৯ অগস্ট, ২০২৪। সরকারি হাসপাতালের ভিতর থেকে উদ্ধার এক চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। সেদিন ওই ৩১ বছরের তরুণীর চিৎকার কেউ শুনতে পেয়েছিল কি না, জানা নেই। তবে তাঁর জন্য গলা ফাটিয়েছে গোটা দেশ। ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে তোলপাড় হয়েছে রাজধানী দিল্লি থেকে ‘তিলোত্তমা’ কলকাতা। বুকে আগুন নিয়ে যে মেয়েরা পথে নামছে, তা কি শুধুই ওই মেয়েটির জন্য? নাকি এগুলো সহ্যশক্তি পার করে যাওয়ার আর্ত চিৎকার?
শুধুই কি শহরের এক সরকারি হাসপাতালের অভিশপ্ত সেমিনার রুম? কালিয়াচক অথবা হাঁসখালি, কোথাও পাট খেত, কোথাও বাঁশঝাড়, কোথাও আবার অভিজাত হোটেলের ঘর- সাংবাদিকতার সুবাদে প্রায় প্রত্যেকটা দিন এমন ঘটনার কথা কানে আসে। আবার অনেক কথা পৌঁছয় না কারও কানে…। শুধু ধর্ষণ বা গণধর্ষণ নয়, ভিড় বাসে একটা অস্বস্তিকর ‘টাচ’, পরিচিত লোকের হঠাৎ বদলে যাওয়া ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ যেন মেয়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। বিচারের আশাও করে না অনেকেই। অনেকে জানেই না যে ঠিক কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানো যায়, কীভাবে অভিযোগ জানাতে হয়! আর সেই না-জানাতেই ঢাকা পড়ে যায় প্রতিদিনের এমন অনেক ঘটনা। ভারতীয় সংবিধান ও আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে রয়েছে নারী সুরক্ষা। এতটুকুও স্পর্শও যদি অস্বস্তি দেয়, সেই ক্ষেত্রেও অভিযোগ করা যেতে পারে।
জানেন যৌনতার প্রস্তাব দেওয়াও অপরাধ?
পথে-ঘাটে মহিলাদের নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকী প্রতিবেশীর ব্যবহারও অনেক সময় পীড়া দেয়। মহিলারা বুঝে উঠতে পারেন না, কোনটা অপরাধ, কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানো সম্ভব। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিধি অনুযায়ী, কোনও মহিলাকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতার প্রস্তাব দেওয়া অথবা তাঁর সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করাও অপরাধ। নীচের যে কোনও একটি ঘটনা ঘটলে যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানানো যায়-
১. অবাঞ্ছিতভাবে কোনও মহিলার শরীর স্পর্শ করা, অথবা তাঁকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেওয়া।
২. কোনও জিনিস দেওয়া বা কোনও কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার প্রস্তাব।
৩. কোনও মহিলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে পর্নোগ্রাফি দেখানো।
৪. মহিলার সম্পর্কে কোনও অশ্লীল (যৌনতা সম্পর্কিত) কোনও মন্তব্য করা।
এই সবকটি ক্ষেত্রে দোষ প্রমাণিত হলে তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা ধার্য করা হতে পারে। শুধু এগুলোই নয়, কোনও মহিলাকে পোশাক খুলতে বাধ্য করা, ব্যক্তিগত মুহূর্ত (যে সময় মহিলার শরীরের গোপনাঙ্গ অনাবৃত থাকে) ক্যামেরাবন্দি করা বা গোপনে নজর রাখাও অপরাধ।
মহিলারা FIR করতে গেলে ‘না’ করতে পারে না পুলিশ
ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি বা মহিলাদের ওপর অত্যাচারের যে কোনও ঘটনায় অভিযোগ গ্রহণ করতেই হবে পুলিশকে। কোনও অবস্থাতেই মহিলাকে ফেরানো যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, একজন মহিলার সঙ্গে যেখানেই অত্যাচারের ঘটনা (ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা) ঘটুক না কেন, তিনি তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী থানায় অভিযোগ জানাতে পারেন। ঘটনা এক জায়গায় ঘটেছে, আর অভিযোগ আর এক জায়গায়! এই অজুহাত দেখাতে পারবে না পুলিশ। স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুপ্রিম কোর্টের। থানার যে একটা ‘জুরিসডিকশন’ (jurisdiction) হয় অর্থাৎ নির্দিষ্ট থানার আওতায় একটা নির্দিষ্ট এলাকা থাকে, সেটা সব মহিলার জানার কথা নয়। তাই অভিযোগ জানাতে এলেই গ্রহণ করতে হবে। যাকে আইনি ভাষায় বলা হয়, জিরো এফআইআর (ZERO FIR)।
‘এত দেরিতে এলেন কেন?’ এই যুক্তি টিকবে না
ধরা যাক, ঘটনাটি ঘটেছে রবিবার। নির্যাতিতা মহিলা অভিযোগ জানাতে ২-৩ দিন দেরী করে ফেললেন। অনেক সময় শুনতে হয়, ‘এত দেরিতে এলেন কেন? এতদিন কী করছিলেন?’ কিন্তু এই যুক্তিতে অভিযোগ ফেরাতে পারবে না পুলিশ। অভিযোগ গ্রহণ করতেই হবে। আসলে, অনেক সময় নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে দ্বিধাবোধ করেন মহিলারা। সমাজ কী চোখে দেখবে! থাকে সেই ভয়। বিশেষ করে পরিচিত কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো সবসময় সহজ হয় না একজন মহিলার পক্ষে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেরিতে অভিযোগ জানান মহিলারা।
FIR করার সময় কী কী নিয়ম মানতে হয় পুলিশকে?
ব্যুরো অব পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (Bureau of Police Research and Development) এসওপি অনুযায়ী, থানায় ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে গেলে কোনও মহিলা পুলিশ অফিসারকে সেই এফআইআর (FIR) গ্রহণ করতে হবে। যদি এফআইআর গ্রহণ করতে দেরি হয়. তাহলে তার কারণ কী, সেটা এফআইআরে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দিতে হবে। অভিযোগকারীর যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষাতেই এফআইআর লিখতে হবে। জেলার ‘লিগাল সার্ভিস অথরিটি’তে একটি এফআইআর-এর কপি পাঠিয়ে দিতে হবে।
সম্মান রক্ষা করেই কথা বলতে হবে পুলিশ অফিসারকে
অভিযোগকারীর সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার কীরকম ব্যবহার করবেন তারও কিছু বিধি-নিয়ম রয়েছে। যথাযোগ্য সম্মান দিতে হবে অভিযোগকারীকে, তিনি অস্বস্তিতে পড়তে পারেন এমন কোনও প্রশ্ন করা যাবে না।
তার পরিচয় যাতে কোনওভাবেই সামনে না আসে যদি কেউ নজর রাখতে হবে পুলিশকে। যদি অভিযোগকারীর সঙ্গে তার পরিবারের কেউ না থাকে, তাহলে পুলিশকেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
অভিযোগকারী যদি মানসিক ভারসাম্যহীন বা বিশেষভাবে সক্ষম হন, তাহলে অভিযোগ শোনার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয় পুলিশকে। অভিযোগকারীর বাড়িতে বসে বা তার পছন্দের কোনও জায়গায় বসে পুলিশকে অভিযোগ শুনতে হবে। পুরো বয়ানের ভিডিয়ো রেকর্ড করতে হবে।
নির্যাতিতা যদি শিশু হয়, তবে তার পরিবারের অনুমতিতেই এফআইআর গ্রহণ করতে হবে। যদি পরিবারের কেউ তৎক্ষণাৎ উপস্থিত না থাকে, সে ক্ষেত্রে কোনও এনজিওকে খবর দেবে পুলিশ। সেখানকার কোনও সদস্যের সামনে অভিযোগ গ্রহণ করতে হবে।
মহিলা অফিসারের উপস্থিতি জরুরি
ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার মহিলা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর যদি তদন্তকারী টিম থাকে, তাহলে টিমের সদস্য হিসেবে কোনও মহিলা অফিসার থাকতেই হবে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেডিক্যাল পরীক্ষা
ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে মেডিকেল পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগকারীর বয়স ১৮ বছরের বেশি হলে, তাঁর অনুমতি নিয়ে তবেই মেডিকেল পরীক্ষা করা যায়। আর নির্যাতিতা যদি নাবালিকা হয়, তাহলে তার মা, বাবা বা কোনও অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। অভিযোগ দায়ের হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মেডিক্যাল পরীক্ষা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
থানায় যাওয়া সম্ভব না হলে ‘১০০’- নম্বরে ফোন করতে হবে। এছাড়া ১০৯১ নম্বরে ফোন করে জাতীয় মহিলা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সুতরাং, যে কোনও রকম নারী নির্যাতনের ঘটনায় আইনি সহায়তা পাওয়া নির্যাতিতার অধিকার। তা থেকে বঞ্চিত করতে পারে না পুলিশ-প্রশাসন।
আইন তো আজ নতুন করে তৈরি হয়নি। স্বাধীন ভারতে এইসব আইন বরাবরই কার্যকর। তারপরও এফআইআর না নেওয়ার ভূরি ভূরি অভিযোগ! প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো ছেড়েই দিন, শহরেও পুলিশ-প্রশাসনের দরজায় মাথা কুটে মরতে হয় নির্যাতিতাকে। আইন আছে তবু বিচার মেলে না! নিয়ম আছে, তার কার্যকারিতা নেই! আজও শুধু দীর্ঘশ্বাস বুকেই অনেক মেয়েকে ফিরে যেতে হয়। তাই আজ বাতাস কেঁপে উঠছে দুটো শব্দে, ‘আর কবে? আর কবে?’