উঠল বাই তো কটক যাই। এমন বাতিক সব বাঙালির মধ্যেই রয়েছে। রথ নিয়েও বাঙালির মনে দারুণ উত্তেজনা। রথের মেলা ও রথ টানা নিয়ে বাঙালি আদ্যোপান্ত নস্টালজিক। কথিত আছে, রথের রশি স্পর্শ করা বা ছুঁতে পাওয়া অত্যন্ত ভাগ্যের। শতজন্মের পাপ একনিমেষে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় বলে মনে করা হয়। রথের চাকা ও রশির যে কোনও অংশ ছুঁলে পুনর্জন্মের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রাচীন প্রথা মেনে,রথের মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। তাই রথের পাশাপাশি রশি স্পর্শ করলে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্পর্শ করার সামিল।
তবে রথযাত্রার শুরু কখনও এইভাবে ছিল না। প্রায় সাতশো বছর আগে রথযাত্রা পালিত হত দুটি পৃথক ভাগে। সেই সময় তিনটে নয়, ছয়টি রথ টানা হত। সেই সময় পুরীর মন্দির থেকে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলভদ্রকে নিয়ে তিনটি রথে করে গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু মাসির বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে পড়ত একটি বিশাল বলাগুণ্ডি নালা। মন্দির থেকে তিনটি রথ ওই নালার পার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হত, তারপর জগন্নাথ, বলভদ্র ও বোন সুভদ্রার মূর্তি রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করানো হত। নালার অপরপ্রান্তে অপেক্ষারত সাজানো তিনটি রথে বসিয়ে আবার টানা হত। নিয়ে যাওয়া হত গুন্ডিচা মন্দিরের দিকে। তবে একটা সময় পর সেই নালা বুজিয়ে দেওয়া হয়। রাজা কেশরী নরসিংহ পুরীর রাজ্যভার গ্রহণের পর একসময় এই বলাগুণ্ডি নালা বুজিয়ে দেওয়া দিয়েছিলেন। সেই সময়ের পর থেকে রথযাত্রা তিনটি রথেই পালিত হয়।
পুরীর মন্দির নিয়ে যেমন অলৌকিক কিছু ঘটনা রয়েছে, তেমনি রথযাত্রা নিয়েও রয়েছে অদ্ভূত ঘটনা। যা অবিশ্বাস্য ও মজার। সেই সব ঘটনাগুলি কতটা বাস্তবিক তা জানা যায় না, কিন্তু রথের দিন ও রথ উত্সবে ঘটে বেশ কিছু আশ্চর্য ঘটনা।
– রথের দিন প্রতি বছর বৃষ্টি হয়। এখনও পর্যন্ত একটি বছরও কাটেনি, যে সময় রথের দিন বৃষ্টি হয়নি।
– রথ তৈরির সময় নিমকাঠ ব্যবহার করা হয়। তবে রথ তৈরিতে কোনও রকম আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় না। পুরোটাই কাঠের হাতুরি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ের উন্নত প্রযুক্তির একচুলও সাহায্য নেওয়া হয় না এই রথনির্মাণে।
– এমনকি রথ নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য-প্রস্তর মাপগুলি হাতেই নেওয়া হয়। গজ-ফিতের কোনও কিথু ব্যবহার করা হয় না। শুধু তাই নয়, পেরেক, পিন বা নাটবল্টু থেকে শুরু করে কোনও ধাতুর কিছু ব্যবহার করা হয় না।
– রথ তৈরিতে যুক্ত থাকেন প্রায় ১৪০০ শিল্পী। বংশপরম্পরায় এই শিল্পীরা রথ তৈরির কাজ করে চলেছে তাঁরা। আজও তাঁরা রথ তৈরি করার কাজ করে থাকেন। আলাদা করে তাঁদের নিয়োগ করা হয় না। রীতি অনুযায়ী যুগ যুগ ধরে রথ তৈরির কাজ করেন।
– অনেকেই জানেন না। তিনটি রথ যেমন নিম কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়,তেমনি তিনটি রথের ভিতরে থাকে প্রায় ২০৮ কেজি সোনা দিয়ে সজ্জিত।
– রথযাত্রার নানা কথা ও তথ্য বিভিন্ন পুরাণেও উল্লেখ রয়েছে। রয়েছে লোকবিশ্বাসও।
– পুরীর রথ যাত্রা উত্সব বাংলায় সূচনা করেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। নীলাচল থেকে প্রথম রথযাত্রার ধারা বাংলায় নিয়ে আসেন। ওড়িশার পাশাপাশি বাংলাতেও রথের উত্সব প্রচলন শুরু হয়।