মেদিনীপুর: কলেজ মাঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোমবারের জনসভায় নজর ছিল দলীয়, বিরোধী সব শিবিরেরই। স্বভাবসিদ্ধভাবেই এই সভামঞ্চ থেকে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসকে এক যোগে বিঁধলেন তৃণমূল নেত্রী। একইসঙ্গে প্রচ্ছন্ন বার্তা পেল দলের ‘বেসুরো’রাও। এদিন মেদিনীপুরের সভা থেকে মমতার বার্তা, “বিজেপি ও বিজেপির বন্ধুদের বলব আগুন নিয়ে খেলবেন না।” মমতার সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ছত্রধর মাহাতো। এই প্রথমবার তৃণমূলের মঞ্চে মমতার সঙ্গে ছত্রধর। একুশের ভোটে ছত্রধরকেই যে জঙ্গলমহলের ‘মুখ’ করে তুলতে চায় তৃণমূল, এদিনের পর তা অনেকটাই স্পষ্ট। মঞ্চে ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সি, মানস ভুঁইয়্যা, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-সহ অন্যান্য নেতারা। জেলার নেতা, বিধায়করা এদিনের সভায় থাকলেও অধিকারী পরিবারের কোনও প্রতিনিধিই ছিলেন না।
‘আমরা কৃষকদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব। ভারতবর্ষের যে কৃষকরা আন্দোলন করছেন বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের পাশে আমরা আছি। আমি নেতাই, সিঙ্গুর ভুলিনি। আমি ভারতবর্ষ ভুলিনি। আমরা অতীতকে ভুলি না। আমরা সরকারে থেকে কোনও বনধকে সমর্থন জানাইনি। তবে তৃণমূলের দলের তরফে আমরা আগামিকাল কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছি। কৃষি বিল প্রত্যাহার করো, না হয় বিজেপি সরকার ভারত ছাড়ো। কাল থেকে প্রত্যেকটা ব্লকে ব্লকে কৃষকদের সমর্থনে ধরনা হবে।’
‘লুঠেরাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে বিজেপি। দেখুন কীভাবে দল ভাঙছে। কীভাবে সরকার ভাঙছে। যতই চেষ্টা করুক না কেন সরকার ভাঙার, ২০২১ আমাদের। ২০২১ বাংলার। জনগণ আছে সঙ্গে, তাই তৃণমূল কংগ্রেস একুশে আসছে বঙ্গে। হার্মাদ সিপিএম আর না। সিপিএমের বন্ধু কংগ্রেস একেবারে না। হার্মাদ বিজেপি একেবারেই না। ‘
‘সোনার ধান দিয়েই বাংলা থেকে বিদায় করব তোমাদের। পুরোহিতদের ১ হাজার বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা সহায়তা দেব। টোটো চালক, অটো চালকরা ৫ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যসাথী পাবেন। ১০ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় নিয়ে আসব। বিনা পয়সাতেই রেশন দেব। এটা আমাদের কমিটমেন্ট। আমেরিকা, রাশিয়া যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ফিরে আসুন বাংলায়। কাজের কোনও অসুবিধা আপনাদের হবে না। পরিযায়ীদের ১০০ দিনের কাজে লাগানো হয়েছে।’
‘বাংলাকে ওনাদের হঠাৎ হঠাৎ করে মনে পড়ে তাইতো। আমরা রেডি করে ফেলেছি তাজপুরে সি পোর্ট হবে। খড়গপুরে তার ইউনিট তৈরি হবে। খুব কম হলেও ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। ২৫ হাজার ছেলে মেয়ের চাকরি হবে’
‘তৃণমূল কংগ্রেস অত দুর্বল নয়। যদি কেউ মনে করে বার্গেনিং করব। তাহলে সেই বিজেপি দল ও বিজেপি দলের বন্ধুদের বলব আগুন নিয়ে খেলবেন না। বিজেপির কাছে টাকা আছে, নো ডাউট, অনেক টাকা আছে অনেক ক্ষমতা আছে। খালি টাকা বঁচানে কে লিয়ে তুমহারে সাথ দোস্তি নেহি করেঙ্গে। এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। এনআরসি নিয়ে কী করেছ। দাদুর বাবার নাম বল তাহলে এখানকার জনগণ হবে। অসমের ২০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিয়েছ। বাংলা গুজরাট হবে না।’
‘মনে নেই কেশপুরে কত হত্যা হয়েছে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন। আজও নন্দীগ্রামে ১৪ জনের উপর মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরে ভয়ে আসতে পারত না। স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক রক্ত আছে এইসব জেলায়। এইসব জেলা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। প্রথমবার অখিল গিরি লড়াই করেছিল।’
‘পিএম কেয়ারের হোয়াইট পেপার প্রকাশ করে বলো এত টাকা পেয়েছি। পাথরে পেরেক পুঁতলে পেরেক ভেঙে যায়। তৃণমূল কংগ্রেসকে কিনতে পারবে না। চ্যালেঞ্জ থাকল। আমাকে গুলি করে মেরে দিল, তারপর বলবে উও তো কোভিড মে মর গ্যায়া। গারবেজ অব লায়েজ। মিথ্যের ডাস্টবিন নিয়ে বসে আছে আর বড় বড় কথা বলছে।’
‘ভারতীয় রেল কে বিক্রি হতে দেব না। বামপন্থী দের অনেকে বিজেপি সমর্থন করে না, তাদের সেলাম। বাংলা ভাল আছে, তাই তোমাদের এত হিংসা। বহিরাগত নিয়ে এসে বাংলা দখল করতে চাও? অত সস্তা না। বহিরাগতদের বাংলা দখল করতে আমরা দেব না, দেব না দেব না। ব্লকে ব্লকে নজর রাখুন বহিরাগত কারা এসে টাকা বিলোচ্ছে।’
পদ্মের একটা পাপড়িও এখানে ফোটাতে পারবে না। ২০০, ২২০-এর আশা ছেড়েই দিন। এ লড়াইয়ে আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থাকবেন তো?
দিদির পথ ধরেই আমরা একুশের লড়াই লড়ব । মা বোনেদের বলবো আশ বঁটিটা বের করতে। এগারো সালের মতো সেগুলোর এখন দরকার। কারণ, এক অশুভ শক্তি এসেছে বাংলায়। তাদের প্রতিহত করতে হবে।
বিশেষ করে রাজ্যজুড়ে তৃণমূল যখন জোট বেঁধে লড়াইয়ের কথা বলছে, তখন দলের অন্দরেই একাধিক নেতার কন্ঠ বেসুরো। মনে করা হচ্ছে, এদিন সভায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের উদ্দেশে বিশেষ কোনও বার্তা দিতে পারেন। একইসঙ্গে তৃণমূলের উন্নয়ন ও কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধেও সুর চড়াতে পারেন মমতা। গত কয়েকদিনে শুভেন্দু-তৃণমূল সংঘাতে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে দ্বিধাভক্ত দলের একাংশ। সেই জায়গা থেকে দলকে চাঙ্গা করতে এদিন মমতার কোনও বিশেষ দাওয়াই থাকে কি না সেদিকেও নজর রাজনৈতিক মহলের।
জেলার যে সমস্ত নেতারা সভামঞ্চ এবং সভামঞ্চ চত্বরে থাকছেন তাঁদের সকলেরই কোভিড-১৯ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয়েছে রবিবার। রিপোর্ট দেখেই প্রবেশাধিকার মিলছে। সকাল থেকেই দফায় দফায় পুলিশ কুকুর দিয়ে পরীক্ষা চলছে মূল মঞ্চ ও সভাস্থল। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এদিনের সভা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সকাল থেকেই চূড়ান্ত প্রস্তুতি সারা। গোটা সভাস্থল স্যানিটাইজ করা হয়েছে। সকাল সকালই পৌঁছে গিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পার্থ চট্টোপাধ্যায়। একে একে আসতে শুরু করেছেন জেলার নেতারাও। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে জনসমাগম। এদিন মূলত তিনটি মঞ্চ থাকছে। একটিতে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে সুব্রত বক্সি, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ছত্রধর মাহাতো, অজিত মাইতি, উত্তরা সিং হাজরা। অপর দুই মঞ্চে বসবেন জেলা নেতৃত্ব ও বিধায়করা।