বীরভূম: দু’কামরার একটা ঘর। সামনের অংশে মুদি দোকান। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই সঙ্গীতা কেসরি সেই মুদি দোকানে বসেই গোটা সমাজের মহিলাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। মা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। স্বামীও সে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর পাঁচটা গার্হস্থ্য অনুশাসনের মতোই ছিল সংসার তাঁদের। কিন্তু কিছু সমস্যা ছিল। বারবার চেষ্টা করেও মা হতে পারছিলেন না সঙ্গীতা। প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো পথের ধারে বসে IVF-এর কথা ভাবা নিতান্ত বিলাসিতার মতন তাঁদের কাছে। কিন্তু সেই বিলাসিতা দেখানোর সাহস বুনেছিলেন দম্পতি। তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করছিলেন। কিন্তু মাঝে বাধ সাধে কোভিড। স্বামীকে হারান মহিলা। তারপর পুরোটাই একা। মহিলা দোকানে বসে সেই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মনে। আর তা সত্যি করলেন। ৪৮ বছর বয়সে এসে মা হলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পরও কীভাবে মা? আসলে স্বামী চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শুক্রাণু সযত্নে রেখে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আর তা শরীরে ধারণ করেই সন্তানের জন্ম দিলেন মহিলা। বীরভূমের মুরারইয়ের নিতান্ত দেহাতি এক মহিলার মা হওয়ার গল্প এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। গত ১১ ডিসেম্বর সুস্থ পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তাঁর মা এখনও ভর্তি রয়েছেন রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের CCU তে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে তিনি।
মহিলার বাবার বাড়ি নৈহাটিতে। বিয়ে হয়েছিল রামপুরহাটে। সুখের সংসারই ছিল। শুধু অভাব ছিল এক সন্তানের। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করান। মহিলার চিকিৎসক জানান, স্বামী বেঁচে থাকাকালীনই তাঁর IVF এ চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু মহিলার সন্তানধারণের কিছু সমস্যা ছিল। কলকাতার একটি পরীক্ষাগারে স্বামীর শুক্রাণু সংরক্ষণ করা হয়। মাঝে চিকিৎসা থমকে যায়। কারণ তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। পরে তিনি আবারও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
কুকথা-মন্দকথা কম শোনেননি। স্বামী মারা যাওয়ার পরও মা হবি? প্রশ্ন কম শুনতে হয়নি সঙ্গীতাকে। পাশে দাঁড়াননি বাবারবাড়ি, শ্বশুরবাড়ির কেউ। কিন্তু মা হওয়ার ইচ্ছা জিইয়ে রেখেছিলেন তিনি। তারপর রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে সন্তানের জন্ম দেন তিনি। ওই মহিলার চিকিৎসায় তৈরি হয় মেডিক্যাল বোর্ড। সেই বোর্ডে থাকেন দু’জন অ্যানাস্থেটিস্ট, এক জন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এবং এক জন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
মহিলার আইনজীবী জানিয়েছেন, স্বামী বেঁচে থাকার সময়ে ওই মহিলার সন্তান প্রসবের শারীরিক অসুবিধা ছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে সেই সমস্যা মিটে গেলেও মৃত্যু হয়েছিল স্বামীর। সে কারণেই এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনি।
যে বয়সে মহিলা সন্তানের জন্ম দিলেন, তা সাধারণ মেয়েদের মেনোপোজের সময়ে। এত বয়সে এসেও নিজের ইচ্ছা সাহসের সঙ্গে বাস্তবায়িত করায় সেলাম ঠুকছেন চিকিৎসকরাও। তবে হাসপাতালে সেই সদ্যোজাত কিংবা মহিলার বেডের পাশে এদিনও দেখা গেল না তাঁর একজন আত্মীয়কেও, সে শ্বশুরবাড়ির হোক কিংবা বাপের বাড়িই! আজ মহিলার পাশে কেবলই তাঁর ফুটফুটে পুত্রসন্তান।