অন্বেষা বিশ্বাস
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবী যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা প্রতি মুহূর্তেই মানুষ টের পাচ্ছে। আর বিজ্ঞানীরাও (Scientists) বার বার সতর্কবার্তা দিতে গিয়ে বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বের এমন হালের কারণ মানুষ নিজেই। আর তাই সব কিছুর ফল মানুষকেই পেতে হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে শুধু খরা-বন্য়া নয়, ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও বিরাট প্রভাব পড়বে। তখন আর শুধু আবহাওয়া সংক্রান্ত বিপর্যয় আসবে না। বরং সেই বিপর্যয় নেমে আসবে মানুষের জীবনে। জলবায়ু সংকটের (Climate Crisis) কারণে সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষিকাজ ও ফসল উৎপাদনে। কারণ যে হারে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে তাতে একের পর এক দুর্যোগ নিশ্চিত। এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, কোনও দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি কি এই বিষয়ে নজর রাখে? ফসলের ফলনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের (Climate Change) কীরূপ প্রভাব পড়বে তা নিয়ে গবেষণা চলছে কি? লোকসভায় এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবে।
তিনি বলেন, সরকার তার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাবের দিকে নজর রাখছে। আর এর জন্য় নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এটাও নিশ্চিত যে, জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতে ফলনের উপর প্রভাব ফেলবে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) কৃষির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছে। গবেষণায় যে ফলাফল বেরিয়ে এসেছে তা ভয়ানক। নতুন কৌশল এবং পদ্ধতি ব্যবহার না করা হলে ভবিষ্যতে আরও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।
চাল, গম, ভুট্টাজাত কোনও ফসলই পাওয়া যাবে না:
ICAR-এর সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, 2050 সালের মধ্যে ধানের ফলন 20 শতাংশ কমে যাবে। আর সেই সব ধান বৃষ্টিনির্ভর। দিনের পর দিন যে হারে বৃষ্টির হার কমছে, আর অসময়ে বাড়ছে, তাতে বৃষ্টিনির্ভর যে কোনও ধানের ফলন বিরাটভাবে হ্রাস পাবে। 2080 সালের মধ্যে 47 শতাংশ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে, যে ধান চাষে সেচ দেওয়া হয়, তা 2025 সালের মধ্যে 3.5 শতাংশ কমে যাবে। আর 2080 সালের মধ্যে 5 শতাংশ হ্রাস পাবে।
শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে 2050 সালের মধ্যে গমের ফসল 19.3 শতাংশ হ্রাস পাবে। আর 2080 সালের মধ্যে এটি 40 শতাংশে পৌঁছবে। ভুট্টার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা দেবে। 2050 সাল নাগাদ ভুট্টা উৎপাদন 18 শতাংশ এবং 2080 সালের মধ্যে 23 শতাংশ হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আপনার মনে হতে পারে 27 বছরে অনেক পরিবর্তন চলে আসবে। কিন্তু সেই সব পরিবর্তন যদি খারাপ হয়, তাহলে কী হবে? ইতিমধ্য়েই ভাবতে এই খারাপ প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তরফে, ভারতে জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। আর সেই রিপোর্টে যা উঠে এসেছে, তা আপনার রাতের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার জন্য় যথেষ্ট। যেখানে বলা হয়েছে, ভারতে 2022-এর 1 জানুয়ারি থেকে 31 অক্টোবর পর্যন্ত 308 দিনের মধ্যে 271 দিন কোথাও না কোথাও বিপর্যয় ঘটেছে। কখনও খরা তো আবার কখনও বন্যা। কখনও শিলাবৃষ্টি আবার কখনও ঝড়। বুঝতেই পারছেন এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ফসলের উপর। এই বিপর্যয়ের কারণে 18.1 লাখ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে।
কোন ঋতুতে কতগুলি বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল এবং সেই সব বিপর্যয়ের প্রভাব কৃষিতে কীভাবে পড়েছিল?
মধ্য ভারতে 1.36 লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে:
ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চল অর্থাৎ গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় এবং ওড়িশায় 1 জানুয়ারি থেকে 31 অক্টোবর, 2022-এর মধ্যে 198 দিন বিপজ্জনক আবহাওয়ার মধ্য়ে দিয়ে কেটেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মধ্যপ্রদেশ। 1.36 লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
পূর্ব-উত্তরপূর্ব ভারতে 2.85 লক্ষ হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে:
পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে 191 দিন ধরে কোনও না কোনও বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। তারমধ্য়ে রয়েছে বিহার, ঝাড়খন্ড, সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়। খারাপ আবহাওয়ার কারণে 2 লাখ 85 হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল আসামের।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে এই রাজ্য়গুলিতে সবচেয়ে বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে:
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম রাজ্যগুলি যেমন জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থান 216 দিন ধরে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তরপ্রদেশের। 3.11 লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতে 10.73 লক্ষ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে:
দক্ষিণ ভারতের রাজ্য়গুলির মধ্য়ে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং কর্ণাটকে মোট 145 দিন খারাপ পরিস্থিতি ছিল। কর্ণাটকের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। 10.73 লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ভোলেনি মানুষ। দেশে খাদ্য সংকট তারপরে আর হয়নি। তবে জনসংখ্যা বেড়েছে উত্তরোত্তর। এগিয়েছে বিজ্ঞান। তবে মানুষ সচেতন না হলে সব চেষ্টাই বৃথা। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা রুখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে হবে মানুষকেই। দেশকে সুজলা সুফলা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে সামনে ঘোর বিপদ।