ভ্যাকসিন-সেলফি ‘ভ্যাক্সি’: তুলেছেন কি আপনি? জেনে নিন ‘ভ্যাক্সি’র কী-কেন

Sohini chakrabarty |

Feb 04, 2021 | 1:30 PM

সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ সহযোগে ট্রেন্ডিং হয়েছে ‘ভ্যাক্সি’ বা ভ্যাকসিন সেলফি। প্রসঙ্গত বুধবার, কোভ্যাকসিনের প্রথম টিকাকরণে রাজ্য় স্বাস্থ্য দফতরের নক্ষত্রদের হাজির করেছে স্বাস্থ্য ভবন।

ভ্যাকসিন-সেলফি ‘ভ্যাক্সি’: তুলেছেন কি আপনি? জেনে নিন ‘ভ্যাক্সি’র কী-কেন
সোজা ভাষায় বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, নার্সরা যেন টিকা নেন—সেই ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ দিতেই এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল।

Follow Us

সলমান খান ভ্যাকসিন নিলে কোন গান গাইতেন? ‘চল বেটা সেলফি লে-লে রে?’

মনে হয় না। কারণ ভ্যাকসিনের সৌজন্যে গত কিছু দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে সে ‘ভ্যাক্সি’, ‘ভাইজান’ নিশ্চয়ই সেই ট্রেন্ড হাতছাড়া করতে চাইতেন না।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন: ‘ভ্যাক্সি’ (ভ্যাকসিন-সেলফি)। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ সহযোগে ট্রেন্ডিং হয়েছে ‘ভ্যাক্সি’। যদিও নার্স-চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই এখনও পর্যন্ত এই ‘ভ্যাক্সি’-র সাক্ষী হয়েছেন। প্রসঙ্গত আজ, বুধবার, কোভ্যাকসিনের প্রথম টিকাকরণে স্বাস্থ্য দফতরের নক্ষত্রদের হাজির করেছে স্বাস্থ্য ভবন। এস‌এসকেএমে টিকা নিয়েছেন মিশন ডিরেক্টর সৌমিত্র মোহন, স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য।

‘ভ্যাক্সি’ আসলে কী?

করোনা প্রতিরোধের জন্য টিকাকরণ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। কোভ্যাকসিন এবং কোভিশিল্ড এসেছে দেশে। এর মধ্যেই অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী ভ্যাকসিন নিয়েছেন। কারও ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গও দেখা দিয়েছে। তবে এই ভ্যাকসিন বা টিকা নেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরা আরও একটা কাজ করছেন। টিকা নেওয়ার পরই তাঁরা তুলেছেন সেলফি। এই সেলফিকেই বলা হচ্ছে ‘ভ্যাক্সি’। বিদেশের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালেও একটা ফ্রেম রাখা হয়েছে, যার চারধারে লেখা রয়েছে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ক্যাপশন। আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলে স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান দিয়েছেন যে, তাঁরা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সেলফি অর্থাৎ ‘ভ্যাক্সি’ তুলেছেন। নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে সেই ছবি পোস্টও করেছেন অনেকেই।

 

‘ভ্যাক্সি’র পাশাপাশি রয়েছে ব্যাচের ব্যবস্থাও। অনেক চিকিৎসকই ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কোভিড-যোদ্ধা হিসেবে একটা করে ব্যাচ পেয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরাও। সেই ব্যাচে লেখা রয়েছে যে ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির টিকাকরণ হয়েছে।

কিন্তু এই ভ্যাকসিন সেলফি বা ব্যাচের আয়োজন কেন?

উদ্যোক্তারা বলছেন, টিকাকরণের হার বৃদ্ধির জন্য—সোজা ভাষায় বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, নার্সর যেন টিকা নেন—সেই ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ দিতেই এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল। আর স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘ভ্যাক্সি’ দেখে সাধারণ মানুষও টিকা নিতে ভয় পাবেন না। এই আশঙ্কায় ভুগবেন না যে, টিকা নিলে না জানি কোন উপসর্গ দেখা দেবে এবং আরও বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। তাই ডাক্তারদের ‘ভ্যাক্সি’ দেখে দেশের সাধারণ মানুষের মনোবল বাড়বে এবং তাঁদের যখন টিকাকরণের সময় আসবে, তখন নির্দ্বিধায় তাঁরা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। মনে কোনও বাধা-সংশয় থাকবে না। অর্থাৎ সকলকে সচেতন করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

 

এর মধ্যেই টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘ভ্যাক্সি’। রসিকতা করে অনেক চিকিৎসক আবার মজার ক্যাপশনও লিখেছেন ছবির সঙ্গে। আগামী দিনে সমস্ত ভয় কাটিয়ে আমজনতাও ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হবে বলেই আশা করছেন চিকিৎসকরা।

এই ‘ভ্যাক্সি’র পিছনে কাজ করছে কোন মনস্তত্ব? সাময়িক সোশ্যাল মিডিয়া ক্রেজ় বা ট্রেন্ড নাকি এর সুদূরপ্রসারী কোনও প্রভাব আছে? নাকি সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকুক বা না থাকুক, তাৎক্ষণিক হলেও মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে এই ধরনের ট্রেন্ড?

TV9 বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তথা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকারের সঙ্গে।

এই যে ভ্যাকসিন নেওয়ার অব্যবহিত পরমুহূর্তেই ‘ভ্যাক্সি’ তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার ট্রেন্ড চলছে, এটার সদর্থক প্রভাবের দিকটা ঠিক কেমন?

শর্মিলার উত্তর, “দেখুন এক্ষেত্রে দু’টো দিক রয়েছে। এক, ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক সংশয় রয়েছে। অনেকেই ভাবছেন, আদৌ এটা নেওয়া যুক্তিসঙ্গত কি না… নিলে কোনও লাভ হবে কি না। এমনকি অনেকে এই ভয়ও পাচ্ছেন যে, ভ্যাকসিন নিলে সেটা কাজ করবে না। উল্টে ক্ষতি হতে পারে। তাই যাঁরা ভ্যাকসিন ইতিমধ্যেই নিয়েছেন, তাঁরা যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে এটা দেখাতে এবং বোঝাতে পারেন যে, ‘দেখুন আমি ভ্যাকসিন নিয়েছি এবং ভাল আছি, তাহলে সেটা সাধারণ মানুষকে সাহস জোগাবে।’

আর একটা ব্যাপার তো রয়েইছে, যে শেষ পর্যন্ত আমিও পেলাম। আমারাও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে মজা করছি। তবে সেটা নিছকই মজা। আসল উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষকে সচেতন করা, সাহস দেওয়া।”

যদিও ঠিক এমনটা মনে করেন না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “ভ্যাকসিন নিয়ে আমার সন্দেহ এখনও কাটেনি। একটু দ্বিধায় আছি। দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিবেদনেই ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট বেরিয়েছে। তাই এখনও সন্দেহমুক্ত হতে পারিনি। আর সেলফি তুলে এমনিতেও কোথাও পোস্ট করি না। তাই ‘ভ্যাক্সি’-র ব্যাপারে কিছু ভাবিইনি।”

চিকিৎসকদের অনেকে বলছেন, ‘ভ্যাক্সি’ পোস্ট করলে হয়তো আমজনতার সংশয় একটু কমবে। আপনার কী মনে হয়?

জবাবে মৈনাক বলেন, “নাহ্‌। আমার মনে হয় না সেলফি বা ‘ভ্যাক্সি’ বিশেষ কিছু কাজ করবে। আসলে এখন সমাজ ভীষণ ইমেজ স্যাচুরেটেড। হয়তো বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। তবে একই অস্ত্র বেশি ব্যবহৃত হলে তার ধার কমে যায়। যদিও এসব বলা কঠিন। কারণ হাতে পরিসংখ্যান বা তথ্য নিয়ে, গবেষণা করে তো আর কথা বলছি না। আমার ব্যক্তিগত মত কোনও ডাক্তার ভ্যাকসিন নিয়ে সেলফি পোস্ট করলে সেটা দীর্ঘমেয়াদে বিশেষ কোনও কাজ করবে না।” মৈনাকের আরও সংযোজন, “একটা কথা বারবারই বলব সঠিক তথ্য ছাড়া এসব নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। সেলফি নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। সেগুলোর কিছুটা আমি জানি। তাই বলতে পারি যে সেলফি কখনই দীর্ঘমেয়াদী কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা অনেকটা বুদবুদের মতো। ক্ষণিকেই মিলিয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ক্ষেত্রে মানুষ বোধহয় আর একটু স্থিতিশীল কিছু চাইবেন। এখন তারকারা ভ্যাকসিন নিয়ে সেলফি পোস্ট করলে কী হবে, তা জানি না। তবে আমার ধারনা সেইসবও বিশেষ প্রভাব ফেলবে না।”

টরন্টো-র কাছে একটি শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী শর্মিষ্ঠা গোস্বামী নিধারিয়া আবার বলছেন অন্য কথা। তাঁর কথায়, “লোকজনকে ভ্যাকসিন সম্পর্কে সচেতন করার এবং সাহস জোগানোর ব্যাপার তো রয়েইছে। তবে এছাড়াও এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে চাইছেন অনেকেই। আসলে গত একশ বছরে এমন মহামারি আসেনি। আর এত দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কারও হয়নি। তাই এমন একটা ঘটনার সাক্ষী থাকতে চাইছেন অনেকেই।” ‘ভ্যাক্সি’ তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করার ক্রেজ় যে চরমে, তা স্পষ্ট শর্মিষ্ঠার কথায়। তিনি বলেন, “আমাদের হাসপাতালে তো অনেকে নতুন পোশাক পরে এসেছিলেন ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ‘ভ্যাক্সি’ তুলবেন বলে। কোনও-কোনও ডাক্তার ফ্রেমে থাকতে চাননি। কেউ-কেউ (ডাক্তার) আবার বলেছেন, তাঁরাও ‘ভ্যাক্সি’ তুলতে চান। আমি নিজেই অনেকের ‘ভ্যাক্সি’ তুলে দিয়েছি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে বলা হয়। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কি না, সেটা দেখার জন্য। অনেকেই ওই ১৫ মিনিটের মধ্যে ‘ভ্যাক্সি’ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোডও করে দিয়েছেন।”

সাধারণ মানুষের ভয়, সংশয়, দ্বিধা কাটানোর ক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসূ এই ‘ভ্যাক্সি’?

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর সহেলি দত্তর উত্তর, “আমার তো মনে হয় ‘ভ্যাক্সি’ সাধারণ মানুষের ভয়, সংশয়, দ্বিধা কাটাতে সাহায্য করবে। কারণ ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা ‘ভ্যাক্সি’-র সঙ্গে এই ক্যাপশনই পোস্ট করছেন: ‘আমি নিয়েছি। ভাল আছি। আপনারাও নিন।” তবে এ প্রসঙ্গে একটি অন্য বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সহেলি, “যাঁদের কাছে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট পরিষেবা সহজলভ্য তাঁদের কাছে অন্যের তোলা এই ‘ভ্যাক্সি’র খবর পৌঁছে যাবে সহজেই। কিন্তু যাঁরা স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট পরিষেবা পান না, তাঁরা কী করবেন? আদৌ ভ্যাকসিন নেবেন কি না অথবা তাঁদের ভয় কমবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।”

‘ভ্যাক্সি’ নিছক সাময়িক সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড নাকি সত্যিই সে সাধারণ মানুষের ভয়, সংশয়, দ্বিধা কাটাতে সাহায্য করবে—সে সব বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে সিরিঞ্জের মৃদু খোঁচা শেষে আপনি অন্তত এটুকু গেয়ে উঠতেই পারেন ‘চল বেটা ভ্যাক্সি লে-লে রে…’

গ্রাফিক্স ও অলংকরণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

Next Article