কমলেশ চৌধুরী
কলকাতা: জ্যৈষ্ঠে অন্তহীন জ্বলুনি! অন্তত ১০ জুন পর্যন্ত তাপপ্রবাহের সতর্কতা বাংলায় (West Bengal)। শুধু রাঢ়বঙ্গ নয়, ৪ দিন তাপপ্রবাহে (Heat wave) পুড়তে পারে ১৪ জেলা। এই তালিকায় রয়েছে উত্তরবঙ্গের (North Bengal) তিন জেলাও। বাকি জেলাতেও তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি। মানে গনগনে রোদের আঁচ, সঙ্গে প্যাচপেচে গরমের অস্বস্তি। পরিত্রাতা হতে পারত বর্ষা। অথচ, সে নিজেই ছন্দে নেই। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট, এ বার বাংলায় দেরিতে আসবে বর্ষা (Monsoon)। কারণ, গোড়াতেই গলদ। গোড়াতেই ‘লেট’।
বর্ষার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ১ জুন কেরলে ঢুকে পড়ে মৌসুমি বায়ু। এ বার মৌসম ভবন জানিয়েছিল, একটু দেরি হবে। বলা হয়েছিল, কেরলে বর্ষার যাত্রা শুরু হবে ৪ জুন। কিন্তু কোথায় কী! জুনের ৬ দিন পেরিয়ে গেলেও, বর্ষার বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই পশ্চিম উপকূলে। মৌসম ভবন বলছে, পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূল হতে, আরও অন্তত ১-২ দিন লেগে যেতে পারে।
কেন কেরলে ‘লেট’ বর্ষা?
কারণ, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল। সঙ্গে বিপদ আরব সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ। এমনিতে নিম্নচাপ বর্ষার হাত শক্ত করে। তাহলে নতুন নিম্নচাপ খলনায়ক হয়ে উঠছে কেন? নয়াদিল্লি মৌসম ভবনের আবহবিদ রাজেন্দ্র জেনামনি বলছেন, ‘‘নিম্নচাপের অবস্থান কেরলে বর্ষার পক্ষে সহায়ক নয়। যে নিম্নচাপ রয়েছে, সেটি পূর্ব-মধ্য আরব সাগরে পৌঁছে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে। তার পর উত্তর অভিমুখে এগোবে। ফলে নিম্নচাপ নিজের দিকে হাওয়া টেনে নেওয়ায়, কেরল উপকূলে মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যাবে। তাই বর্ষার বৃষ্টি শুরু হতে হতে আরও সময় লাগবে।’’ শুধু তাই নয়, কেরলে বর্ষা পৌঁছনোর পর দুর্বল থাকারও জোর সম্ভাবনা।
বাংলায় সাধারণত বর্ষা ঢোকে ৭ জুন। তবে শুধু উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায়। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার যাত্রা শুরু হয় ১০ জুন। কলকাতায় ১২ জুন। এ বার কী হতে পারে? কেরলে দেরি হলে বাংলায় কতটা দেরি হতে পারে? চোখ রাখা যেতে পারে পুরোনো একটি উদাহরণে। ২০১৯ সালেও শুরুতে ঝিমিয়ে ছিল বর্ষা, কেরলে পৌঁছয় ৮ জুন। সেবার কলকাতায় বর্ষা ঢোকে ১৬ জুন। গোটা বাংলা মুড়তে মুড়তে ২২ জুন লেগে যায়। আর একটু হলেই, সর্বকালীন রেকর্ড ভাঙতে বসেছিল!
তবে একেবারে পাটিগণিতের অঙ্ক মেনে কেরলে ৭ দিন দেরি হলে, বাংলাতেও ৭ দিনই দেরি হবে, এমন নয়। বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বাতাসের প্রবাহ কতটা শক্তিশালী হবে, বাংলার ভাগ্য নির্ভর করবে তার উপরেই। যদিও এক্ষেত্রেও বাংলার বরাত সুপ্রসন্ন নয়। কারণ, আরব সাগরের মতো আপাতত বঙ্গোপসাগরেও ‘বোতলবন্দি’ বর্ষা। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ”প্রথমত আরব সাগরে শক্তিশালী নিম্নচাপ থাকলে, বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বাতাস সবল হতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, যেটুকু মৌসুমি বাতাসের প্রবাহ আসছে, সেটাও মায়ানমার লাগোয়া বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণাবর্ত থাকায়, ওই দিকেই বইছে। আন্দামান-নিকোবরে ভারী বৃষ্টিও হচ্ছে। এই ঘূর্ণাবর্ত যত দিন থাকবে, তত দিন উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষা ঢোকার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে না। আর উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষা এলে তবেই বাংলা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।” পরিস্থিতি আরও জটিল হবে, যদি আরব সাগরের নিম্নচাপ শেষমেশ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় এবং ভারতীয় উপকূল ছেড়ে ওমানের দিকে এগোয়। তাহলে আরও বড় ‘বিপর্যয়’-এর মুখে পড়তে পারে বর্ষা!
আপাতত বাংলার এমনই মন্দ কপাল, বর্ষা তো দূর, প্রাক-বর্ষার বৃষ্টিরও তেমন আশা নেই। এই সময় ঝাড়খণ্ডে একটি ঘূর্ণাবর্ত বা বঙ্গোপসাগর উপকূলে উচ্চচাপ বলয় থাকলে নিয়মিত ঝড়-বৃষ্টি হতে পারত। গরমও কমত। কিন্তু সেই সাময়িক রেহাই থেকেও বঞ্চিত বাংলা। নিটফল, হয় তাপপ্রবাহ, নয় ভ্যাপসা গরম। জ্যৈষ্ঠে জব্দ বাংলা!