মমতা লড়ুক, আমরাও লড়ব, বিজেপি বিরোধিতার প্রতিযোগিতা হোক: দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

Devender Rana | Edited By: TV9 Bangla

Dec 11, 2023 | 7:22 PM

বিজেপি এখানে সুযোগ পাবে না, বাংলা বাঁচবে এবং বাঁচাবে... বিহার ভোটে লিবারেশনের সাফল্য। বামেদের উত্থান। হঠাৎ শিরোনামে এনেছে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে। বিজেপির চোখে চোখ রেখে এই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা কেমন? বাংলায় এর প্রভাব কতটা পড়বে? কে হবেন বাংলার বাম মুখ? কার বিরুদ্ধেই বা হবে লড়াই?

Follow Us

বিহার ভোটে লিবারেশনের সাফল্য। বামেদের উত্থান। হঠাৎ শিরোনামে এনেছে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে। বিজেপির চোখে চোখ রেখে এই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা কেমন? বাংলায় এর প্রভাব কতটা পড়বে? কে হবেন বাংলার বাম মুখ? কার বিরুদ্ধেই বা হবে লড়াই? ময়দানে হাঁটতে হাঁটতে সব প্রশ্নের অকপট জবাব দিলেন সিপিআইএমএল (CPI ML) – লিবারেশনের সর্বভারতীয় সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (Dipankar Bhattacharya)।

 

প্রশ্ন: বিশ্বাস করেন, ভারতবর্ষের মতো দেশে বিপ্লব সম্ভব?

উত্তর: অবশ্যই। তবে একটা কথা বলি, ছোটবেলায় বিপ্লব বলতে যা বুঝতাম এখন তার ব্যাপ্তি অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। আমার কাছে বিপ্লব মানে একটা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, জরুরি পরিবর্তন, যে পরিবর্তন সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। জনগণের হাতে ক্ষমতা দেয়। আমার কাছে বিপ্লবের জন্য যে প্রস্তুতি এবং প্রচেষ্টা সেটাও যেমন বিপ্লব, বিপ্লব হয়ে যাওয়ার পরে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টাটাও বিপ্লব। বিপ্লব কোনও ইভেন্ট নয়। একটি প্রক্রিয়া।

 

প্রশ্ন: আপনি তো বরাবরই কৃতী ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে অসমান্য রেজাল্ট আপনার। তার উপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মতো একটা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন। স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে উচ্চশিক্ষাতেও দারুণ সাফল্য। এসবের মধ্যে থেকে বাম রাজনীতি-বিপ্লবের স্বপ্ন এগুলো কোথা থেকে চলে এল?   

উত্তর: কোনওদিন ভাবিইনি। আমার বাবা রেলে চাকরি করতেন। ছোটবেলা কেটেছে জলপাইগুড়িতে। আলিপুরদুয়ার রেলওয়ে জংশন স্কুলে আমি ক্লাস ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। সে সময়টা হচ্ছে সাতষট্টি থেকে তিয়াত্তর। সেটা ছিল অদ্ভুত ঝোড়ো সময়। দেওয়ালে আঁকা থাকত ভারতবর্ষের মানচিত্র। লেখা থাকত, সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত কর। তখন থেকেই প্রশ্ন জাগল, দেশ তো স্বাধীন, তাহলে স্বাধীন দেশে আবার এই মুক্তির কথাটা উঠছে কেন? নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার সময় থেকেই মাথায় পোকাটা ঢুকে গেল। তারপর থেকে কখনও অন্য কিছুর কথা ভাবিইনি। আমি যেখানে কাজ করছি এবং যে কাজটা করছি, তাতে হান্ড্রেড পারসেন্ট জব স্যাটিফ্যাকশন পেয়েছি। আমি সৌভাগ্যবান। জীবনে যা করতে চেয়েছি, তাই করছি।

 

প্রশ্ন: সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহ, পরিস্থিতি যা ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে কেন জ্যোতি বসুর পথে হাঁটলেন না? চারু মজুমদারের পথই কেন বেছে নিলেন?

উত্তর: জ্যোতি বসুর আগে চারু মজুমদার। ক্রোনোলজিতেও। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় জ্যোতিবাবু রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মানে, পুলিসমন্ত্রী। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলনকে দমন করার জন্য যে ভূমিকাটা তাঁদের ছিল, ছোটবেলা থেকেই সেই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগেনি। পরবর্তীতে যত বড় হয়েছি, মার্ক্সবাদ বুঝেছি, ততই সিপিএম সম্পর্কে আমার কোনও রাজনৈতিক আকর্ষণ তৈরি হয়নি।

কৃষকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

 

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ের বিহার ভোট, ভোটের ফল সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে সংবাদ শিরোনামে নিয়ে এসেছে। আরও বেশি করে নিয়ে এসেছে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে। এই সাফল্যকে কীভাবে দেখছেন

উত্তর: বিহার ভোটের ফলাফলে পুরোপুরি স্যাটিসফাইড নই। যেটা আমাদের লক্ষ্য ছিল, এনডিএ-কে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়া, সেই কাজটা আমরা শেষ পর্যন্ত পারলাম না। তবে বারোটা সিটে আমরা জিতেছি, সেটার জন্য আলাদা করে একটা তৃপ্তি তো আছেই।

 

প্রশ্ন: বিজেপির সঙ্গে এই সম্মুখ সমর থেকে কী উপলব্ধি হল?

উত্তর: বিজেপি নাকি বিশ্বের বৃহত্তম পার্টি! ভারতবর্ষে এতো ক্ষমতাশালী পার্টি এর আগে কখনও নাকি ছিল না! টাকাপয়সা থেকে শুরু করে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিও বিরাট। সেই তারা কিনা আমাদের মতো একটা ছোট পার্টি, মাত্র তিনটে এমএলএ ছিল, সেই পার্টিকে বেছে নিল নিজেদের সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে। আসলে আদর্শগত লড়াই। আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাটাকও হল বিরাট। দেশদ্রোহী, টুকরে টুকরে গ্যাং, যা যা ওরা বলতে পারে, বলল। সেই জায়গা থেকে বারোটা সিট জিততে পারা, নিঃসন্দেহে আত্মতৃপ্তির।

 

প্রশ্ন: তিন থেকে বারো। স্ট্রাইকরেট ষাটেরও বেশি। কীভাবে সম্ভব হল?

উত্তর: এটা একদিনে সম্ভব হয়নি। যেসব জায়গাগুলোতে আমরা জিতেছি, সেইসব জায়গাগুলোতে আমাদের পার্টি বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে কাজ করছে। এর মধ্যে বেশকিছু সিটে আমরা আগেও জিতেছি, এককভাবে লড়ে। তবে এবার এমন ফল সম্ভব হল মূলত দু’-তিনটে কারণে। প্রথমত, লকডাউন পর্যায়ে মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ওরা বলে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। পশ্চিমবঙ্গেও বলবে। কেন্দ্রে-রাজ্যে যদি একই সরকার থাকে, তাহলে নাকি দারুণ গতিতে উন্নয়ন হবে। অথচ বিহারবাসী দেখল, ইঞ্জিন আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই। মানুষের পাশে কেউ নেই। কেবল আমরাই ছিলাম। লকডাউনের এই পর্যায়টা নিশ্চয়ই আলাদা একটা মাত্রা এনে দিয়েছে। এছাড়াও, সাম্প্রতিক কালের কিছু আন্দোলন। জমির দাবিতে, মজুরির দাবিতে, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষার দাবি, সুনিশ্চিত কাজের দাবিতে আমরা লাগাতার আন্দোলন করেছি। যা ভোটের ইস্যু হয়ে উঠেছিল। এর বাইরেও জোটের তো একটা ভূমিকা থাকেই। ভোট কাটাকুটি আটকে দেওয়া যায়।

 

প্রশ্ন: এসবের পরও তীরে এসে তরী ডুবল কেন?

উত্তর: অনেকগুলো কারণ আছে। বিহারের শেষ দফা ভোটে, বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে ভোটের ক্ষেত্রে, আরারিয়া, কাটিহার, কিষাণগঞ্জ ছাড়াও মিথিলা, দরভঙ্গা, মধুবনি, সমস্তিপুর – এই দিকটায় মেরুকরণের রাজনীতি করেছে বিজেপি। ওরা যেখানেই দেখে ২০ শতাংশ, ২৫ শতাংশ, ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার আছে সেখানেই পাল্টা হিন্দু কনসলিডেশন করার চেষ্টা করেছে। সেটা নিশ্চয়ই ফল দিয়েছে। আর একটা বড় কথা, আমাদের আন্দোলন দক্ষিণ বিহারে যতটা শক্তিশালী তা সর্বত্র নয়। এরপর, শেষ দফায় জোটের একটা বড় নির্ভরতা ছিল কংগ্রেসের ওপর। সেটা হল না। ৭০টা আসন নিয়ে ১৯টায় জিতেছে। তো সেটাও একটা কারণ তো বটেই।

 

প্রশ্ন: বিহার ভোটের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে কতটা প্রভাব ফেলবে বলে আপনার মনে হয়?

উত্তর: পশ্চিমবাংলার জন্য তো বটেই গোটা দেশেও এর প্রভাব পড়বে। সাধারণত হিন্দি বলয়কে ধরে নেওয়া হয় বামপন্থার জন্য কঠিন জায়গা। সেখানে বামপন্থা জায়গা করে নিতে পারছে এবং সেটাও ২০২০ সালে বিজেপির এই দাপটের মুখে দাঁড়িয়ে এবং কোভিড ও লকডাউনের মতো অত্যন্ত জটিল সময়ে, সেটা বিরাট ব্যাপার। বাংলায় এর প্রভাব পড়বে। কারণ, বিহারে যে বিপদের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি সেই বিপদটা বাংলায় ক্রমশ বাড়ছে। বিজেপি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াটা তাই বামপন্থার এ বি সি ডি। বিজেপির বিরুদ্ধে যে যতটা ভাল করে লড়তে পারবে, সেটাই হল বামপন্থার পরীক্ষা। আগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়েছি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়েছি। বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে লড়েছি। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারছি না – এটা যদি হয়, তাহলে সেটা হবে বামপন্থীদের দুর্বলতা।

জনসভায় বক্তৃতা করছেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

এটা শুধু বামপন্থীদের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন বাংলার সাধারণ মানুষেরও। ‘বিজেপি বাংলায়’, এর মানেটা কী? তাদের কাছে লক্ষ্যটা হল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। সমস্ত রাজ্য জয় করে নিতে হবে। বাংলার কী প্রয়োজন, বাংলার মানুষ কী চায়, বাংলার জন্য কী ভাল হবে, এটা তো বিজেপির প্রশ্নই নয়। যেমন ধরুন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিল। গোটা কাশ্মীরটা একটা জেলখানা হয়ে গেল। মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, কাশ্মীরের মানুষের দিন কীভাবে কাটছে সেটা নিয়ে বিজেপির কোনও মাথাব্যথাই নেই।

বাংলায় বিজেপি এলে এনআরসি করবে। অসমে একটা এনআরসি করেছে। ২০ লক্ষ লোক বাদ গেছে। ৫ লক্ষ মুসলিম ১৫ লক্ষ হিন্দু। বাংলায় কেউ বলছে, ৫০ লক্ষ বের করে দেব। কেউ বলছে ১ কোটি বের করে দেব। এটা হলে গোটা পশ্চিমবঙ্গ একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হবে। গোটা বাংলা ডিটেনশন ক্যাম্প হয়ে যাবে। মানুষের জীবনে শান্তি বলে কিছু থাকবে না। বাংলা আর সোনার বাংলা থাকবে না। বাংলা ছাড়খার হয়ে যাবে। এটা শুধু বামপন্থীদের ভাবার বিষয়ই নয়, সবাই ভাববে।

ওরা বিবেকানন্দের ছবি নিয়ে ঘুরে বেরায়। সম্প্রতি একটা কথা উঠেছে ‘ইনটলারেন্স’ (অসহিষ্ণুতা)। বিজেপি কাউকে সহ্য করে না। বিবেকানন্দ শুধু সহ্য করার কথা বলেননি, বলেছেন গ্রহণ করার কথাও। ডিফারেন্সকে অ্যাকসেপ্ট করা। বিরাট বড় কথা। বিবেকানন্দের বাণী যদি এটা না হয়ে হয়, বিবেকানন্দের ছবি নিলাম আর জয় শ্রীরাম বলে মুসলিম বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দিলাম, বিবেকানন্দ তো মুসলিম বস্তিতে আগুন জ্বালানোর জন্য নয়।

দেশভাগ থেকে দাঙ্গা, সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পঞ্জাব ও বাংলা। সবথেকে বড় মাইগ্রেশন হল। আমরা তো সেখান থেকে এগিয়ে এসেছি। আমাদের আবারও সেখানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? বিহার শেষ পর্যন্ত পারল না, তবে বাংলা পারবে।

কিছু মানুষকে ক্ষেপিয়েছে। তবে বিজেপি এলে বাংলার মানুষ কিছু পাবে না। পাবে অমিত শাহ। যোগী। আরএসএস। এখন প্রশ্ন, বাংলা ঠেকে শিখবে না, দেখে শিখবে। আমার মনে হয় দেখে শিখবে।

 

 

 

 

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বামপন্থীদের চ্যালেঞ্জ কী? তৃণমূলকে হারানো নাকি বিজেপিকে ঠেকানো?

উত্তর: আমার মনে হয় বামপন্থী বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এতো সংকীর্ণ পরিসরে ভাবে না। যেভাবে হোক তৃণমূলটা যাক! নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ব্যপার – আমার মনে হয় না এটা কোনও বামপন্থী বোধবুদ্ধির কথা। এমনকি এটা সাধারণ রাজনৈতিক বিবেচনা বোধের মধ্যেও পড়ে না। বাংলায় গণতন্ত্রের কথা বলে, মা মাটি মানুষের কথা বলে যে সরকার এল এবং যা কিছু হয়েছে, তাতে বিজেপি সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। যা কিছু হয়েছে আমরা সবাই দেখছি। তবে এর থেকেও বড় বিপদ সামনে।

 

প্রশ্ন: মানুষ তো বিকল্প খুঁজছে। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা আর কোনওভাবেই বিকল্প নয়…

উত্তর:  মানুষ বিকল্প খোঁজে না। যারা ক্ষমতা চাইছে তারাই এই বিকল্প খোঁজে। মানুষ ন্যায় খোঁজে। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কীভাবে বেঁচে থাকব, মানুষ এটা খোঁজে। বিজেপি বাংলায় বলছে, হিন্দুরা বাংলায় বিপন্ন। মমতা বাংলায় মুসলিম তোষণ করছে। হিন্দু বিপন্ন মানেটা কী? আজ হরিয়ানার কৃষকরা বিপন্ন। এঁদের ৮০ শতাংশই তো হিন্দু। যেসব প্রবাসী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে এল, কেউ গুনতে গেছে কতজন হিন্দু আর কতজন মুসলিম, এদের অধিকাংশই হিন্দু, এঁদের কথা কেউ বলছে না। অসমে ২০ লক্ষের মধ্যে ১৫ লক্ষ হিন্দু বাদ চলে গেল, এই হিন্দুদের কথা তো কেউ বলছে না।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক ফ্রেমে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

এই সরকার (তৃণমূল) না গেলে মানুষের ঘুম আসছে না, তা কিন্তু নয়। এটা একটা ম্যানুফ্যাকচরড ব্যপার। মানুষের প্রশ্ন বিকল্প নীতির। সব নির্বাচনেই একটা অল্টারনেটিভ আনতে হবে, তার কী মানে আছে? ৩৪ বছর তো বামপন্থীদের সরকার ছিল। মানুষকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সরকার ফেলে দেওয়া মানুষের এজেন্ডা নয়। এটা বিজেপির এজেন্ডা।

 

প্রশ্ন: এই রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস জোট করে লড়ার পথে এগোচ্ছে। আপনার কী মনে হয়, এই জোটের থেকেও রাজ্যে আরও বৃহৎ জোটের প্রয়োজন? সেখানে কী তৃণমূল নেতৃত্ব দেবে?

উত্তর: তৃণমূল সরকারি ক্ষমতায় আছে। সেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বড় বিক্ষোভ আছে। সিপিএম-এর বন্ধুরা কথা চালাচ্ছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। ষোলোতে অঘোষিত একটা জোট করল। উনিশে শুনছিলাম খোলাখুলি একটা জোট হবে। সেই জোট হতে হতে কেন হল না জানি না।

 

প্রশ্ন: আপনি কি চান, জোট হোক?

উত্তর: আমি সবার আগে চাই বামপন্থীরা উঠে দাঁড়াক। কংগ্রেস কিছু জেলায় আছে। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামেরা ক্ষমতায় ছিল। সেই বাম ঐতিহ্য উঠে দাঁড়াক। গান্ধীর কংগ্রেস। নেহরুর কংগ্রেস। সুভাষ বসুর কংগ্রেস। সেই ঐতিহ্যও বেঁচে থাকুক।

 

প্রশ্ন: বিজেপি সব রাজ্যেই সব ভোটে কোনও একটি মুখকে সামনে রেখে লড়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেল বামেদের মুখ কে

উত্তর: বিজেপির মুখ একটাই। এবার পঞ্চায়েতেও সেই মুখটা দেখাবে। এক দেশ। এক মুখ। বিজেপির কাছে মুখ বৈচিত্র কোথায়? বামেদের মুখ মিছিলে হাঁটা মানুষ, আন্দোলন করা কৃষক। বামেদের কি কোনও দিনই মুখের অভাব হয়েছে?

 

প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ রেখে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াই, এটাও কি সম্ভব

উত্তর: মমতা মমতার মতো করে বিজেপি বিরোধিতা করুক। আমরা আমাদের মতো বিরোধিতা করি। বিজেপি বিরোধিতার প্রতিযোগিতা হোক। তৃণমূল সরকারে আছে, সরকার সরকারের মতো লড়ুক। জনগণ জনগণের মতো করে লড়ুক। বামপন্থীরা বামপন্থীদের মতো করে লড়ুক। আমরা বেশি বিজেপি বিরোধী না তৃণমূল বেশি বিজেপি বিরোধী এই প্রশ্নটার বদলে এমনটা হোক না, সরকার সরকারের মতো লড়ুক। আমরা মাঠে নেমে, মানুষের সঙ্গে লড়ব। লড়াইটা জমে উঠুক।

 

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে আপনি সেই লেটার মার্কস পাওয়া ছাত্র, যে তার বন্ধুদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। বিহারে আপনার কমরেড‘-রা করে দেখিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বামপবন্থীদের কী পরামর্শ আপনার?

উত্তর: আমরা জেতার পর মানুষের চোখে পড়েছে। এই জয়ের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম। প্রচুর কাজ। লেগে থাকা। মানুষের মধ্যে পড়ে থাকা। আগে কমিউনিস্টরাই এই কাজ করত। এখন আরএসএসও করছে। বাংলার মাটি বামপন্থীদের ঘাঁটি। সেই জায়গা ফেরাতে হবে।

বামপন্থীদের যে গ্রহণযোগ্যতা কৃষক, শ্রমিকের কাছে ছিল যা সিঙ্গুর পরবর্তী সময়ে মমতা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, তা ফেরাতে হবে। শুধু সোশাল মিডিয়ায় হবে না। ওটা থাকুক। মানুষের কাছে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই। আমরা ভুলে যাই, বামফ্রন্ট সরকারের আগেও একটা বামপন্থা ছিল। চল্লিশের দশকেও বামপন্থীরা ছিল। না থাকলে দেশভাগ, দাঙ্গা সেই সময়ের লড়াইটা কে লড়ত? সে সময় বামপন্থীরা লড়াই করেছিল বলেই ভোটে মানুষ বামপন্থীদের সুযোগ দিয়েছে। বারে বারে সুযোগ দিয়েছে।

সিপিএম-এর বন্ধুদের বলছি, এই ভোট কোনও পার্টির ক্রিয়েট করা ভোট নয়। কোনও নেতার ভাষণে পাওয়া ভোট নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভোট। এই ভোট বাচাঁনোর জন্য বামপন্থীদের লড়া উচিত। বামপন্থা মানে কয়েকটা দল না, শুধু আলিমুদ্দিন স্ট্রিট দিয়ে হবে না এটা। বামপন্থা বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের বোধ। বিশ্বাস করি, বিজেপি এখানে সুযোগ পাবে না, বাংলা বাঁচবে এবং বাঁচাবে।

 

 

বিহার ভোটে লিবারেশনের সাফল্য। বামেদের উত্থান। হঠাৎ শিরোনামে এনেছে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে। বিজেপির চোখে চোখ রেখে এই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা কেমন? বাংলায় এর প্রভাব কতটা পড়বে? কে হবেন বাংলার বাম মুখ? কার বিরুদ্ধেই বা হবে লড়াই? ময়দানে হাঁটতে হাঁটতে সব প্রশ্নের অকপট জবাব দিলেন সিপিআইএমএল (CPI ML) – লিবারেশনের সর্বভারতীয় সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (Dipankar Bhattacharya)।

 

প্রশ্ন: বিশ্বাস করেন, ভারতবর্ষের মতো দেশে বিপ্লব সম্ভব?

উত্তর: অবশ্যই। তবে একটা কথা বলি, ছোটবেলায় বিপ্লব বলতে যা বুঝতাম এখন তার ব্যাপ্তি অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। আমার কাছে বিপ্লব মানে একটা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, জরুরি পরিবর্তন, যে পরিবর্তন সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। জনগণের হাতে ক্ষমতা দেয়। আমার কাছে বিপ্লবের জন্য যে প্রস্তুতি এবং প্রচেষ্টা সেটাও যেমন বিপ্লব, বিপ্লব হয়ে যাওয়ার পরে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টাটাও বিপ্লব। বিপ্লব কোনও ইভেন্ট নয়। একটি প্রক্রিয়া।

 

প্রশ্ন: আপনি তো বরাবরই কৃতী ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে অসমান্য রেজাল্ট আপনার। তার উপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মতো একটা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন। স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে উচ্চশিক্ষাতেও দারুণ সাফল্য। এসবের মধ্যে থেকে বাম রাজনীতি-বিপ্লবের স্বপ্ন এগুলো কোথা থেকে চলে এল?   

উত্তর: কোনওদিন ভাবিইনি। আমার বাবা রেলে চাকরি করতেন। ছোটবেলা কেটেছে জলপাইগুড়িতে। আলিপুরদুয়ার রেলওয়ে জংশন স্কুলে আমি ক্লাস ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। সে সময়টা হচ্ছে সাতষট্টি থেকে তিয়াত্তর। সেটা ছিল অদ্ভুত ঝোড়ো সময়। দেওয়ালে আঁকা থাকত ভারতবর্ষের মানচিত্র। লেখা থাকত, সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত কর। তখন থেকেই প্রশ্ন জাগল, দেশ তো স্বাধীন, তাহলে স্বাধীন দেশে আবার এই মুক্তির কথাটা উঠছে কেন? নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার সময় থেকেই মাথায় পোকাটা ঢুকে গেল। তারপর থেকে কখনও অন্য কিছুর কথা ভাবিইনি। আমি যেখানে কাজ করছি এবং যে কাজটা করছি, তাতে হান্ড্রেড পারসেন্ট জব স্যাটিফ্যাকশন পেয়েছি। আমি সৌভাগ্যবান। জীবনে যা করতে চেয়েছি, তাই করছি।

 

প্রশ্ন: সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহ, পরিস্থিতি যা ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে কেন জ্যোতি বসুর পথে হাঁটলেন না? চারু মজুমদারের পথই কেন বেছে নিলেন?

উত্তর: জ্যোতি বসুর আগে চারু মজুমদার। ক্রোনোলজিতেও। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় জ্যোতিবাবু রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মানে, পুলিসমন্ত্রী। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলনকে দমন করার জন্য যে ভূমিকাটা তাঁদের ছিল, ছোটবেলা থেকেই সেই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগেনি। পরবর্তীতে যত বড় হয়েছি, মার্ক্সবাদ বুঝেছি, ততই সিপিএম সম্পর্কে আমার কোনও রাজনৈতিক আকর্ষণ তৈরি হয়নি।

কৃষকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

 

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ের বিহার ভোট, ভোটের ফল সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে সংবাদ শিরোনামে নিয়ে এসেছে। আরও বেশি করে নিয়ে এসেছে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে। এই সাফল্যকে কীভাবে দেখছেন

উত্তর: বিহার ভোটের ফলাফলে পুরোপুরি স্যাটিসফাইড নই। যেটা আমাদের লক্ষ্য ছিল, এনডিএ-কে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়া, সেই কাজটা আমরা শেষ পর্যন্ত পারলাম না। তবে বারোটা সিটে আমরা জিতেছি, সেটার জন্য আলাদা করে একটা তৃপ্তি তো আছেই।

 

প্রশ্ন: বিজেপির সঙ্গে এই সম্মুখ সমর থেকে কী উপলব্ধি হল?

উত্তর: বিজেপি নাকি বিশ্বের বৃহত্তম পার্টি! ভারতবর্ষে এতো ক্ষমতাশালী পার্টি এর আগে কখনও নাকি ছিল না! টাকাপয়সা থেকে শুরু করে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিও বিরাট। সেই তারা কিনা আমাদের মতো একটা ছোট পার্টি, মাত্র তিনটে এমএলএ ছিল, সেই পার্টিকে বেছে নিল নিজেদের সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে। আসলে আদর্শগত লড়াই। আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাটাকও হল বিরাট। দেশদ্রোহী, টুকরে টুকরে গ্যাং, যা যা ওরা বলতে পারে, বলল। সেই জায়গা থেকে বারোটা সিট জিততে পারা, নিঃসন্দেহে আত্মতৃপ্তির।

 

প্রশ্ন: তিন থেকে বারো। স্ট্রাইকরেট ষাটেরও বেশি। কীভাবে সম্ভব হল?

উত্তর: এটা একদিনে সম্ভব হয়নি। যেসব জায়গাগুলোতে আমরা জিতেছি, সেইসব জায়গাগুলোতে আমাদের পার্টি বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে কাজ করছে। এর মধ্যে বেশকিছু সিটে আমরা আগেও জিতেছি, এককভাবে লড়ে। তবে এবার এমন ফল সম্ভব হল মূলত দু’-তিনটে কারণে। প্রথমত, লকডাউন পর্যায়ে মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ওরা বলে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। পশ্চিমবঙ্গেও বলবে। কেন্দ্রে-রাজ্যে যদি একই সরকার থাকে, তাহলে নাকি দারুণ গতিতে উন্নয়ন হবে। অথচ বিহারবাসী দেখল, ইঞ্জিন আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই। মানুষের পাশে কেউ নেই। কেবল আমরাই ছিলাম। লকডাউনের এই পর্যায়টা নিশ্চয়ই আলাদা একটা মাত্রা এনে দিয়েছে। এছাড়াও, সাম্প্রতিক কালের কিছু আন্দোলন। জমির দাবিতে, মজুরির দাবিতে, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষার দাবি, সুনিশ্চিত কাজের দাবিতে আমরা লাগাতার আন্দোলন করেছি। যা ভোটের ইস্যু হয়ে উঠেছিল। এর বাইরেও জোটের তো একটা ভূমিকা থাকেই। ভোট কাটাকুটি আটকে দেওয়া যায়।

 

প্রশ্ন: এসবের পরও তীরে এসে তরী ডুবল কেন?

উত্তর: অনেকগুলো কারণ আছে। বিহারের শেষ দফা ভোটে, বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে ভোটের ক্ষেত্রে, আরারিয়া, কাটিহার, কিষাণগঞ্জ ছাড়াও মিথিলা, দরভঙ্গা, মধুবনি, সমস্তিপুর – এই দিকটায় মেরুকরণের রাজনীতি করেছে বিজেপি। ওরা যেখানেই দেখে ২০ শতাংশ, ২৫ শতাংশ, ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার আছে সেখানেই পাল্টা হিন্দু কনসলিডেশন করার চেষ্টা করেছে। সেটা নিশ্চয়ই ফল দিয়েছে। আর একটা বড় কথা, আমাদের আন্দোলন দক্ষিণ বিহারে যতটা শক্তিশালী তা সর্বত্র নয়। এরপর, শেষ দফায় জোটের একটা বড় নির্ভরতা ছিল কংগ্রেসের ওপর। সেটা হল না। ৭০টা আসন নিয়ে ১৯টায় জিতেছে। তো সেটাও একটা কারণ তো বটেই।

 

প্রশ্ন: বিহার ভোটের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে কতটা প্রভাব ফেলবে বলে আপনার মনে হয়?

উত্তর: পশ্চিমবাংলার জন্য তো বটেই গোটা দেশেও এর প্রভাব পড়বে। সাধারণত হিন্দি বলয়কে ধরে নেওয়া হয় বামপন্থার জন্য কঠিন জায়গা। সেখানে বামপন্থা জায়গা করে নিতে পারছে এবং সেটাও ২০২০ সালে বিজেপির এই দাপটের মুখে দাঁড়িয়ে এবং কোভিড ও লকডাউনের মতো অত্যন্ত জটিল সময়ে, সেটা বিরাট ব্যাপার। বাংলায় এর প্রভাব পড়বে। কারণ, বিহারে যে বিপদের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি সেই বিপদটা বাংলায় ক্রমশ বাড়ছে। বিজেপি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াটা তাই বামপন্থার এ বি সি ডি। বিজেপির বিরুদ্ধে যে যতটা ভাল করে লড়তে পারবে, সেটাই হল বামপন্থার পরীক্ষা। আগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়েছি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়েছি। বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে লড়েছি। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারছি না – এটা যদি হয়, তাহলে সেটা হবে বামপন্থীদের দুর্বলতা।

জনসভায় বক্তৃতা করছেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

এটা শুধু বামপন্থীদের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন বাংলার সাধারণ মানুষেরও। ‘বিজেপি বাংলায়’, এর মানেটা কী? তাদের কাছে লক্ষ্যটা হল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। সমস্ত রাজ্য জয় করে নিতে হবে। বাংলার কী প্রয়োজন, বাংলার মানুষ কী চায়, বাংলার জন্য কী ভাল হবে, এটা তো বিজেপির প্রশ্নই নয়। যেমন ধরুন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিল। গোটা কাশ্মীরটা একটা জেলখানা হয়ে গেল। মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, কাশ্মীরের মানুষের দিন কীভাবে কাটছে সেটা নিয়ে বিজেপির কোনও মাথাব্যথাই নেই।

বাংলায় বিজেপি এলে এনআরসি করবে। অসমে একটা এনআরসি করেছে। ২০ লক্ষ লোক বাদ গেছে। ৫ লক্ষ মুসলিম ১৫ লক্ষ হিন্দু। বাংলায় কেউ বলছে, ৫০ লক্ষ বের করে দেব। কেউ বলছে ১ কোটি বের করে দেব। এটা হলে গোটা পশ্চিমবঙ্গ একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হবে। গোটা বাংলা ডিটেনশন ক্যাম্প হয়ে যাবে। মানুষের জীবনে শান্তি বলে কিছু থাকবে না। বাংলা আর সোনার বাংলা থাকবে না। বাংলা ছাড়খার হয়ে যাবে। এটা শুধু বামপন্থীদের ভাবার বিষয়ই নয়, সবাই ভাববে।

ওরা বিবেকানন্দের ছবি নিয়ে ঘুরে বেরায়। সম্প্রতি একটা কথা উঠেছে ‘ইনটলারেন্স’ (অসহিষ্ণুতা)। বিজেপি কাউকে সহ্য করে না। বিবেকানন্দ শুধু সহ্য করার কথা বলেননি, বলেছেন গ্রহণ করার কথাও। ডিফারেন্সকে অ্যাকসেপ্ট করা। বিরাট বড় কথা। বিবেকানন্দের বাণী যদি এটা না হয়ে হয়, বিবেকানন্দের ছবি নিলাম আর জয় শ্রীরাম বলে মুসলিম বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দিলাম, বিবেকানন্দ তো মুসলিম বস্তিতে আগুন জ্বালানোর জন্য নয়।

দেশভাগ থেকে দাঙ্গা, সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পঞ্জাব ও বাংলা। সবথেকে বড় মাইগ্রেশন হল। আমরা তো সেখান থেকে এগিয়ে এসেছি। আমাদের আবারও সেখানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? বিহার শেষ পর্যন্ত পারল না, তবে বাংলা পারবে।

কিছু মানুষকে ক্ষেপিয়েছে। তবে বিজেপি এলে বাংলার মানুষ কিছু পাবে না। পাবে অমিত শাহ। যোগী। আরএসএস। এখন প্রশ্ন, বাংলা ঠেকে শিখবে না, দেখে শিখবে। আমার মনে হয় দেখে শিখবে।

 

 

 

 

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বামপন্থীদের চ্যালেঞ্জ কী? তৃণমূলকে হারানো নাকি বিজেপিকে ঠেকানো?

উত্তর: আমার মনে হয় বামপন্থী বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এতো সংকীর্ণ পরিসরে ভাবে না। যেভাবে হোক তৃণমূলটা যাক! নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ব্যপার – আমার মনে হয় না এটা কোনও বামপন্থী বোধবুদ্ধির কথা। এমনকি এটা সাধারণ রাজনৈতিক বিবেচনা বোধের মধ্যেও পড়ে না। বাংলায় গণতন্ত্রের কথা বলে, মা মাটি মানুষের কথা বলে যে সরকার এল এবং যা কিছু হয়েছে, তাতে বিজেপি সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। যা কিছু হয়েছে আমরা সবাই দেখছি। তবে এর থেকেও বড় বিপদ সামনে।

 

প্রশ্ন: মানুষ তো বিকল্প খুঁজছে। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা আর কোনওভাবেই বিকল্প নয়…

উত্তর:  মানুষ বিকল্প খোঁজে না। যারা ক্ষমতা চাইছে তারাই এই বিকল্প খোঁজে। মানুষ ন্যায় খোঁজে। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কীভাবে বেঁচে থাকব, মানুষ এটা খোঁজে। বিজেপি বাংলায় বলছে, হিন্দুরা বাংলায় বিপন্ন। মমতা বাংলায় মুসলিম তোষণ করছে। হিন্দু বিপন্ন মানেটা কী? আজ হরিয়ানার কৃষকরা বিপন্ন। এঁদের ৮০ শতাংশই তো হিন্দু। যেসব প্রবাসী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে এল, কেউ গুনতে গেছে কতজন হিন্দু আর কতজন মুসলিম, এদের অধিকাংশই হিন্দু, এঁদের কথা কেউ বলছে না। অসমে ২০ লক্ষের মধ্যে ১৫ লক্ষ হিন্দু বাদ চলে গেল, এই হিন্দুদের কথা তো কেউ বলছে না।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক ফ্রেমে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। ছবি – ফেসবুক

এই সরকার (তৃণমূল) না গেলে মানুষের ঘুম আসছে না, তা কিন্তু নয়। এটা একটা ম্যানুফ্যাকচরড ব্যপার। মানুষের প্রশ্ন বিকল্প নীতির। সব নির্বাচনেই একটা অল্টারনেটিভ আনতে হবে, তার কী মানে আছে? ৩৪ বছর তো বামপন্থীদের সরকার ছিল। মানুষকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সরকার ফেলে দেওয়া মানুষের এজেন্ডা নয়। এটা বিজেপির এজেন্ডা।

 

প্রশ্ন: এই রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস জোট করে লড়ার পথে এগোচ্ছে। আপনার কী মনে হয়, এই জোটের থেকেও রাজ্যে আরও বৃহৎ জোটের প্রয়োজন? সেখানে কী তৃণমূল নেতৃত্ব দেবে?

উত্তর: তৃণমূল সরকারি ক্ষমতায় আছে। সেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বড় বিক্ষোভ আছে। সিপিএম-এর বন্ধুরা কথা চালাচ্ছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। ষোলোতে অঘোষিত একটা জোট করল। উনিশে শুনছিলাম খোলাখুলি একটা জোট হবে। সেই জোট হতে হতে কেন হল না জানি না।

 

প্রশ্ন: আপনি কি চান, জোট হোক?

উত্তর: আমি সবার আগে চাই বামপন্থীরা উঠে দাঁড়াক। কংগ্রেস কিছু জেলায় আছে। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামেরা ক্ষমতায় ছিল। সেই বাম ঐতিহ্য উঠে দাঁড়াক। গান্ধীর কংগ্রেস। নেহরুর কংগ্রেস। সুভাষ বসুর কংগ্রেস। সেই ঐতিহ্যও বেঁচে থাকুক।

 

প্রশ্ন: বিজেপি সব রাজ্যেই সব ভোটে কোনও একটি মুখকে সামনে রেখে লড়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেল বামেদের মুখ কে

উত্তর: বিজেপির মুখ একটাই। এবার পঞ্চায়েতেও সেই মুখটা দেখাবে। এক দেশ। এক মুখ। বিজেপির কাছে মুখ বৈচিত্র কোথায়? বামেদের মুখ মিছিলে হাঁটা মানুষ, আন্দোলন করা কৃষক। বামেদের কি কোনও দিনই মুখের অভাব হয়েছে?

 

প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ রেখে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াই, এটাও কি সম্ভব

উত্তর: মমতা মমতার মতো করে বিজেপি বিরোধিতা করুক। আমরা আমাদের মতো বিরোধিতা করি। বিজেপি বিরোধিতার প্রতিযোগিতা হোক। তৃণমূল সরকারে আছে, সরকার সরকারের মতো লড়ুক। জনগণ জনগণের মতো করে লড়ুক। বামপন্থীরা বামপন্থীদের মতো করে লড়ুক। আমরা বেশি বিজেপি বিরোধী না তৃণমূল বেশি বিজেপি বিরোধী এই প্রশ্নটার বদলে এমনটা হোক না, সরকার সরকারের মতো লড়ুক। আমরা মাঠে নেমে, মানুষের সঙ্গে লড়ব। লড়াইটা জমে উঠুক।

 

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে আপনি সেই লেটার মার্কস পাওয়া ছাত্র, যে তার বন্ধুদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। বিহারে আপনার কমরেড‘-রা করে দেখিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বামপবন্থীদের কী পরামর্শ আপনার?

উত্তর: আমরা জেতার পর মানুষের চোখে পড়েছে। এই জয়ের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম। প্রচুর কাজ। লেগে থাকা। মানুষের মধ্যে পড়ে থাকা। আগে কমিউনিস্টরাই এই কাজ করত। এখন আরএসএসও করছে। বাংলার মাটি বামপন্থীদের ঘাঁটি। সেই জায়গা ফেরাতে হবে।

বামপন্থীদের যে গ্রহণযোগ্যতা কৃষক, শ্রমিকের কাছে ছিল যা সিঙ্গুর পরবর্তী সময়ে মমতা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, তা ফেরাতে হবে। শুধু সোশাল মিডিয়ায় হবে না। ওটা থাকুক। মানুষের কাছে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই। আমরা ভুলে যাই, বামফ্রন্ট সরকারের আগেও একটা বামপন্থা ছিল। চল্লিশের দশকেও বামপন্থীরা ছিল। না থাকলে দেশভাগ, দাঙ্গা সেই সময়ের লড়াইটা কে লড়ত? সে সময় বামপন্থীরা লড়াই করেছিল বলেই ভোটে মানুষ বামপন্থীদের সুযোগ দিয়েছে। বারে বারে সুযোগ দিয়েছে।

সিপিএম-এর বন্ধুদের বলছি, এই ভোট কোনও পার্টির ক্রিয়েট করা ভোট নয়। কোনও নেতার ভাষণে পাওয়া ভোট নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভোট। এই ভোট বাচাঁনোর জন্য বামপন্থীদের লড়া উচিত। বামপন্থা মানে কয়েকটা দল না, শুধু আলিমুদ্দিন স্ট্রিট দিয়ে হবে না এটা। বামপন্থা বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের বোধ। বিশ্বাস করি, বিজেপি এখানে সুযোগ পাবে না, বাংলা বাঁচবে এবং বাঁচাবে।

 

 

Next Article