কলকাতা: কলকাতায় কি কোনওকালেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ত না? আলবাত পড়ত। এই যেমন ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে আলিপুরের তাপমাত্রা ৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। কিংবা ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বা ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৭.২ ডিগ্রিতেও নেমেছিল তাপমাত্রা। ভাবছেন, শুধু মান্ধাতা আমলের তথ্য দিচ্ছি? এই তো বছর দশেক আগে, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৯ ডিগ্রির ঠান্ডা-প্রাপ্তি হয়েছে মহানগরের। তার আগের বছর ডিসেম্বরেও ১০ ডিগ্রিতে নেমেছে পারদ। সেই শেষ। এখন কলকাতার শীত আর ব্রাজিল যেন সমার্থক! পারফরম্যান্স দেখতে হলে অতীতেই তাকাতে হবে! পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এখন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে পাঁচ নম্বরে। বিশ্বকাপের মূলপর্বে ওঠার লড়াইয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল ৬ নম্বরে। নেইমারদের আগে কখনও বিশ্বকাপে চান্স না পাওয়া ভেনেজুয়েলাও! ব্রাজিল আমেরিকায় খেলতে পারবে কী, পারবে না, সময় বলবে। কিন্তু শীত যে এ বার অতীতের ‘খেলা’ দেখাতে পারবে না, তা সোজাসুজি বলে দিল আবহাওয়া দফতর।
নভেম্বরেই অবশ্য দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের হিসেব, এ বার ২২ বছরের ‘উষ্ণতম’ নভেম্বর কাটিয়েছে কলকাতা। ১৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নামেনি তাপমাত্রা। ডিসেম্বরের প্রথম সাত দিনেও ঠান্ডা পড়ার আশা নেই। আপাতত তাপমাত্রা স্বাভাবিকের উপরেই থাকবে। মৌসম ভবন বলছে, এই ট্রেন্ড বজায় থাকবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্তই। অর্থাত্, গোটা শীতের মরসুম ধরেই। শুধু কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গ নয়, প্রায় গোটা দেশেই শীতকালে খোদ শীত কাবু থাকার সম্ভাবনা।
শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যত স্বাভাবিকের নীচে নামে, তত ঠান্ডার কামড় বাড়ে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের পাঁচ ডিগ্রি নীচে নামলে শৈত্যপ্রবাহ বলে আবহাওয়া দফতর। মৌসম ভবনের পূর্বাভাস, এ বার সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় স্বাভাবিকের বেশি থাকবে। শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনাও তুলনায় কম।
তবে কি শীত একেবারেই পড়বে না?
না, তা নয়। শীত পড়বে, তবে হালকা। মৌসম ভবনের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল, পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের ব্যাখ্যা, ‘যত সময় যাবে, স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমবে, ফলে তাল মিলিয়ে পারদপতন হবে। কয়েকদিন স্বাভাবিকের নীচেও যেতে পারে। কিন্তু সেই দিনের সংখ্যা কম হবে। সার্বিক ভাবে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকার সম্ভাবনাই বেশি।’ অর্থাত্, একটানা ঠান্ডা থাকবে না। ফলে জাঁকিয়ে ঠান্ডার আশাও নেই।
কেন জমিয়ে শীতের সম্ভাবনা নেই? খলনায়ক কারা?
মৌসম ভবনের ডিরেক্টর জেনারেল মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র বলছেন, ‘বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এল নিনো থাকলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমতে পারে না। এর সঙ্গে বেশ কিছু আঞ্চলিক কারণও রয়েছে।’ যেমন, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা, দক্ষিণ ভারতের বর্ষা, বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কথায়, ‘পশ্চিমী ঝঞ্ঝা এলে তুষারপাত হয়, তার পর সমতলে ঠান্ডা নামে। কিন্তু তাপমাত্রা নামার জন্য দুটো ঝঞ্ঝার মধ্যে সময়ের ফারাকও থাকতে হয়। এ বার সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাছাড়া বেশ কিছু ঝঞ্ঝা বেশি শক্তিশালী হতে পারে।’
সেক্ষেত্রে কী হবে? আবহবিদ অক্ষয় দেওরাসের মন্তব্য, ‘পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বেশি শক্তিশালী হলে উত্তর ভারত, মধ্য ভারত জুড়ে আকাশ মেঘলা হয়ে যায়, বৃষ্টি নামে। তখন ঠান্ডা, শুকনো বাতাসের জোগান কমে যায়। এ বার এই বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।’
এর সঙ্গে বিপদ বঙ্গোপসাগরের বাধা। দক্ষিণ ভারতের বর্ষা অতিসক্রিয় থাকার সম্ভাবনা। ফলে বারবার পুবালি হাওয়া শুকনো বাতাসের সামনে বাধার পাঁচিল তুলে দিতে পারে। বিপত্তি ঘূর্ণিঝড়েও। মিগজাউম সরাসরি বাংলায় হয়তো আসবে না। কিন্তু অন্ধ্র উপকূলে আছড়ে পড়ার পর বাঁক নিতে পারে। ফলে দক্ষিণবঙ্গের আকাশে মেঘ ঢুকবে, তাপমাত্রা কমবে না। সবমিলিয়ে শুকনো বাতাসের পরিবর্তে জলীয় বাষ্পের প্রাচুর্যই কাল হয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, ২০২৩ সালই পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হতে চলেছে। ভাঙতে চলেছে ২০১৬, ২০২০ সালের রেকর্ড। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বাংলাও। শীতের পূর্বাভাসে সেটাই যেন মনে করিয়ে দিল মৌসম ভবন। গরমে পুড়িয়ে মারছে বিশ্ব উষ্ণায়ন, তাই বলে শীতের সুখটুকুও কেড়ে নেবে? উদ্বেগের কথা বলছেন সঞ্জীববাবু , ‘জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে দিনের তাপমাত্রার চেয়েও, রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি।’ দিনে দিনে কি হারানোর খাতার চলে যাবে ‘লেপের ওম’?