Ranaghat: ‘পুজোই তো করতে চেয়েছিলাম, যা শিক্ষা হল…’ রেকর্ড গড়তে চেয়ে মহালয়াতেই সর্বস্ব হারিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন ওঁরা…
Ranaghat: কথাগুলো বলতে বলতে বারবারই দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন তিনি। সুজয় বললেন, "সামনে থেকে আলো দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পুরোটাই লোহার রডে ঘেরা ছিল। ৪০ বিঘা চাষিদের থেকে নিয়েছিলাম। তাছাড়াও আশপাশে আরও ৪০ বিঘা রয়েছে।
নদিয়া: তাক লাগাতে চেয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। রেকর্ড গড়তে চেয়েছিল রানাঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম কামালপুর। ১১২ ফুট দুর্গা বানিয়ে বাংলার অজানা প্রত্যন্ত এই গ্রামের নাম এখন খবরের শিরোনামে। এবারের পুজোর আবহে ‘১১২ ফুট’, কামালপুরের ‘অভিযান সঙ্ঘ’, ‘জেলাশাসকের অনুমতি’, আর কলকাতা হাইকোর্ট- শব্দবন্ধগুলো দীর্ঘ আলোচিত হয়েছে। মামলা মোকদ্দমার পথ পেরিয়ে বোধনেই বিসর্জন হয়ে গেল ১১২ ফুট দুর্গার। পুজোর অনুমতি নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই। এখন আর মামলার লড়ার সামর্থ্য নেই গ্রামের মানুষের। প্রশাসনের সঙ্গে লড়াইয়েই ক্ষমতাও নেই নিতান্ত সাধারণ দিন আনা দিন খাওয়া চাষি ভাইদের। তাই সামর্থ্যের কাছে ‘হার’ মেনে পুজো না করারই সিদ্ধান্ত নিলেন রানাঘাটের কামালপুরের অভিযান সঙ্ঘ ক্লাবের পুজো উদ্যোক্তারা। আর পুজো হচ্ছে না ১১২ ফুট দুর্গার। ফুঁপিয়ে কাঁদছে কামালপুর।
গ্রামের আশি শতাংশ মানুষই চাষাবাদ করেন। নিজের চাষের জমি দিয়েছিলেন পুজো করতে। কেউ সঞ্চয়ের অধিকাংশ টাকাই। কিন্তু ১১২ ফুট দুর্গা গড়ে বিশ্বে রেকর্ড গড়তে চেয়ে ‘অনাকাঙ্খিত’ আইনি লড়াইয়েই জড়িয়ে পড়েন না। কলকাতা হাইকোর্ট নদিয়ার জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছিলেন. পুজো অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে। কিন্তু ফল নেতিবাচক। পরের দিন আবারও আদালতে মামলার শুনানি। কিন্তু আর মামলা লড়ার পয়সা নেই গ্রামের মানুষের। তাই পুজো না করার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। পুজোর উদ্যোক্তা সুজয় বিশ্বাস বলেন, “আইনি লড়াই করতে গেলে যে পয়সার প্রয়োজন, তা আর গ্রামবাসীদের নেই। দুই-দুইবার জেলাশাসককে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে চূড়ান্ত অসহযোগিতা।”
জেলাশাসকের বক্তব্য, বিদ্যুৎ দফতর, দমকল, পুলিশ, বিডিও এবং রানাঘাটের মহকুমা শাসক (এসডিও) আবেদন বাতিল করেছেন। কিন্তু পুজোর উদ্যোক্তা বললেন, “স্ট্রাকচারের সঙ্গে কোনও বিদ্যুৎ কানেকশন নেই, যতটা উচ্চতা, প্যান্ডেল দূর থেকে দেখবে। সেটা ১৫০ ফুট বলেছিলাম। রাস্তা সচল রাখার জন্য একমুখী করার কথা বলেছিলাম। মাঠটা পুরো দিয়েছিলাম। চাষিরা বলেছিল, আরও জায়গা লাগলে, আরও দেবে। পকেট রোড করতে চেয়েছিলাম। যদি খুব বেশি ভিড় হয়, তাহলে ওই রাস্তা ধরে বেরিয়ে যাবে। আগুনের জন্য জলের ব্যবস্থা ছিল, পুকুর রয়েছে। একটা পাম্প রয়েছে, আগুন লাগলে ব্যবহৃত হতে পারত।”
কথাগুলো বলতে বলতে বারবারই দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন তিনি। সুজয় বললেন, “সামনে থেকে আলো দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পুরোটাই লোহার রডে ঘেরা ছিল। ৪০ বিঘা চাষিদের থেকে নিয়েছিলাম। তাছাড়াও আশপাশে আরও ৪০ বিঘা রয়েছে। রাস্তা ২৫ ফুট রয়েছে। এখানে তো আর বাস-লরি আসত না, মানুষই হেঁটে আসত। আমি ৫০০ ভলান্টিয়র দেওয়ার কথা বলেছি। নামও দিয়েছি। NCC ১০০ দিতে চেয়েছিলাম। এরপরও যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে, তাতে পদপিষ্ট হওয়ার বিষয়টিই বেশি দেখানো হয়েছে। ১৫ ফুট রাস্তা দেখানো হয়েছে। বিশ্বের বড় দুর্গা আর হল না।”
সুজয় সাফ জানালেন, ” আমরা কার সঙ্গে লড়াই করব? আমরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব না। আমাদের লড়াই করার জায়গাটাই নেই। সাধারণ মানুষ, সাধারণ গ্রামবাসী আমরা। পুরোটাই গ্রামবাসীর টাকা। এখনও পর্যন্ত ৬০ লক্ষ টাকা খরচা হয়েছে। কতবার আদালতে গিয়েছি। আর কারোর পকেটে টাকা নেই। কালকের কোর্টের পয়সাও আমাদের কাছে নেই। আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের আইনজীবীকে জানিয়ে দিয়েছি। পিটিশন উইড্র করার জন্য বলে দিয়েছি।” সুজয়ের কথায়, “একটা পুজো করতে গিয়ে আমাদের যা শিক্ষা হল…. পুজোই তো করছিলাম।”
গ্রামের মহিলারা কাঁদছেন। এই পুজো নিয়ে তাঁদের, গ্রামের বাচ্চাদের অনেক উচ্ছ্বাস ছিল। এক মহিলা বললেন, “আমাদের সবার চোখে জল। আমাদের মুখে আর ভাষা নেই। আশপাশের সব গ্রামের বাসিন্দাদেরই চোখে জল। মনে হচ্ছে শোক পড়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে পুজোই হচ্ছে না। আর বাচ্চাদের জামা কী করতে কিনে দেব! আমরা আশা করেছিলাম, দূর দূরান্ত থেকে লোক আসবে… আর তো কেউই আসবে না।”
হাউ হাউ করে কাঁদছেন শিল্পী। কথার বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই তিনি। শুধু বললেন, “৬ মাস ধরে গড়ে তুলছিলাম। আমাদের তিলোত্তমা অন্ধকারে। ধ্বংসই হবে। শিল্পের কোনও জায়গা নেই। এইভাবে লড়াই করা যাবে না। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে কাজ করেছি। এখানে পুলিশ সারাক্ষণ বসেছিল। বর্ষায় ঠাকুরে চোয়াল ভেঙে পড়েছিল। আমি ছুটে আসি ঠিক করতে, তখন তিন চার জন পুলিশ গিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।”