মন্দিরে মন্দিরে কেন ছুটছেন মমতা? ১৪৫ আসনের অঙ্কেই লুকিয়ে উত্তর

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের (Loksabha Election) ফলাফলের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই ভোট প্রচারের সব হিসেব মিলে যাবে।

মন্দিরে মন্দিরে কেন ছুটছেন মমতা? ১৪৫ আসনের অঙ্কেই লুকিয়ে উত্তর
কেন মন্দিরে ছুটছেন মমতা?
Follow Us:
| Updated on: Mar 25, 2021 | 7:52 PM

কলকাতা: বিধানসভা ভোটের প্রচারের শুরু থেকেই মন্দিরে মন্দিরে ছুটতে দেখা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে (Mamata Banerjee)। একাধিক মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছেন তিনি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন (Loksabha Election) পর্যন্তও সংখ্যালঘু ভোটেই গুরুত্ব দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাহলে আচমকা এই পরিবর্তন কেন? কেনই বা জয় শ্রী রাম স্লোগান নিয়ে মমতার বিরক্তি প্রকাশে আরও বেশি উস্কনি দিচ্ছে বিজেপি? এক দিকে মমতার মন্দির-প্রীতি আর অন্যদিকে বিজেপির হিন্দুত্বের তাস, কোনোটারই কারণ বুঝতে তেমন কষ্ট করতে হয় না। আসলে দুজনেরই একটাই লক্ষ্য, হিন্দু ভোট। কিন্তু সেই চাহিদা ঠিক কতটা?

উত্তর লুকিয়ে আছে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। সেই নির্বাচনে বাংলা থেকে ১৮টি আসন পায় বিজেপি। আর সেই ফলাফলের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে যে ঠিক কী কারণে দুই দল এ ভাবে হিন্দুত্বের পিছনে ছুটছে।

বাংলায় যে সংখ্যালঘু ভোটের বিশেষ গুরুত্ব আছে, তা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ হিন্দুর কথা বোধ হয় ভুলেই গিয়েছিলেন সবাই। আর এটাও অনেকের মাথায় ছিল না যে ২৯৪ টি বিধানসভা আসনের ১৪৫টিতে হিন্দু ভোটার ৮০ শতাংশ। আর এই ১৪৫ আসনের সঙ্গে তিনটি যোগ করলেই মিলবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের হিসেব বলছে, এই ১৪৫টি আসনের মধ্যে ৯২টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৫৩টিতে। আর পুরো রাজ্যের ভিত্তিতে ১২১টি তে এগিয়ে ছিল বিজেপি, ১৬৪ টি তে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। অর্থাৎ সেই নিরিখে এবার যে হিন্দু ভোট টানতে পারবে সেই বাজিমাৎ করবে।

তবে লোকসভা ভোটে রাজ্যের সব জেলা থেকে সমনভাবে হিন্দু ভোট পায়নি বিজেপি। বাংলাদেশ সংলগ্ন জেলা মালদা (৭৯%), উত্তর দিনাজপুর(৭৬%), দার্জিলিং(৬৯%), কোচবিহার(৬৫%), দক্ষিণ দিনাজপুর(৬৩%), নদিয়ায় (%) উল্লেখযোগ্যভাবে হিন্দু ভোট বেশি আসে বিজেপির ঘরে। অন্যদিকে কলকাতা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, মুর্শিদাবাদে অপেক্ষাকৃত কম ভোট পায় গেরুয়া শিবির। তাই এবার এই সব জেলা থেকে ভোট শেয়ার বাড়াতে চাইছে বিজেপি। যদি সব মিলিয়ে ৬০ শতাংশ হিন্দু ভোট আসে বিজেপির ঘরে তাহলে ২ মে শেষ হাসি হাসবে তারাই।

অন্য দিকে, এ রাজ্যে রয়েছে ২৩ শতাংশ তফশিলী জনসংখ্যা। এর মধ্যে রাজবংশী, মতুয়া, বাউরিরা ঝুঁকছে বিজেপির দিকেই। চা বাগান কর্মী ও জঙ্গলমহলের (পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পরুলিয়া) আদিবাসীদের ভোটও বেশির ভাগ বিজেপির দিকেই ঠিল, একই অবস্থা পাহাড়ের বাসিন্দা ও মতুয়াদেরও। বিজেপির উদ্দেশ্য, রাজবংশী, নমশূদ্র, ও চা বাগাম কর্মীদের ভোট একত্রিত করা, যাতে লোকসভার ৫৫ শতাংশকে ছাপিয়ে বিজেপির হাতে আসা হিন্দু ভোট ৬০ শতাংশ হয়।

হিন্দু ভোটের একত্রীকরণ কী প্রভাব ফেলতে পারে, সে দিকে চোখ রাখা যাক:

  • যদি ৫০ শতাংশ হিন্দু ভোট বিজেপির ঘরে যায় তাহলে ওই ১৪৫টি আসনের মধ্যে ৬০-৬৫টিতে জিতবে তৃণমূল। বিজেপি পাবে ৭০-৭৫ টি আসন। আর বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট পাবে ৫-১৫ টি আসন।
  • যদি ৬০ শতাংশ হিন্দু ভোট বিজেপির ঘরে যায় তাহলে ওই ১৪৫টি আসনের মধ্যে ২৫-৩৫টিতে জিতবে তৃণমূল। বিজেপি পাবে ১১০-১২০ টি আসন। আর বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট পাবে ০-৩ টি আসন।

এই পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই ভোট প্রচারের সব হিসেব মিলে যাবে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বাদে অন্যান্য দলগুলির উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘু ভোটকে একত্রিত করা। কিন্তু মোদী ক্ষমতায় আসার পর ছবিটা পাল্টে যায়। তিনি বুঝিয়ে দেন, সংখ্যালঘু ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় আসা সম্ভব। এরপর ২০১৭-তে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও একই বার্তা সামনে আসে। আর চমক ছিল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে। একজনও মুসলিম সাংসদ হননি। আর মমতার রাজ্যে বিজেপির ১৮টি আসন ছিল আরও বড় চমক।

এই সব হিসেব থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে যে কেন অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন যে আধাসেনায় নারায়ন সেনা ব্যাটেলিয়ন যুক্ত করা হবে যাতে চাকরি পাবে রাজবংশীরা। এমনকি অসমে রাজবংশীদের প্রধান অনন্ত মহারাজের সঙ্গেও দেখা করেছেন তিনি। রাজবংশী ভোটের লক্ষ্যেই লোকসভায় দিনহাটা থেকে নিশীথ প্রামাণিককে টিকিট দেয় বিজেপি।

উল্লেখযোগ্যভাবে এবারের বাজেটে চা বাগান কর্মীদের পরিবারের উন্ন.নের স্বার্থে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রান্তিক মানুষদের কাছে টানতে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দরিদ্র পরিবারে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজে সারছেন শাহ কিংবা নাড্ডা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরেও বাংলার নির্বাচনী আবহের ছোঁয়া আছে। বাংলাদেশে গিয়ে ওরাকান্দিতে মতুয়াদের মন্দিরে যাবেন তিনি। সম্মান জানাবেন হরিচাঁদ ঠাকুরকে। দেশভাগের সময় বহু মতুয়া এ রাজ্যে চলে আসেন।

সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভাল। ২৭ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটে তাঁর হাতে আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ২০১৯-এ বিজেপির হিন্দুত্বের প্রচার আর সাফল্যের পরই কৌশল বদলেছেন মমতা। বিজেপিকে ৬০ শতাংশ ভোট পাওয়া থেকে আটকাতে তফশিলী জাতি ও উপজাতি ভোটের দিকে মন দিয়েছেন মমতা। নির্বাচনি ইস্তাহারে তফশিলী জাতি ও উপজাতির মহিলাদের মাসে ১০০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মমতা। মাহাতোদের তফশিলী উপজাতি তকমা দিতে কেন্দ্রকে চিঠিও লিখেছেন তিনি।

রাজ্য পুলিশে তিন নারায়ণি ব্যাটেবিয়ন যুক্ত করার কথাও বলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো, যেখানে চাকরি পাবেন মাহাতো, গোর্খা ও জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা। ১০ কোটি টাকা খরচে তৈরি করা হচ্ছে মতুয়া ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, ৫ কোটি টাকা খরচে তৈরি হচ্ছে মনশূদ্রদের জন্য বোর্ড। এছাড়া পাহাড়ের সমর্থন পেতে বিমল গুরুং-এর সমর্থন খুঁজেছেন মমতা। তফশিলী জাতির জন্য ৬৮টি আসন সংরক্ষিত থাকলেও মমতা ৭৯টিতে টিকিট দিয়েছেন তফশিলী জাতি সদস্যদের।

২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল যাই হোক না কেন, বাংলার ভোটযুদ্ধে এই ১৪৫টি আসনই যে শেষ কথা বলবে তা মোটামুটি পরিস্কার।

তথ্য- TV9 ইলেকশন ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ উইং