প্রীতম দে
মাছের বোঁটকা গন্ধে টেকা দায়। কিন্তু মানুষগুলোর মুখে ওসব বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই। কী সহ্য শক্তি রে বাবা। এখন সন্ধেবেলা। এই দেড়শো বছরের বেশি পুরনো প্রাচীন মাছের বাজারে সকালেই আসল বাজার। বিকেলে সব গোটানো থাকে। এক দু’জন বসেন এই যা।
ফাঁকা চাতালের ওপর বসে আছেন অশীতিপর চিত্রশিল্পী। পাশে রোল করে রাখা ছবি। পেন্টিং। অনেকগুলো। এগুলোই টাঙানো হচ্ছে মাছ বাজারে। বিশ্বের বোধহয় সর্ব প্রথম মাছের বাজারে চিত্র প্রদর্শনী।
শিল্পী আশি বছরের ‘তরুণ’ হিরণ মিত্র। কিন্তু এটা তো ক্ষ্যাপামো। বাজারে লোকে আসে মাছ কিনতে। ছবি কিনতে নয়। ছবি কিনবে বলে আপনার মনে হয়? স্রেফ চারজন চার রকম বলবে । That’s it। আসল কাজটা কী হবে? শিল্পের মূল্য উঠবে কী? শিল্পী তাকালেন। মোটা ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে আমার মুখের দিকে এক ঝলক দেখে বললেন, “ভায়া, এটা দ্বিতীয় বছর। গতবারের সাফল্যের জন্যই আবার আমরা ক্ষ্যাপামি করতে সাহস পাচ্ছি। তা ছাড়া স্টুডিওগুলোর যা অবস্থা। ভেতরে বাইরে সব দিক থেকেই কাজের অযোগ্য। আমার সঙ্গে ওদের হলায় গলায় সম্পর্কও নয়।”
এটা হাওড়ার কালীবাবুর বাজার। কালীবাবুর বাজার বিখ্যাত মাছের জন্য। হাওড়া ময়দানের ঠিক আগেই। দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে কালীবাবুর বাজার চালু রয়েছে। বাংলাদেশি ইলিশ থেকে শুরু করে বাগদা গলদা চিংড়ি কিংবা ভেটকি তোপসে সবই মেলে, একদম টাটকা। তিন পুরুষ ধরে মাছের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কালীবাবুর বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রতিকান্ত বর। জানাচ্ছেন গতবারের পর একরকম নেশাতেই পড়ে গিয়েছেন তাঁরা। মাছের বাজারের মধ্যেও এরকম সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হতে পারে সেটা গত বছর না দেখলে বুঝতে পারতেন না। শুধু হাওড়ার মানুষজনই নয়, কলকাতা থেকেও মানুষ এসেছেন দেখতে। এবার তাই ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকেই শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় মাছের বাজারের মধ্যেই।
যেরকম প্রদর্শনী আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্ত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার দেওয়ালের মধ্যে। দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি টাঙানো। এখানে একেবারেই অন্যরকম। যেন আকাশ থেকে পেন্টিং ঝুলছে, ফ্রেমে বাঁধানো নয়। ফ্রেম ছাড়া। কিন্তু প্রেম ছাড়া নয়। সিলিং থেকে ঝোলানো হয়েছে লম্বাটে সব ছবি। শিল্পী হিরণ মিত্র জানাচ্ছেন যে মাছের বাজারের কথা ভেবেই ছবিগুলি তৈরি করেছেন তিনি। কাগজে আঁকা ছবির সঙ্গে সঙ্গে অন্য মিডিয়াম রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু স্লোগান লেখা পোস্টারও। এসব পোস্টারে বেশি বিদেশি কবিদের কোটেশন তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের শঙ্খ ঘোষ যেমন আছেন তেমনি রয়েছে যুদ্ধ বিরোধী পোস্টারও। বড় কথা বললেন প্রবীণ এই শিল্পী। “ছবির এক্সিবিশন মানেই সেটা যে শুধুমাত্র এলিট ক্লাস বা সমাজের একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ গুটিকয়েক মানুষজনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে এই ধারণাকে আমি সমূলে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছি। মাছের বাজারে হাসা হাসি, ঠাট্টা তামাশা বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাতেই লাভের লাভই হয়েছে। ভিড় বেড়েছে বই কমেনি।”
শুধুমাত্র চিত্র প্রদর্শনী নয়, প্রতিদিন সন্ধের দিকে বাজার খালি হয়ে যাওয়ার পর মাছের চাতাল বদলে গেছে স্টেজে। একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়েছে।