সুরকার জয় সরকারের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে হঠাৎই পোস্ট হচ্ছে একের পর এক ট্যাটু আর্টের ছবি। মহিলাদের স্বল্প পোশাক এবং নিতম্ব প্রদর্শন থেকে শুরু করে বাবা এবং সদ্যোজাতর খুনসুটি– জয়ের পেজ এখন ‘এ কী আজব কারখানা’। অন্যদিকে অভিনেত্রী মানালি দে তাঁর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে দেখছেন সব পোস্ট উধাও। নাম বদলে মানালির ইনস্টা অ্যাকাউন্ট হয়ে গিয়েছে ‘ইনস্টাগ্রামার’। তাঁর মালিক এখন অন্য কেউ! হ্যাকার-গ্রাসে জেরবার সেলেব থেকে সাধারণ।
গত ২০ জানুয়ারি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্ট করেন জয়। তাতে ফেসবুক হ্যাক হওয়ার খবর জানিয়ে জয় লেখেন, “আমার ফেসবুক পেজ হ্যাক হওয়ার কারণে কিছু অশ্লীল ভিডিও ইত্যাদি পোস্ট হচ্ছে I খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে I বন্ধুরা সঙ্গে থাকবেন I আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী”। কিন্তু প্রায় এক মাসের কাছাকাছি পৌঁছেও কোনও সুরাহা মেলেনি। এ প্রসঙ্গে জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি যেহেতু আমার পেজে প্রচুর বাজনা-গান পোস্ট করি আমার কাছে জানুয়ারির শুরুতে একটা লিঙ্ক যুক্ত মেল আসে কোনও একটি কিছু বিষয়ে কপিরাইট লঙ্ঘিত হয়েছে। বলা হয় আমি যদি সেই লিঙ্ক গিয়ে ব্যাপারটা না সামলাই তা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমার পেজটি মুছে ফেলা হবে। যেহেতু কপিরাইট ইনফ্রিঞ্জমেন্টের কথা বলা হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভুল করেই সেই লিঙ্কে ক্লিক করে ফেলি। আর তারপরেই…”।
জয়ের কাছ থেকেই জানা গেল, যে মেল আইডি থেকে লিঙ্কটি পাঠানো হয়েছিল তা অনেকটাই ফেসবুক সদৃশ। লিঙ্কে ক্লিক করার পরমুহূর্তেই জয় ভুল বুঝতে পেরে পাসওয়ার্ড বদলেও ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। সুতরাং হ্যাকার যে আটঘাট নেমেই কাজটি করেছেন আন্দাজ করাই যায়। ফল, জয়ের ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ফলোয়ারের পেজটি হ্যাকড এবং তা থেকে অশ্লীল ভিডিয়ো পোস্ট।
অন্যদিকে মানালি দে’র ক্ষেত্রে ঘটনাটি একেবারে আলাদা। তিনি কোনও লিঙ্ক ক্লিক করেননি জানিয়েছেন। হঠাৎই শনিবার অর্থাৎ গত কাল ইনস্টাগ্রাম খুলতে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। তাঁকে বলা হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে লগইন করে খুলতে। মানালি সেই চেষ্টাও করেন। লাভ হয়নি। উপরন্তু তাঁর ভেরিফায়েড প্রোফাইলের জায়গায় খুলে গিয়েছে আনকোরা নতুন একটি প্রোফাইল। মানালি বলেন, “যে হ্যাক করেছে ভাল করে স্টাডি করেই করেছে। তিন সপ্তাহ আগে আমার কাছে নোটিফিকেশন আসে যে কেউ আমার ইনস্টাগ্রামে ট্রেসপাসিং করার চেষ্টা করছে। তারপরেই আমি পাসওয়ার্ড বদলে দিই। তিন সপ্তাহ কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু কাল লগ ইন করতে গিয়েই দেখি এই কাণ্ড।” মানালি যোগ করেন,”যেহেতু আমার ব্লু-টিক প্রোফাইল ছিল তাই পুরোটা ওড়াতে পারেনি। তবে আমার যারা ফলোয়ার ছিল তারা যদি এখন আমার প্রোফাইল খোলে তবে সেখানে ‘নো পোস্ট’ দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে নাম বদলে ইনস্টাগ্রামার হয়ে গিয়েছে। আমি ইনস্টাগ্রামেও মেল করেছি। অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছি। কিন্তু যা বুঝছি, প্রোফাইল আর রিকভার করা হয়তো যাবে না।
ইতিমধ্যেই লালবাজারের সাইবার ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ জানিয়েছেন জয়, অন্যদিকে মানালি আপাতত বাইরে থাকায় সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ না জানালেও ফিরে এসে যে জানাবেন তা জানিয়েছেন টিভিনাইন বাংলাকে। জয় অবশ্য এরই মধ্যে নিজে থেকেই যোগাযোগ করেছেন ‘বেঙ্গল ওয়েব সলিউশন’-এর সঙ্গে। তাঁদের সাহায্যেই পেজটি পুনরুদ্ধারের আশায় আছেন তিনি। তবে এই গোটা ব্যাপারটা যে বেশ ‘হতাশাজনক’ তা স্বীকার করছেন সুরকার।
জয় হয়তো ফেরত পাবেন তাঁর পেজ, মানালিও হয়তো খুলবেন নতুন অ্যাকাউন্ট… তবে প্রশ্ন হল, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকার হ্যাকারগ্রাসের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কি কোনও উপায় নেই? হ্যাক যদি হয়েও সে ক্ষেত্রে আইন কী বলছে? ঠিক কী জরিমানা হতে পারে একজন হ্যাকারের? টিভিনাইন বাংলার তরফে আইনজীবী এবং সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ফেসবুক-ইনস্টাসহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলি সুরক্ষিত এন্সক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বলে তা হ্যাক করা অতটাও সহজ নয়। সেক্ষেত্রে নয় কোনও অযাচিত লিঙ্ক ক্লিক করে অথবা কারও সঙ্গে ভুলবশত পাসওয়ার্ড শেয়ার করা থেকে হ্যাকিং হতে পারে। হতে পারে পাসওয়ার্ড শেয়ার করলাম না কিন্তু কোথাও থেকে লগ ইন করে তা লগ আউট করতে ভুলে গেলাম।”
ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৬৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কারও অনুমতি ছাড়া কেউ যদি কারও অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে, তবে যার অ্যাকাউন্ট সেই ব্যক্তি পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। এ ছাড়াও যদি কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যের প্রোফাইলের অ্যাকসেস নেয় অর্থাৎ তাঁর ক্রিমিনাল মোটিফ থাকে সেক্ষেত্রে অপরাধীর তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং কয়েক লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।”
হালফিলের নতুন শব্দ ‘এথিকাল হ্যাকিং’য়ের ক্ষেত্রেও কি এই নিয়ম বলবৎ? বিভাসবাবুর সাফ উত্তর, “হ্যাকিং কোনও মজার বিষয় নয়। আমাদের দেশে হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে কড়া আইন রয়েছে। এথিকাল হ্যাকার বলে বাজারে যা প্রচলিত হয়েছে এটা পুরোটাই মিথ্যে। এরা আদপে ফ্রড। ভারতের আইনে এথিকাল হ্যাকারের কোনও জায়গা নেই। যে টুকু রয়েছে তা হল তদন্তের স্বার্থে আদালত যদি মনে করে সে ক্ষেত্রেই ছাড় রয়েছে, তা বাদে অন্য কোনও ব্যক্তি যদি ব্যক্তিগত ভাবে এ সব করে থাকেন তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।” বিভাসবাবু যোগ করেন, “বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এথিক্যাল হ্যাকিংয়ের নামে টাকা নিচ্ছে। সেগুলোও কিন্তু ফ্রড তৈরির কারখানা। তথাকথিত এথিক্যাল হ্যাকার হয়ে বেরিয়ে এরা কী করবে? ভারতে তো এমন কোনও আইনই নেই”, প্রশ্ন তাঁর।