যুদ্ধজয়ের দিনেই এমার্জেন্সি মিটিং, শেষ মুহূর্তে কেন সিদ্ধান্ত বদল ইন্দিরার?

সেদিন রাত আটটায় অল ইন্ডিয়া রেডিও-র প্রাইম টাইম বুলেটিন। সেখানেই ঘোষণা হল, পশ্চিমে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ভারত। যুদ্ধ শেষ এবং সেনার ঘরে ফেরা শুরু। পার্থসারথী লিখছেন, আমি অবাক হয়েছিলাম বললেও কম বলা হয়। মিটিং শেষ হয়েছিল সন্ধে ৬টায়। আর রাত ৮টার খবরে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়। মানে মিটিং থেকে বেরিয়ে নিজের দফতরে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ইন্দিরা। কেন?

যুদ্ধজয়ের দিনেই এমার্জেন্সি মিটিং, শেষ মুহূর্তে কেন সিদ্ধান্ত বদল ইন্দিরার?
| Edited By: | Updated on: Sep 01, 2024 | 12:11 AM

সাউথ ব্লকে জরুরি মিটিং ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। সব মন্ত্রী, মন্ত্রকের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর চার উপদেষ্টা – সবাই হাজির। আছেন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, ‘র’ চিফ। আর সেনার তিন শাখার প্রধান। সবমিলিয়ে ৫৫-৫৬ জন। মাত্র দু-ঘণ্টার নোটিশে মিটিং ডাকা হয়েছে। কী নিয়ে মিটিং, সেটাও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কারোরই জানা নেই। শুধু নির্দেশ পেয়ে সবাইকে ছুটে আসতে হয়েছে। মিটিং ডেকেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ঢুকলেন সবার শেষে। আর শুরুতেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন সেনাপ্রধানের দিকে। স্যাম, পেশোয়ারে পৌঁছতে আমাদের আর কদিন লাগবে? যেদিন সাউথ ব্লকে এই মিটিং চলছে, সেদিনই ঢাকায় ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে পাক সেনা। দিনটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পাক সেনা স্যারেন্ডার করার পর পাক যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রসেসও শুরু হয়েছে। তখনই প্রধানমন্ত্রীর জরুরি তলব। এতদিন যুদ্ধটা হচ্ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। সেই যুদ্ধ জয়ের পরে প্রধানমন্ত্রী কি এইবার পাকিস্তানে সেনা ঢোকানোর নির্দেশ নেবেন? সবার চোখ তখন সেনাপ্রধানের দিকে। জেনারেল স্যাম মানেকশ এক মুহূর্তও সময় নেননি। জাস্ট বলে দিলেন, তিনদিন। তিনদিনের মধ্যে আমরা পেশোয়ারে ঢুকতে পারব। পাক সেনার ৯০ হাজার জওয়ান তখন ভারতের হাতে বন্দি। চেষ্টা করলে পেশোয়ার কেন, ভারতীয় সেনা ইসলামাবাদ পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে। কারণ তখন পাকিস্তানের এক ঘণ্টা লড়াই চালানোরও ক্ষমতা নেই। ইন্দিরা বৈঠকে উপস্থিত সবার মতামত জানতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা পিএন হাকসার। তিনি ভাসা, ভাসা কিছু বললেন। কী বলতে চাইছেন, সেটা কারও বোধগম্য হল না। এবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের পালা। জগজীবন বললেন, আমাদের সেনা পাকিস্তানে ঢুকুক। আমরা তো আর ওখানে বসে থাকব না। বরং তাতে আমরা অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে দর কষাকষি করতে পারব। এই সুযোগ হয়ত আর আসবে না। ইন্দিরা একটা কথা বলেই মিটিং শেষ করেছিলেন। আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিন। আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব। পাকিস্তানে ভারতীয় হাই-কমিশনার হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন জি পার্থসারথী। পরে বিদেশসচিবও হন। সেদিন মিটিংয়ে কী হয়েছিল, তার ঘণ্টা-মিনিটের বিবরণ রয়েছে পার্থসারথীর ডায়েরিতে। সাউথ ব্লক ছাড়ার আগে ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলে যান, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমার হাতে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি সময় নেই। পার্থসারথীর মনে হয়েছিল, ইন্দিরা ও মানেকশ দুজনেই পাকিস্তানে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের নজর এখন পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে। খালি বাকি লোকজনকে ডেকে সেটা তাঁরা শুনিয়ে রাখলেন। সেদিন রাত আটটায় অল ইন্ডিয়া রেডিও-র প্রাইম টাইম বুলেটিন। সেখানেই ঘোষণা হল, পশ্চিমে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ভারত। যুদ্ধ শেষ এবং সেনার ঘরে ফেরা শুরু। পার্থসারথী লিখছেন, আমি অবাক হয়েছিলাম বললেও কম বলা হয়। মিটিং শেষ হয়েছিল সন্ধে ৬টায়। আর রাত ৮টার খবরে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়। মানে মিটিং থেকে বেরিয়ে নিজের দফতরে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ইন্দিরা। কেন? রাশিয়া বা আমেরিকার তরফে কোনও বার্তা এসেছিল কি? সেদিন সন্ধে ৬টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠায় রাশিয়া। ব্রেজনেভের বার্তায় লেখা ছিল এবার ভারতীয় সেনা কী করবে, সেটা পুরোপুরি তাদের সিদ্ধান্ত। ভারত যাই করুক, সোভিয়েত রাশিয়া আগের মতই ভারতের সাথে থাকবে। কোনও শক্তিই ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে আসতে পারবে না। একদম ক্রিস্টাল ক্লিয়ার বার্তা। এরপরেও শেষ মুহূর্তে কেন পিছিয়ে এসেছিলেন ইন্দিরা? সেটা সম্ভবত একমাত্র তিনিই জানতেন।

Follow Us: