক আগে শত্রুতার সূত্রপাত। সেই শত্রুতা আজ 'বার্ধক্যে' পৌঁছে গেলেও তার তেজ কমেনি। লেবাননে হিজবুল্লা গোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলি শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে ইজরায়েল। চলছে গোলাবর্ষণ। বিমান হামলায় মৃত্যু হচ্ছে সাধারণ মানুষেরও। কেন এই লড়াই? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন।

Israel and Lebanon Conflict: ইজরায়েল-লেবানন যেন শুন্ডী আর হাল্লা রাজা! গুপী-বাঘা নেই বলে যুদ্ধ যুদ্ধ 'খেলছে' সাত দশক ধরে?
লড়াই থামবে কবে?
Follow Us:
| Updated on: Oct 07, 2024 | 3:11 PM

ঘুমোতে যাওয়ার সময় বোমার আওয়াজ। আবার বোমার আওয়াজেই ভাঙে ঘুম। বলছিলেন দক্ষিণ লেবাননের জাওতারের এক মহিলা। চোখে-মুখে কিছুটা আতঙ্ক। তাঁর বাড়ি সুরক্ষিত থাকবে তো? এই চিন্তাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওয়াফা ইসমাইল নামে বছর ষাটের ওই মহিলাকে। শুধু তিনি একা নন। তাঁর মতো হাজার হাজার সাধারণ নাগরিকের একই চিন্তা। দক্ষিণ লেবাননে লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। লক্ষ্য হিজবুল্লা ঘাঁটিগুলি। পশ্চিম এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ ইজরায়েল ও লেবানন। তাদের এই শত্রুতা দীর্ঘদিনের। আবার ইরানও ইজরায়েলের উপর হামলা শুরু করেছে। সবমিলিয়ে পশ্চিম এশিয়ার আকাশে বারুদের গন্ধ। ঘনিয়েছে যুদ্ধের মেঘ। কেন এই যুদ্ধ পরিস্থিতি? পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ফিরবে কীভাবে?

শত্রুতার সূত্রপাত-

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইজরায়েল নিজেদের স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ইজরায়েল স্বাধীন দেশ হওয়ার পর যেসব প্যালেস্তাইন উদ্বাস্তু সেখান থেকে বিতাড়িত হন, তাঁদেরই লেবাননে পাঠায় প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন(পিএলও)। লেবাননে জঙ্গি হিসেবে নিয়োগ করে। দুই দেশের শত্রুতা তখন থেকেই শুরু। ১৯৪৮ সালে আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধে আরব দেশগুলিকে সমর্থন জানিয়েছিল লেবানন। তবে লেবাননে প্রথমবার ইজরায়েল অভিযান চালায় ১৯৭৮ সালে। এর ৪ বছর পর ১৯৮২ সালে ফের লেবাননে হামলা চালায় ইজরায়েল।

শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ-

১৯৭৯ সালে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে মিশর। এই চুক্তির পর সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ফিরিয়ে দেয় ইজরায়েল। ১৯৯৩ সালে ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়াই রবীন এবং পিএলও নেতা আরাফত শান্তির লক্ষ্যে হাত মিলিয়েছিলেন। এক বছর পর জর্ডনের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ইজরায়েল। কিন্তু, ৬ বছর পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে আরাফত ও তৎকালীন ইজরায়েল প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাক বৈঠক করেন। কিন্তু, চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি হয়নি।

২০০২ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলির স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য আরব লীগ একটি প্রস্তাব দেয়। ১৯৬৭ সালে মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধের সময় ইজরায়েল যে এলাকাগুলি দখল করেছিল, তা ফিরিয়ে দিতে হবে আরব দেশগুলিকে। প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনে সম্মতি এবং প্যালেস্তাইনের উদ্বাস্তুদের জন্য ন্যায্য সমাধান। এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে একটি ইজরায়েলের একটি হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটায় হামাস। আত্মঘাতী ওই হামলায় ৩০ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। ১৪০ জন জখম হন। ওই হামলার পর আরব লীগের প্রস্তাব আর ইজরায়েলের কাছে রাখা হয়নি।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে নতুন লড়াই শুরু-

২০২৩ সালের অক্টোবরে প্যালেস্তাইনি গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংঘাত বাধে ইজরায়েলের। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা সীমান্তবর্তী ইজরায়েলি শহরগুলিতে হামলা চালায় হামাস। নৃশংসভাবে হত্যা ও বহু ইজরায়েলি ও বিদেশি নাগরিকদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। জানা গিয়েছে, হামাসের হামলায় ১২০০ জনের মৃত্যু হয়। আর তারা ২৫৩ জনকে অপহরণ করে। এরপরই গাজাতে হামলা চালায় ইজরায়েলি সেনা। গাজা প্রশাসনের বক্তব্য, ইজরায়েলের হামলায় ৪১ হাজারের বেশি প্যালেস্তাইনের নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। ইজরায়েলে হামলায় হামাসকে সাহায্য করেছিল হিজবুল্লা। সেজন্য লেবাননে হিজবুল্লার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামে ইজরায়েলি সেনা। সেই হামলা এখন আরও বেড়েছে।

ইজরায়েলি হামলায় মৃত্যু হিজবুল্লা প্রধানের-

কয়েকদিন আগে লেবাননে ইজরায়েলের হামলায় মৃত্যু হয়েছে হিজবুল্লা গোষ্ঠীর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহের। বেইরুটের দক্ষিণ শহরতলির এক ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হিজবুল্লা প্রধানের দেহ। কিন্তু, হিজবুল্লা প্রধানের মৃত্যুতে যে অভিযান থামছে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। নাসরাল্লাহের মৃত্যুর পরপরই হিজবুল্লার ঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইজরায়েল। সেই হামলায় বহু সাধারণ মানুষও মারা যায়। ইজরায়েলি সেনার হামলা বাড়ার পর যুদ্ধবিরতির জন্য ইজরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাটি। অন্যদিকে, লেবানন সীমান্তে প্রস্তুত ইজরায়েলি সেনার মনোবল বাড়িয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা একসঙ্গে জয় করব।” জওয়ানদের সঙ্গে দেখাও করেন তিনি।

ইরান আবার হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলে-

লেবাননে যখন হিজবুল্লা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়িয়েছে ইজরায়েলি সেনা, তখন ইজরায়েলে হামলা চালাল ইরান। অক্টোবরের শুরুতে জেরুজালেম, তেল আভিভ লক্ষ্য করে দফায় দফায় ব্যালেস্টিক মিসাইল ছোড়ে ইরান। প্রায় দুশোর কাছাকাছা মিসাইল ছুড়েছে তারা। তবে ইজরায়েলের অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমের দৌলতে আয়রন ডোম, অ্যারো সিস্টেম প্রায় ১৫০-র কাছাকাছি মিসাইল প্রতিহত করেছে। তবে কিছু মিসাইল সেই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে আছড়ে পড়ে। প্রায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ইরানের এই হামলার পরই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তাঁর হুঁশিয়ারি, “হামলা চালিয়ে ভুল করেছে ইরান। এর মূল্য চোকাতে হবে তেহরানকে।” ফলে পশ্চিম এশিয়ার আকাশে যুদ্ধ পরিস্থিতির আঁচ ক্রমশ বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেবানন ও ইজরায়েলের দ্বন্দ্ব নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী বলেন, “এটা আজকের সমস্যা নয়। সাত দশক আগের সমস্যা। ১৯৪৮ সালে যেদিন থেকে ইজরায়েল গঠিত হয়, সেদিন থেকে এই সমস্যা চলে আসছে। লেবাননে কিছু ইজরায়েলি বিরোধী গোষ্ঠী রয়েছে। লেবানন সরকার তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই মুহূর্তে লড়াই থামার কোনও লক্ষণ নেই। ইজরায়েলের বিরুদ্ধেও যেমন হামলা চলছে। ইজরায়েলও পাল্টা অভিযান চালাচ্ছে। সার্বিকভাবে সব দেশের মধ্যে শান্তিরক্ষার চুক্তি না হলে, এই যুদ্ধ থামবে না।”

পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। এই যুদ্ধের ফলে ইজরায়েল এবং লেবাননের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর কি কোনও প্রভাব পড়বে? তেমনটা মনে করছেন না অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী। তিনি বলেন, “এখানে ভারত কোনওভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ, ভারতের যা কূটনৈতিক অবস্থান, তাতে ইজরায়েল ও ইরান-দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক খারাপ হবে না।” দুই দেশের এই লড়াই প্রভাব কি পশ্চিম এশিয়ায় পড়বে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ১৯৪৮ সালে পশ্চিম এশিয়ায় এই দ্বন্দ্বের যা প্রভাব ছিল, এখনও তাই রয়েছে। নতুন করে খারাপ কোনও পরিস্থিতি হবে না।

ইজরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত লেবাননের বেইরুট

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গুপী গাইন বাঘা বাইনের শুন্ডী ও হাল্লা রাজার লড়াইয়ের কথা মনে পড়ে? সেখানেও প্রতিবেশী দুই দেশের লড়াই ছিল। শেষপর্যন্ত গুপী, বাঘার চেষ্টায় সেই লড়াই থামে। গুপীর গান আর বাঘার ঢোল শুনে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। আবার মণ্ডা, মিঠাই পেয়ে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধ থেমে যায়। আর বাস্তবে? লেবানন-ইজরায়েলের সাত দশকের দ্বন্দ্বের অবসান কোন পথে হবে? কোনও গুপী, বাঘার জাদু কাজ করবে? কারা অবতীর্ণ হবেন গুপী-বাঘার ভূমিকায়? নাকি ওয়াফাদের ঘুমোতে যেতে হবে বোমার আওয়াজ শুনে? ঘুমও কি ভাঙবে বোমার শব্দে? উত্তর লুকিয়ে শুধু ভবিষ্যতের গর্ভে।