কলকাতা: দেশের মধ্যে বাংলাতেই প্রথম। আর এই প্রথম হতে চলার কৃতিত্ব কার? শুরু হয়েছে তরজা। একইসঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থানের আশাও। ভারতে প্রথম সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট হবে বাংলায়। আমেরিকা সফরে জো বাইডেনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের পর এই ঘোষণা করেছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। বাংলায় শিল্প নেই বলে বারবার শাসকদলকে নিশানা করে বিরোধীরা। সেখানে এই ঘোষণায় বাংলায় শিল্পের অগ্রগতির নতুন দিক কি উন্মোচিত হল? কী এই সেমিকন্ডাক্টর? কতটা কর্মসংস্থানের আশা এই প্ল্যান্টকে ঘিরে?
কয়েকদিন আগে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। তার পরই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে ঘোষণা করা হয়, কলকাতায় সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট গড়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুই রাষ্ট্রনেতার। বিনিয়োগকারী হিসেবে নাম উঠে আসে দুনিয়ার অন্যতম নামী সংস্থা গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ়ের।
সেমিকন্ডাক্টর কী?
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তথা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনের অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত বলেন, সেমিকন্ডাক্টর হল অর্ধ পরিবাহী। পৃথিবীর যত বস্তু রয়েছে, তারা তিন ধরনের হয়। হয় বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে পারে। যেমন তামা, অ্যালুমিনিয়াম। আবার কিছু বস্তু বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে পারে না। যেমন ইট, কাঠ। এদের মাঝামাঝি যারা, তারা অর্ধ পরিবাহী। সাধারণ অবস্থায় তাদের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ তেমনভাবে পরিবহণ হয় না। কিন্তু, তাপ দিয়ে কিংবা অন্য কোনও পদ্ধতিতে ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হলে, তার মধ্য দিয়ে বিদ্য়ুৎ পরিবহণ বেড়ে যায়।
সেমিকন্ডাক্টরই শিল্পের ভবিষ্যৎ-
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ভাস্কর গুপ্ত বলেন, যে শিল্পই দেখা হোক না কেন, তা সে গাড়ি শিল্প হোক, মোবাইল শিল্প হোক কিংবা কম্পিউটার শিল্প। সবাইকে চালাতে প্রয়োজন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট চিপ। আর এই চিপ তৈরির ক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হল সেমিকন্ডাক্টর। ফলে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প না হলে দেশের অগ্রগতি একটা জায়গায় আটকে যাবে।
বাংলায় সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টে কর্মসংস্থান-
রাজ্যে সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট হলে অনেক কর্মসংস্থান হবে বলে আশাবাদী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টে কাজের জন্য বাংলায় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, “রাজ্যে এখন অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। যেখানে ইলেকট্রনিক্স পড়ানো হয়। এছাড়া যাঁরা বিএসসি-এমএসসি ইলেকট্রনিক্স পড়েছেন, তাঁরাও সুযোগ পেতে পারেন।” ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করা পড়ুয়ারাও সুযোগ পেতে পারেন। একইসঙ্গে তিনি বলেন, “এরকম প্ল্যান্ট ভারতে কোথাও হয়নি। বাংলায় তা প্রথম হওয়ায় বিষয়টি খুবই আনন্দের।”
কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক তরজা-
বাংলায় সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট আনার কৃতিত্ব কার? শুরু হয়েছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। শাসকদলের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টাতেই এই প্ল্যান্ট বাংলায় হচ্ছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বক্তব্য তুলে ধরেছেন। শুক্রবার এক্স হ্যান্ডলে মমতা লেখেন, “রাজ্যে নতুন প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আনার জন্য নিরলস চেষ্টা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তার ফলেই আমেরিকা থেকে বিনিয়োগের প্রস্তাব নিশ্চিত হয়েছে। রাজ্যের দক্ষতা ও ক্ষমতাই প্রকাশ পেয়েছে।” একইসঙ্গে তিনি লেখেন, ভারতে সেমিকন্ডাক্টর বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে বাংলা। সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টের জন্য জমিও তৈরি রয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। প্রচুর কর্মসংস্থান হবে বলে তিনি আশাবাদী।
কী বলছে বিজেপি ও সিপিএম?
সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টের কৃতিত্ব নিয়ে শাসকদলকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি। রাজ্যসভার সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কোনও বিতর্ক চাই না। কারণ, এই প্ল্যান্ট হলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে একটা শিশুও জানে, সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট কলকাতায় আনার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনও ভূমিকা নেই। ওয়েবেল এর আগে একটি ডিজাইন ইউনিট তৈরি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেমিকন্ডাক্টরের এই ডিজাইন ইউনিটের সবচেয়ে বড় জায়গা এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরু। সেটাই কলকাতায় করার জন্য যোগাযোগ করেন। কিন্তু, এই প্ল্যান্ট এসেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চেষ্টা ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সহযোগিতায়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিমাতৃসুলভ আচরণ বিজেপি করে না। এই পদক্ষেপ সেটারই প্রমাণ।” এই প্ল্যান্ট নিয়ে ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে কি প্রচার করবে বিজেপি? প্রশ্ন শুনে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র বললেন, “আমরা যদি প্রচার করি, তাহলে করব। তবে মানুষ জানে। বিজেপির প্রচার করার দরকার পড়বে না।” বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বললেন, “আমরা চাই, বাংলার উন্নয়ন হোক।”
সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী দেবেশ দাস বলছেন, “দেশের স্বনির্ভরতার জন্য সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট হওয়া দরকার। তবে সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টে খুব বেশি কর্মসংস্থান হয় না। কিন্তু একে কেন্দ্র করে আরও শিল্প গড়ে উঠতে পারে।”
কী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক?
এই প্ল্যান্টের রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র। বরং তিনি মনে করেন, সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট হলে রাজ্যের যুব সমাজ উপকৃত হবেন। রাজনৈতিক এই বিশ্লেষকের কথায়, “প্রথমত সত্যিই যদি প্ল্যান্ট হয়, তাহলে বাংলার মানুষের উন্নতি হবে। দ্বিতীয়ত, প্ল্যান্ট হলে তৃণমূল ও বিজেপি-দুটি দলই কৃতিত্ব নিতে চাইবে। এটা স্বাভাবিক। ২০২৬ সাল পর্যন্ত দুই দলই কৃতিত্ব নিতে চাইবে। সত্যিই কর্মসংস্থান হলে দুটি দলের কৃতিত্ব নিয়ে তখন আলোচনা করা যায়।” তবে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনার সময় আসেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনায় টাটার ন্যানো প্রকল্প-
দেশের মধ্যে প্রথম বাংলায় সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট। আর এই প্রথমের প্রসঙ্গ উঠলেই আলোচনায় উঠে আসছে টাটার ন্যানো গাড়ির প্রসঙ্গ। বছর আঠারো আগে ন্যানো গাড়ির প্রকল্প নিয়ে তৎপর হয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। দেশে প্রথম এক লাখ টাকার চারচাকা গাড়ি তৈরির জন্য বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলেন রতন টাটা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী নেত্রী। জোর করে জমি নেওয়া যাবে না জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। তারপর টানা চাপানউতোর। শেষমেশ বাংলা থেকে ন্যানো কারখানা গুজরাটের সানন্দায় নিয়ে যায় টাটারা। রাজনৈতিক কারবারিরা বলছেন, তারপর থেকে রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনা ক্রমশ নিম্নমুখী। সেই গ্রাফ কি এবার আবার উপরে উঠবে?
সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট বাংলায় আনার কৃতিত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে একটি বিষয় পরিষ্কার, প্ল্যান্ট গড়ে উঠলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। শিল্পের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বাংলায়। প্রথম হওয়ার ‘স্বাদ’ পাবেন বাঙালিরা।