Salary in Private Sector: বাংলায় বেতন কম কেন?

Salary in Private Sector: চাকরিপ্রার্থীদের লম্বা লাইন। শূন্যপদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আবেদনকারী। এই চিত্র প্রায়ই দেখা যায়। আর বেতন হার? বাংলায় বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন অন্য রাজ্যের তুলনায় কম কেন? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

Salary in Private Sector: বাংলায় বেতন কম কেন?
বাংলায় বেসরকারি ক্ষেত্রে কম বেতন নিয়ে কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?
Follow Us:
| Updated on: Jul 20, 2024 | 9:15 PM

”চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা, সত্যি/ আর মাত্র কয়েকটা মাস, ব্যাস/ স্টার্টিং এই ওরা এগারোশো দেবে/ তিন মাস পর কনফার্ম/ চুপ করে কেন, বেলা, কিছু বলছো না?”

শুরুতেই এগারোশো টাকা। তিন মাস পর কনফার্ম। বাঙালির নস্ট্যালজিক গান। ৩০ বছর আগে লিখেছিলেন অঞ্জন দত্ত। প্রেমিকাকে চাকরি পাওয়ার খবর জানাবেন। সংসার বাঁধার স্বপ্ন এবার সত্যি হবে। কিন্তু, বেলা নিশ্চুপ। আকুল আর্তি জানিয়ে প্রেমিকের প্রশ্ন, চুপ করে কেন আছো তুমি বেলা? কেন কিছু বলছো না? উত্তর পাননি বেলা বোসের প্রেমিক। তবে মনের কথা জানাতে ভোলেননি তিনি। আবার প্রশ্নও করছেন? ৩০ বছর পর ফের প্রশ্নের ডালি। ওই এগারোশো টাকা এখন কত হয়েছে বাংলার বেসরকারি সেক্টরগুলিতে? সেই বেতন হার কি অন্য রাজ্যের তুলনায় কম? যদি তাই হয়, এর কারণ কী? কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?

সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগ হবে। যতজন কর্মী চাই, আবেদন জমা পড়েছে তার কয়েকশো গুণ। চিত্রটা শুধু ওই একটা সংস্থার নয়। যেকোনও চাকরিতে শূন্যপদের চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যার দিকে নজর দিলে একই চিত্র ধরা পড়বে। আবার ট্রেনে যাতায়াতের সময় কামরায় অনেক বিজ্ঞপ্তি নজরে পড়ে। কর্মী চাই। কোন কাজের জন্য কর্মী দরকার। যোগ্যতা কী লাগবে। বেতন কত। সবকিছু দেওয়া থাকে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। সেখানে নজর টানবে বেতনের হার। কোনও কাজের জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। কোনও কাজের জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার। কোনও কাজের জন্য অবশ্য ১৫ কিংবা ১৮ হাজার টাকার কথা লেখা রয়েছে। ট্রেনে-বাসে যাতায়াতের সময় বিভিন্ন বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত যুবক-যুবতীদের আলোচনা কানে আসে। কেউ বলেন, মাসের শেষ, একটু টেনে চলতে হচ্ছে। কারো ক্ষেদোক্তি, এই টাকায় সংসার চালানো যায়? ঘাড় নেড়ে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করেন অন্যজন। প্রশ্ন জাগে, অন্যান্য রাজ্যেও কি এই একই কাজের জন্য এরকমই বেতন দেওয়া হয়?

বেসরকারি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বেতন হার কি কম? যদি হয় , তা হলে কেন? কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?

প্রশ্ন শুনে অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বিশেষজ্ঞ সুপর্ণ মৈত্র বললেন, “আমাদের একটু পিছন ফিরে দেখতে হবে। একসময় শিল্পের পীঠস্থান ছিল বাংলা। কিন্তু, গত ৫০ বছরে বাংলায় ধীরে ধীরে বড় শিল্প কমেছে। তারা পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। এই রাজ্যে শিল্প কমেছে। শিল্পের খরা দেখা যাচ্ছে। শিল্পায়নের পরিবেশ থাকলে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলে যেসব রাজ্যে বেশি শিল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে কর্মীদের চাহিদা বেশি। তারা বেশি মাইনে দিয়ে কর্মী নিচ্ছে। অন্যদিকে, যেহেতু বাংলায় শিল্প কম, ফলে চাহিদার তুলনায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি। সংস্থাগুলির সাধারণ প্রবণতা হল, কম টাকায় কর্মী নেওয়া। কারণ, তারা জানে, একজন গেলে তারা দশজন পাবে। অন্যদিকে, এখানকার কর্মীদের কাছে বিকল্পও কম। এক জায়গায় চাকরি ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম। আসলে শিল্পের পরিবেশের সঙ্গে কর্মসংস্থানের যোগ রয়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।”

বাঙালিদের সরকারি চাকরির প্রতি ঝোঁকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাঙালিদের মধ্যে স্থায়ী চাকরিতে যোগ দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। তাই, তারা সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে চাইছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী বলে কিছু হয় না। আবার সরকারি ক্ষেত্রে একটা ন্যূনতম বেতন হয়। আবার অনেকে নানা কারণে বাড়িতে থেকেই কাজ করতে চান।”

বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের মতো জায়গায় কেন সংস্থাগুলি বাংলার তুলনায় বেশি বেতন দিচ্ছে?

অর্থনীতিবিদ সুপর্ণ মৈত্রর অকপট জবাব, “কারণ সংস্থাগুলি সেখানে লাভ করছে। তাদের সংস্থার উন্নতি হচ্ছে। সংস্থার উন্নতি হলে কর্মীদের বেতন বাড়াতে তাদের তো কোনও অসুবিধা নেই। সেখানকার মানুষ শিল্পায়নকে পাখির চোখ করেছে। শিল্পের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু, এখানে তো সংস্থাগুলি পড়ে যাচ্ছে।”

অর্থনীতিবিদ তথা দুর্গাপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহানন্দা কাঞ্জিলালও বাংলায় বৃহৎ শিল্পের অভাবের কথা বললেন। বাংলায় বেতন কম হওয়ার কারণ নিয়ে তিনি বলেন, “উন্নত রাজ্যে মজুরির হার বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। উন্নত রাজ্যগুলিতে শিল্পের পরিকাঠামো রয়েছে। দেশের মধ্যে উন্নয়নের নিরিখে মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। কিন্তু, কর্মসংস্থানের জন্য বৃহৎ শিল্প দরকার। কিন্তু, বিগত কয়েক দশকে বাংলায় বৃহৎ শিল্প নেই। তাই এখানে কর্মসংস্থান কম হয়।”

একই সংস্থার অফিস কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে থাকলেও কি বেতন হারে পার্থক্য হবে?

প্রশ্ন শুনে অর্থনীতিবিদ মহানন্দা কাঞ্জিলাল বলেন, “অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাজ্যে বেতনের হার বেশি হবে। একই সংস্থার অফিস হলেও তাই দুই জায়গায় দু’রকম বেতন হবে। এটাই নিয়ম। আমেরিকাতেও বিভিন্ন জায়গায় বেতন হার বিভিন্ন। তাছাড়া উন্নত রাজ্যে কস্ট অব লিভিং (জীবনযাত্রার ব্যয়) বেশি। তার জন্যও বেতনের হার বেশি। পশ্চিমবঙ্গে কস্ট অব লিভিং অনেকটাই কম। অন্য রাজ্যের তুলনায় মানুষের জীবনযাপনের খরচ কম হয়।”

জীবনযাত্রার ব্যয় যদি বাংলায় কম হয়, তাহলে বেতন কম কথাটা কি ব্যবহার করা যায়?

অর্থনীতিবিদ মহানন্দা কাঞ্জিলাল বলেন, “এটা গুলিয়ে ফেললে হবে না। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাজ্যে শিল্প আসছে বেশি। পরিকাঠামোতে তারা অনেক ব্যয় করছে। বিদেশি কোম্পানি সেখানে বিনিয়োগ করছে। তাদের বেতন কাঠামো স্বাভাবিকভাবে বেশি হবে। ফলে সেখানকার কর্মীদের আয়ের মাপকাঠি অনেক বেশি। মানুষের আয় যদি বেশি হয়, সেক্ষেত্রে কস্ট অব লিভিং বেশি হলে ক্ষতি কী? তাহলে বিলেত, আমেরিকায় মানুষ যায় কেন? যেখানে তুমি দেড় লক্ষ পাবে সেখানে যাবে, নাকি বাড়িতে থেকে ২০ হাজার টাকায় কাজ করবে? কস্ট অব লিভিং বেশি হলেও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।”

একইসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলায় বিদেশি কোম্পানি কটা রয়েছে? আমরা যেহেতু উন্নত রাজ্যে পরিণত হতে পারিনি, সেজন্য বেতন কাঠামো কম। শুধু বড় বড় সংস্থা কেন, জরির কাজ করতে বাংলা থেকে মানুষ গুজরাট, হায়দরাবাদে যাচ্ছেন। কারণ, সেখানে অনেক বেশি মজুরি পাওয়া যায়। আসল কথা কর্মসংস্থান। মূলত বৃহৎ শিল্পে কর্মসংস্থান।”

পেস্কেল.কমের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে গড় বেতন ৩১ হাজার ৯১৬ টাকা। সেখানে বেঙ্গালুরুতে গড় বেতন ৬০ হাজার ৫৮৩ টাকা। আর পুনেতে গড় বেতন ৪৮ হাজার ৫৮৩ টাকা। মুম্বইয়ে গড় বেতন ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা। নয়াদিল্লিতে তা ৪১ হাজার ৫০০ টাকা।

কোনও দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মাপকাঠি হল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন(GDP)। আবার রাজ্যেরও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিমাপ করা হয়। যাকে বলে জিএসডিপি। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে জিডিপির নিরিখে দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের জিএসডিপি ৩৮.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে গুজরাট ও কর্নাটক। পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি ১৭.১৯ লক্ষ কোটি টাকা।

মাথাপিছু আয়ে একসময় দেশের মধ্যে উপরের দিকে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ছয়েক দশকের শুরু পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের থেকে বেশি ছিল। এমনকি, দেশের মধ্যে প্রথম তিনটে রাজ্যের একটি ছিল বাংলা। অন্য দুটি রাজ্য ছিল মহারাষ্ট্র ও গুজরাট। আটের দশকের শুরুতে বাংলায় মাথাপিছু আয় দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের কাছাকাছি নেমে আসে। নয়ের দশকের শুরুতে মাথাপিছু আয়ে রাজ্যগুলির তালিকায় সাত নম্বরে নেমে আসে বাংলা। পরের দুই দশকে আরও কয়েক কদম পিছনে চলে যায়। মাথাপিছু আয়ে এখন দেশের মধ্যে মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

এসব তো পরিসংখ্যান। বাংলায় বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন নিয়ে কি ভাবছে যুবসমাজ? ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার চিন্তা কি তাড়া করছে তাঁদের? সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করেন সুদীপ্ত। মুখে হালকা দাড়ি। চোখে রিমলেস চশমা। অফিসে ঢোকার মুখে কিছুটা পথ আটকেই ধরা গেল তাঁকে। বাংলায় বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন কি অন্য রাজ্যের চেয়ে কম? প্রশ্নটা শুনেই এমনভাবে তাকালেন, যেন এই প্রশ্ন কেউ করে। তারপর মৃদু-মন্দ্র কণ্ঠে বললেন, “সেটা তো দেখতেই পাই। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদে চাকরি করে। তাদের বেতন আমার চেয়ে অনেকটাই বেশি।” কেন বেশি বলে মনে হয়? মুখে একগাল হাসি এনে তাঁর উত্তর, “কী জানি।” কখনও মনে হয় না, বন্ধুদের মতো বেঙ্গালুরু কিংবা হায়দরাবাদ যেতে? মুখের পেশি শক্ত হয়ে উঠল সুদীপ্তর। প্রশ্নকর্তার দিকে চেয়ে বললেন, “নিজের রাজ্য ছেড়ে কেন বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ যেতে হবে?”

ঋজু মেরুদণ্ড। স্থির দৃষ্টি। যেন পরের প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু, আর প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি তাঁকে। তখনও অবশ্য প্রশ্নের ডালি সাজানো নোটবুকে…