পৃথিবীর বাইরে একটা ‘বাড়ি’। ২০০০ সালে যে বাড়িতে প্রথম অতিথির আগমন। তারপর অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়। স্থায়ীভাবে কেউ সেখানে থাকেন না। তবে ‘বাড়ি’ কখনও ফাঁকা থাকে না। অতিথিরা যান। আবার চলেও আসেন। কেউ কেউ অতিথি হয়ে সেখানে একাধিকবার গিয়েছেন। কিন্তু, নির্দিষ্ট দিনের বাইরে থাকেননি। সেই ‘বাড়ি’ থেকে অতিথিদের বিদায়ের সময় যে বাঁধা। কিন্তু, সেই নিয়মেই এবার ছেদ ঘটেছে। আটদিনের দুই অতিথি সেই বাড়িতে কয়েক মাস রয়েছেন। থাকবেন আরও কয়েকমাস। কিন্তু, কেন এই নিয়মে ছেদ? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দুই অতিথি মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস ও ব্যারি উইলমোর কেন আটকে পড়েছেন সেখানে? কোথায় সমস্যা? কেন নির্দিষ্ট সময়ে ফিরিয়ে আনা গেল না তাঁদের? দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে পাড়ি দেওয়া বোয়িং স্টারলাইনার নিয়েও উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন-
পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে অবস্থিত বাসযোগ্য কৃত্রিম উপগ্রহ হল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কানাডার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরি করেছে। মহাকাশে গবেষণা কেন্দ্র তৈরির প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালের নভেম্বরে একদল মহাকাশচারী সেখানে যান। তারপর থেকে কখনও ফাঁকা থাকেনি মহাকাশ স্টেশন। গত ২৪ বছর ধরে নানা গবেষণা চলছে আইএসএসে। কোনও কোনও মহাকাশচারী একাধিকবার সেখানে গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক এই মহাকাশ স্টেশনের আয়ু ২০৩১ সাল পর্যন্ত।
মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস ও ব্যারি ই উইলমোরের মহাকাশ স্টেশনে যাত্রা-
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস এবং আমেরিকার মহাকাশচারী ব্যারি ই উইলমোরের এর আগেও মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছেন। ব্যারি উইলমোর ২০০৯ সালে প্রথম মহাকাশ স্টেশনে যান। ২০১৪ সালে ফের মহাকাশ স্টেশনের অতিথি হন তিনি। দশ বছর পর তৃতীয়বার মহাকাশ স্টেশনে পাড়ি দিয়েছেন বছর একষট্টির মার্কিন এই মহাকাশচারী।
সুনীতা উইলিয়ামস প্রথম মহাকাশ স্টেশনে প্রথম পা রাখেন ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ২০১২ সালে ফের মহাকাশ স্টেশনে যান তিনি। তৃতীয় এই যাত্রার আগে মহাকাশ স্টেশনে ৩২২ দিন কাটিয়ে এসেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মহাকাশচারী।
সুনীতা ও উইলমোরের ক্ষেত্রে এবারের যাত্রা কোথায় আলাদা?
এবার সুনীতা ও উইলমোর মহাকাশ স্টেশনে পাড়ি দেন বোয়িংয়ের তৈরি মহাকাশযান স্টারলাইনার চড়ে। বোয়িং কম্পানি বিমান তৈরি করে। এই প্রথম বোয়িংয়ের কোনও মহাকাশযান মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছল। সেজন্য এর নাম রাখা হয় বোয়িং স্ক্রু ফ্লাইট টেস্ট। ৫ জুন, ২০২৪। স্টারলাইনার মহাকাশযান মহাকাশে পাড়ি দেয়। আর সেই মহাকাশযানে চেপে পাড়ি দেন কমান্ড্যার ব্যারি ই উইলমোর এবং পাইলট সুনীতা উইলিয়ামস। ২৭ ঘণ্টা মহাকাশযানে চেপে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছান দুই মহাকাশচারী। ৮ দিনের মিশন ছিল। কিন্তু, ৩ মাস পরও এখনও মহাকাশযানে তাঁরা।
স্টারলাইনার মহাকাশযান নিয়ে প্রশ্ন-
৫ জুন নয়। প্রকৃতপক্ষে ৬ মে সুনীতাদের মহাকাশযানে চেপে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। সব কিছু প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু, উড়ান শুরুর মাত্র ২ ঘণ্টা আগে তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। কিন্তু, কেন? মহাকাশযানের অক্সিজেন ভল্টে সমস্যার জন্য। এরপর ১ জুন ফের উড়ান শুরুর পরিকল্পনা করা হয়। এবারও তা বাতিল করা হয়। এবং তা মাত্র ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড আগে। কম্পিউটার অ্যাবর্ট সিস্টেম উড়ান বাতিল করে।
৫ জুন শেষমেশ মহাকাশযানে চেপে পাড়ি দেন সুনীতারা। কিন্তু, ওইদিনও পুরোপুরি বাধাহীন ছিল না তাঁদের যাত্রা। যাত্রা শুরুর আগে বোয়িং ও নাসার বিজ্ঞানীরা মহাকাশযানের হিলিয়াম লিক সারানোতে ব্যস্ত ছিলেন। বিজ্ঞানীরা বলেন, হিলিয়াম লিকের সমস্যা বড় কিছু নয়। নিরাপদে সুনীতারা মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছন। কিন্তু, তারপরই স্টারলাইনারে নানা সমস্যা ধরা পড়ে। হিলিয়াম লিকের সমস্যা তো ছিলই। প্রযুক্তিগত আরও একাধিক সমস্যা দেখা যায়।
সুনীতাদের ফেরানোর চেষ্টা-
মহাকাশ স্টেশনে আটদিন থাকার কথা ছিল সুনীতাদের। প্রথমে ১৪ জুন তাঁদের ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, স্টারলাইনারের সমস্যার সমাধান না হওয়ায়, উড়ান স্থগিত করে দেওয়া হয়। হিলিয়াম লিক ও রকেটের ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ না করায় উড়ান স্থগিত করা হয়। এরপর ২৬ জুন আরও একবার সুনীতাদের ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। সেবার একই সমস্যা। তারপর আর ঝুঁকি নেয়নি বোয়িং ও নাসা। নাসার তরফে জানানো হয়, তাদের স্ট্যান্ডার্ড মিশন ম্যানেজমেন্ট টিম বিষয়টি দেখছে। সামান্য হিলিয়াম সিস্টেম লিক ও ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে। তরল হিলিয়াম রকেটের ইঞ্জিনে কোনও বাধা ছাড়াই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
ইতিমধ্যে বোয়িংয়ের একাধিক বিমানের দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বোয়িংয়ের বিমানের সুরক্ষা ব্যবস্থা খামতির কথা জানা গিয়েছে। স্টারলাইনারের বাজেট ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে দুই মহাকাশচারীকে ছাড়াই স্টারলাইনার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। ৬ সেপ্টেম্বর নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস স্পেস হারবারে সফল অবতরণ করে স্টারলাইনার।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে কি অসুবিধার সম্মুখীন হবেন সুনীতারা?
নাসা বলছে, মহাকাশ স্টেশনে সুনীতাদের থাকার কোনও অসুবিধা নেই। সেখানে সুনীতারা ছাড়াও এই মুহূর্তে আরও ৫ জন মহাকাশচারী রয়েছেন। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে।
কবে পৃথিবীর মাটিতে পা রাখবেন সুনীতারা?
চলতি বছর মহাকাশ স্টেশনেই কাটবে সুনীতাদের। তাঁদের ফেরাতে তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না নাসা। কোনওরকম ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে না। ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ‘কলম্বিয়া’ মহাকাশযানের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ছে অনেকের। পৃথিবীতে ফেরার সময় বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল ওই মহাকাশযান। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা ও তাঁর ছয় সঙ্গীর। সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েই সুনীতাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সতর্ক নাসা। স্পেস-এক্স একটি মহাকাশযান পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করেছে। ওই মহাকাশযানে চারজন মহাকাশচারীর যাওয়ার কথা থাকলেও ২ জনকে পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুনীতা ও ব্যারিকে নিয়ে ফিরবে ওই মহাকাশযান।
১৯ সেপ্টেম্বর মহাকাশ স্টেশনেই নিজের ৫৯ তম জন্মদিন পালন করেছেন সুনীতা। মহাকাশ স্টেশনে কাজের মাধ্যমেই জন্মদিন পালন করেন। ব্যারি উইলমোরের জন্মদিন ২৯ ডিসেম্বর। তাঁরও জন্মদিন কাটবে মহাকাশ স্টেশনে। দুই মহাকাশচারীই জানাচ্ছেন, মহাকাশ স্টেশনে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তাঁদের। কিন্তু, দিনশেষে তো তাঁরা অতিথি। আর অতিথিকে তো একদিন মহাকাশ স্টেশন ছেড়ে আসতেই হবে। না হলে ‘অতিথি তুম কাব যাওগে’ প্রশ্ন তাড়া করবে। আপাতত ফেব্রুয়ারির প্রতীক্ষা। দুই মহাকাশচারীর নিরাপদে পৃথিবীর মাটি ছোঁয়ার প্রতীক্ষায় সবাই।