কলকাতা: বিধানসভা ভোটের (Assembly Election Result 2021) আগে ভোট প্রস্তুতিই মূলত রাজনৈতিক দলগুলির চমক থাকে। তবে এবার, বাংলার বিধানসভা ভোট শুরুর আগে সেসব ছাপিয়ে গিয়েছিল দল বদলের হিড়িক। ‘হেভিওয়েট’ থেকে ‘চুনোপুঁটি’, যে যেমন পেরেছে, এক দল থেকে ঢুকে পড়েছে অন্য দলে। মূলত শাসকদল ছেড়ে বিজেপিতে ঢোকার ক্ষেত্রে এই ট্রেন্ড নজরে এসেছে। তবে উল্টোটাও হয়নি এমন নয়। একাধিক ‘দলবদলু’ ভোটের টিকিটও পেয়েছেন। কেউ কেউ তো আবার রীতিমত ‘বাজি’। রবিবার তাঁদের ভাগ্য পরীক্ষা হল। একইসঙ্গে মুখ রক্ষার লড়াইও। ছিল। হারলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, জিতেন্দ্র তিওয়ারিদের মত ‘দলবদলু’রা।
ভোটের মুখে যে দলবদল সবথেকে বেশি চর্চিত, নিঃসন্দেহে সেই নাম শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামের প্রাক্তন বিধায়ক এবং অবশ্যই বর্তমানে সেই কেন্দ্রেরই বিজেপির ‘তুরুপের তাস’। তাঁর টক্কর এবার ছিল পুরনো দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই কেন্দ্রে গণনার প্রতিটা মুহূর্ত একেবারে সাপলুডো খেলার মত করে এগিয়েছে। শেষ বলায় এগিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী।
বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের মুখে রীতিমত ‘কেঁদেকেটে’ তৃণমূল ছাড়লেন। যোগ দিলেন বিজেপিতে। ডোমজুড়ের বিদায়ী বিধায়ক তিনি। বিজেপি তাঁকে এই কেন্দ্রেই প্রার্থী করেছে। গণনার শুরুর পর প্রথম রাউন্ডে রাজীব এগিয়ে থাকলেও তৃতীয় রাউন্ডের শেষে এগিয়ে যান তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ ঘোষ। এরপর পিছতেই থেকেছেন রাজীব। তার জয় নিয়েও ইতিমধ্যেই সংশয় তৈরি হয়েছে। শেষবেলায় কোনও ম্যাজিক হয় কি না দেখার।
লোকসভা ভোটের আবহে দল বদল করেন বিধাননগরের দাপুটে নেতা সব্যসাচী দত্ত। রাজারহাট-নিউটাউন বিধানসভাই এতদিন তাঁর কেন্দ্র ছিল। বিজেপি এবার তাঁকে বাজি ধরেছিল তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক সুজিত বসুর বিধাননগর কেন্দ্রে। ভোটের ময়দানে যুযুধান সুজিত-সব্যসাচী। এই কেন্দ্র নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। শুধু তৃণমূল-বিজেপির লড়াইয়ের জন্যই নয়। সুজিত-সব্যসাচীর ‘লড়াই’-এর জন্যও বটে। এ কেন্দ্র ধরে রাখল সুজিত বসু। হারলেন সব্যসাচী।
বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ-এর স্ত্রী সুজাতা মণ্ডল খাঁ প্রথম থেকেই স্বামীর ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন। সৌমিত্র যখন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন সুজাতা চুটিয়ে প্রচার করেছিলেন স্বামীকে জেতাতে। এমনটাও বলা হয়, সৌমিত্রর বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে জয়ের অন্যতম কারিগর এই সুজাতা। কিন্তু একুশের ভোটের মুখে সকলকে অবাক করে তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দেন তিনি। তৃণমূল নেত্রী তাঁকে প্রার্থীও করেন আরামবাগ বিধানসভা কেন্দ্রে। গণনার শুরুতে এগিয়ে থাকলেও শেষবেলায় বিজেপি প্রার্থী মধুসূদন বাগের কাছে হেরে যান।
জিতেন্দ্র তিওয়ারি পশ্চিম বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরের দাপুটে নেতা। এত বছর আসানসোলের একটা বড় অংশে তৃণমূলের সংগঠনটা সামলেছেন তিনি। ভোটের মুখে হঠাৎ ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ক্ষোভ উগরে পদ্মশিবিরে ঢুকে পড়লেন তিনিও। পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী হলেও তৃণমূল প্রার্থী নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে হারলেন জিতেন্দ্র।
বালি কেন্দ্রে প্রার্থী বৈশালী ডালমিয়া। এতদিন তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দল ছাড়ার সময়ই তিনিও সুর বদল করেন। দলে তিনি কাজ করতে পারছেন না অভিযোগ তুলে বিজেপিতে যোগ দেন। বালি থেকে তিনিই এবার গেরুয়া শিবিরের মুখ। তৃণমূলের চিকিৎসক রানা চট্টোপাধ্যায়। এখনও অবধি যা ট্রেন্ড বৈশালী পিছিয়ে এই কেন্দ্রে।
সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার ‘মাস্টারমশাই’ বর্ষীয়ান রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সেই থেকে তাঁর সক্রিয় রাজনীতির হাতেখড়ি। এরপর বিধায়কও হলেন। কিন্তু একুশেরর বিধানসভা ভোটের মুখে যখন এ রাজ্যে বিজেপি একটু একটু করে মাটি শক্ত করছে, মমতার দল ছেড়ে বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনিও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার বলেই দিয়েছিলেন জটু লাহিড়ি বা রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর মত বয়স্ক নেতাদের টিকিট দেবেন না। এরপরই বিজেপিতে চলে যান রবীন্দ্রনাথ। বেচারাম মান্নার কাছে হারতে হয়েছে ‘মাস্টারমশাই’কে।
দল ভাল লোকেদের জন্য নয়। দলের বিরুদ্ধে এভাবেই ক্ষোভ উগরে তৃণমূল ছেড়েছিলেন উত্তরপাড়ার প্রবীর ঘোষাল। বার বার অভিযোগ তুলেছিলেন, তৃণমূলে কাজ করতে পারছেন না। ‘দলে নোংরামি হচ্ছে’। এরপর তিনিও বিজেপিতে যান। উত্তরপাড়ায় এবার প্রার্থী তিনি। তাঁর বিপরীতে তৃণমূলের মুখ কাঞ্চন মল্লিক। এখনও অবধি যা ট্রেন্ড এগিয়ে রয়েছেন কাঞ্চনই। পিছিয়ে প্রবীর ঘোষাল।