‘বন্দে ভারত’ গতিতে বিচার চায় তিলোত্তমা! সম্ভব? জেনে নিন, কত জোরে ‘ছোটে’ বাংলার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট?

Sep 20, 2024 | 7:39 PM

Fast Track Court: ভারতের একাদশতম অর্থ কমিশন ১৭৩৪টি অতিরিক্ত আদালত গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই মতো তৈরিও হয় একাধিক কোর্ট। এই কোর্টে মূলত মহিলাদের আক্রান্ত বা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, শিশুদের হেনস্থা করার ঘটনার মতো জঘন্য অপরাধের বিচার হয়। বিশেষ করে পক্সো (POCSO) আইনে হওয়া মামলার ক্ষেত্রে যাতে অতি দ্রুত শুনানি হয় সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছিল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে।

বন্দে ভারত গতিতে বিচার চায় তিলোত্তমা! সম্ভব? জেনে নিন, কত জোরে ছোটে  বাংলার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট?
Image Credit source: GFX- TV9 Bangla

Follow Us

বছর তিনেক আগের একটি ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা অসমকে। পরীক্ষা দিয়ে এক কলেজ ছাত্রী বাড়ি ফিরছিলেন। ফাঁকা রাস্তায় হামলা চালায় প্রেমিক রিন্টু শর্মা। গোটা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন ওই ছাত্রী। তিন দিন ধরে চলে যমে-মানুষে লড়াই। তারপর মৃত্যু। ২০২১ সালের ২৫ অগস্টের ঘটনা। তিন বছর পর সেই অগস্ট মাসেই আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার ঘিরে তোলপাড় হয়ে গেল গোটা দেশ। অসমের ওই ঘটনায় ঠিক এভাবেই গোটা রাজ্যের মানুষ রাজপথে নেমেছিল। অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে দিনের পর দিন চলেছিল বিক্ষোভ-অবস্থান। কিন্তু সেই কলেজ ছাত্রী নন্দিতা এখনও বিচার পাননি। তাঁর হত্যাকারীর কোনও শাস্তি হয়নি এখনও। মামলা চলছে ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে। তারপরও কেন অভিযুক্তের কোন শাস্তি হচ্ছে না?

সম্প্রতি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা আইনি প্রক্রিয়ার এই ধীরগতি নিয়ে কথা বলেছেন। মাত্র ৩৬ দিনের মধ্যে ওই ঘটনায় ৪০০ পাতার চার্জশিট তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও এখন বিচার আটকে। এমন হাজার হাজার নন্দিতা-তিলোত্তমা রয়েছেন বিচারের অপেক্ষায়।

‘রায় কবে হবে?’

সম্প্রতি কলকাতার আরজি করের খুন ও ধর্ষণের মামলাতেও দ্রুত বিচারের দাবি উঠেছে। এক মাসের বেশি সময় কেটে যাওয়ার পরও প্রায় প্রতিনিয়ত রাস্তায় নেমে বিচার চাইছেন সাধারণ মানুষ। কবে রায় দেবে আদালত, সেদিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। এমনকী সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে খোদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়কেও। জানা যায়, সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে এক জনপ্রিয় গায়িকা প্রধান বিচারপতিকে প্রশ্ন করেছেন ‘রায় কবে হবে?’ প্রধান বিচারপতি তাঁকে কী উত্তর দিয়েছেন তা জানা যায়নি তবে, বিচার কি আদৌ এত দ্রুত হওয়া সম্ভব?

ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট কেন? কী কাজ?

ভারতের মতো দেশে বিচার ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত পরিকাঠামো, বিচারক এবং বিচারপতি থাকা সত্ত্বেও দ্রুত বিচার হওয়া সত্যিই বেশ কঠিন। ভারতের জনসংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে মামলা মোকদ্দমার সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি। যে কোনও আদালতে ন্যূনতম দু থেকে তিন বছরের আগে কোনও মামলার সমাধান হয় না বললেই চলে। কোনও কোনও মামলায় ১০ থেকে ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়।

এমন কিছু স্পর্শকাতর মামলা থাকে যেখানে, এত বেশি সময় লাগার কারণে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মামলাকারী বা অভিযোগকারীরা। যখন মামলার নিষ্পত্তি হয়, ততদিনে মামলার তাৎপর্যই হয়ত চলে গিয়েছে। ধরা যাক, আর্থিক দুর্নীতি বা তছরূপের মামলা। মামলাকারী হয়ত প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। তারপরও যদি তাঁকে বছরের পর বছর মামলা লড়তে হয়, তাহলে তো তাঁর পক্ষে জীবন ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে।

আবার ধরা যাক কোনও মহিলা বা শিশুর সঙ্গে ভয়ঙ্কর কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে, বিচারে দেরী হলে সেই নির্যাতিতাকে দেখতে হয়, দিনের পর দিন অভিযুক্ত কোনও শাস্তি ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই ভারতের একাদশতম অর্থ কমিশন ১৭৩৪টি অতিরিক্ত আদালত গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই মতো তৈরিও হয় একাধিক কোর্ট। এই কোর্টে মূলত মহিলাদের আক্রান্ত বা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, শিশুদের হেনস্থা করার ঘটনার মতো জঘন্য অপরাধের বিচার হয়। বিশেষ করে পক্সো (POCSO) আইনে হওয়া মামলার ক্ষেত্রে যাতে অতি দ্রুত শুনানি হয় সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছিল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে।

আদতে কতটা দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে?

বিচার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার জন্যই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, দেখা গেল, সেখানেও মামলার পাহাড়। এত মামলা জমা হয়েছে, যার ফলে দ্রুত বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই জানাচ্ছেন আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা। আইনজীবী বলছেন, “কোন মামলা ফাস্ট ট্র্যাকে বিচার হওয়া জরুরি, কোন মামলা অন্য আদালতে বিচার হলেও চলবে, তা ভাগ করার কোনও সিস্টেম করা হয়নি। ফলে একটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারককেও দিনে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি মামলা শুনতে হয়, এটা মুখের কথা নয়।” তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট আছে, তার তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। তিনি আরও জানান, মূলত মহিলাদের ও শিশুদের ক্ষেত্রে হওয়া অপরাধে দ্রুত বিচারের জন্যই এই কোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর কোনও বাছবিচার নেই। সব রকমের মামলাই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে চলে যায়।

কীভাবে মামলা স্থানান্তরিত হয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে?

ধরে নেওয়া যাক জেলা আদালতে কোনও মামলা চলছে। বিচারক যদি মনে করেন, ওই মামলার গুরুত্ব বেশি, দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন, তাহলে তিনি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলাটি পাঠিয়ে দেন। আইনজীবী জানাচ্ছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে, সব রকমের মামলা চলে যাচ্ছে, ফলে আদতে যেগুলি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে না।

আদতে অন্যান্য আদালত ও ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচারের প্রক্রিয়া একই। কিন্তু ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যেহেতু বাছাই করা মামলাই যায়, তাই দ্রুত বিচারের একটা আশা থাকে।

আরজি কর মামলার ক্ষেত্রে যখন বারবার দ্রুত বিচারের আর্জি জানানো হচ্ছে, তখন আইনজীবী বলছেন, “বিচার প্রক্রিয়া তো শুরুই হয়নি এখনও।” তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ বলছেন ঠিকই। তবে এটা বুঝতে হবে যে, এখনও চার্জশিটই ফাইল হয়নি। চার্জশিট ফাইল হবে, তারপর কোর্ট এটা সেশন কোর্টে পাঠাবে। সেখান থেকে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে পাঠানো হবে, তারপর হবে বিচার। পুরো প্রক্রিয়ার এখনও অনেক বাকি।”

আদৌ দ্রুত বিচার হয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে?

ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য বলছে, অন্যান্য আদালতের থেকেও বেশি সময় লেগে যেতে পারে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। দেশ জুড়ে চিত্রটা এমনই। ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের সবকটি কোর্টে মোট ২৮০০০ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তার মধ্যে ২২ শতাংশ মামলাতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। ৪২ শতাংশ মামলায় সময় লেগেছিল তিন বছরেরও বেশি। ১৭ শতাংশ মামলায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। অর্থাৎ কোনও কোনও ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তি হতে অন্যান্য আদালতের থেকেও বেশি সময় লেগে যায়।

এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিহারে একটি সমীক্ষায় উঠে আসে, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে তিনটি মামলার মধ্যে একটির নিষ্পত্তি হতে সময় লেগে যায় ১০ বছরের বেশি। তেলঙ্গনাতেও একই চিত্র। অন্তত ১২ শতাংশ মামলায় ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে ট্রায়ালে।

যদি ছোট রাজ্যগুলোর দিকে দেখা যায়, তাহলে সেখানেও দেখা যাবে একই ছবি। মেঘালয়ে দেখা যায়, ১৮টি মামলার মধ্যে ১০টির ক্ষেত্রেই এক দশক সময় লেগে গিয়েছে। নাগাল্যান্ডে ১৭টি মামলার মধ্যে ৮টিতেই একই ছবি দেখা গিয়েছে। কেন লাগে এত সময়? আইনজীবী মহলের বক্তব্য, বেশির ভাগ মামলায় ঠিক সময়ে আদালতে হাজির হন না সাক্ষী। আইনজীবীদের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে তৎপরতা কম থাকে। ফলে বিচারক মামলা শুনলেও বিচার এগোয় না।

পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা ঠিক কী?

আরজি করের ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গে চলা মামলাগুলি নিয়ে যে ছবি সামনে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়ে ও কঠোর আইন আনার আর্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারই প্রত্যুত্তরে কেন্দ্র জানায়, পশ্চিমবঙ্গে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের অনুমোদন দেওয়া সত্ত্বেও সব কোর্ট চালু হয়নি। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ ও পকসো মিলিয়ে ৪৮,৬০০ মামলা ঝুলে আছে বলেও জানান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে রাজ্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের স্কিমে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে রাজ্যকে ১৭টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্য তার মধ্যে মাত্র ৬টি চালু করে। কেন্দ্রের এই অভিযোগের আর কোনও উত্তর দেয়নি রাজ্য তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

অপরাজিতা বিলে ২১ দিনে বিচারের কথা বলা হয়েছে, আদৌ সম্ভব?

আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা বলছেন, “একেবারে যে সম্ভব নয়, তা বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে অনেকের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বিচারক, দুই পক্ষের আইনজীবী থেকে শুরু করে আদালতের কর্মীদের ওপর।” তিনি ব্যাখ্যা করে বলছেন, অনেক সময় এক পক্ষ সাক্ষীদের বয়ান নিলেও ক্রস করার জন্য সময় নেন বিপক্ষের আইজীবী। ফলে বিচার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়। অর্থাৎ সবার সদিচ্ছা থাকলে ২১ দিনেই মামলার নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব বলেই উল্লেখ করেছেন তিনি।

ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বাইরে কত সময় লাগে একটি মামলায়?

আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা জানিয়েছেন, মূলত কতজন সাক্ষী আছে, তার ওপর নির্ভর করবে। ধরা যাক ৯০ জন সাক্ষী আছেন কোনও মামলায়। তাঁদের প্রশ্ন করা হয়, ক্রস চেক করা হয়। ফলে সাক্ষ্যগ্রহণ করতে করতেই কেটে যেতে পারে ন্যূনতম তিন বছর।

জেলা আদালত বা অন্যান্য আদালতে বিচারের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় বলেই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মমালা স্থানান্তরিত করা হয়। তবে সে ক্ষেত্রে আদৌ কি দ্রুত বিচার সম্ভব? প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

Next Article