সন্দেশখালি: তপ্ত সন্দেশখালি। জ্বলছে আগুন, পুড়ছে একের পর এক শিবুর পোলট্রি ফার্মের ঘর, বাগানবাড়ি, খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন সাংবাদিক, ভেঙে ফেলা হচ্ছে ক্যামেরা। অধরা মূল অভিযুক্ত শাহজাহান, শিবু হাজরারা, অথচ শিবুর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রামবাসীদের তুলছে পুলিশ। গ্রাম ঘিরতে শুরু করেছে পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী, স্ট্র্যাকো। বুধবার রাত থেকে কার্যত সন্দেশখালি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। বুধবার রাতে গ্রামে শিবু লোকজনের হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, আর তারপর পরদিন সকাল অর্থাৎ লক্ষ্মীবার থেকেই ‘অস্ত্র’ রাস্তায় রণংদেহি আদিবাসী মহিলারা। কিন্তু বুধবার ঠিক কী ঘটেছিল? একনজরে দেখুন সন্দেশখালির আগাপাশতোলা।
কোন বিষয়টা স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল?
সন্দেশখালিতে ঠিক কোন বিষয়টা স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে? এই বিষয়টা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক সপ্তাহ। সন্দেশখালিতে তৃণমূলে নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডি-র দ্বিতীয় দফার অভিযানের পরদিনই দলের তরফ থেকে রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল বার করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন বিধায়ক। সেই মিছিলে ছিলেন সন্দেশখালির দাপুটে তৃণমূল নেতারাও। কেন্দ্রীয় এজেন্সির অভিযানের প্রতিবাদেই ছিল সেই মিছিল। কিন্তু এই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেননি সন্দেশখালির আপামর সাধারণ বাসিন্দারা।
মিছিল পাল্টা মিছিল
সন্দেশখালির সরবেড়িয়া-সহ একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, তাঁদের জমিই যেখানে দখল করে নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রধান অভিযুক্ত তৃণমূলের দাপুটে নেতারাই, সেখানে কীভাবে এই মিছিল? মন থেকে মেনে নিতে পারেননি গ্রামের বাসিন্দারা। এরপর তাঁদের তরফ থেকেও পাল্টা সুর চড়ে। পাল্টা মিছিল করেন সাধারণ গ্রামাবাসীরা।
মুখ খুলতে শুরু করে সন্দেশখালি
গ্রামবাসীরা আস্তে আস্তে মুখ খুলতে থাকেন। শেখ শাহজাহান নয়, সন্দেশখালির আরও কয়েক দাপুটে নেতা শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলতে থাকেন গ্রামবাসীরা। অভিযোগ ওঠে, কেবল শেখ শাহজাহান নয়, শিবু উত্তমরাও গ্রামে এত গুলো বছর ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তাঁদের গ্রেফতার করতে হবে।
বিক্ষিপ্তভাবে আসতে থাকে অভিযোগ
সন্দেশখালিতে গত শনিবার থেকেই গ্রামবাসীরা বিক্ষিপ্তভাবে মুখ খুলতে থাকেন। যা বৃহৎ আকার নেয় মঙ্গলবার। সেদিন গ্রামের মহিলারা রাস্তায় নামেন। তবে সংখ্যায় ছিল অল্প।
ভাইরাল অডিয়ো নিয়ে উত্তেজনার আগুন
এরই মধ্যে একটি অডিয়ো ভাইরাল হয়। যেটার সত্যতা যাচাই করেনি TV9 বাংলা। যেখানে বলতে শোনা যায়, গ্রামের তিন দিক ঘিরে আক্রমণ চালাতে হবে। একটা গ্রামে তিন দিক থেকে ঘিরে আক্রমণ করতে হবে। ২০ থেকে ২৫ টা ছেলেকে তুলে নিয়ে এসে ট্রিটমেন্ট করা হবে বলছেন উত্তম।
উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে জনরোষ
এরপরই জনরোষে অগ্নিগর্ভের চেহারা নেয় সন্দেশখালি। উত্তম সর্দার জনরোষের মুখে পড়েন। তাঁর পোলট্রি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দেন উত্তেজিত জনতা। তাঁকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, সে সময়ে পুলিশ উত্তম সর্দারকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি দোকানের ভিতর শাটার ফেলে লুকিয়ে রাখে পুলিশ। তারপর সেখানেই চিকিৎসক ডেকে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আরও অভিযোগ, জনরোষ থেকে বাঁচাতে উত্তম সর্দারকে থানায় নিয়ে গিয়ে দুদিন ধরে রেখে দেয় পুলিশ। তাতে আরও ক্ষেপে ওঠেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, উত্তর সর্দারের বিরুদ্ধেই যেখানে এক গুচ্ছ অভিযোগ, সেখানে পুলিশ বলছে, উত্তমের বিরুদ্ধে কোনও ‘অভিযোগ’ই নেই। আরও ক্ষেপে ওঠেন গ্রামবাসীরা।
বৃহস্পতিবার সন্দেশখালির রাস্তায় ঝাঁটা লাঠি হাতে হাজার হাজার মহিলা
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্দেশখালির রাস্তায় নামেন হাজার হাজার আদিবাসী মহিলা। থানা ঘেরাও করতে যান তাঁরা। পুলিশের বিরুদ্ধে উগরে দেন ক্ষোভ। হাতে তাঁদের বাঁশ, লাঠি, ঝাঁটা। শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলতে থাকেন তাঁরা। প্রকাশ্যে আসতে থাকে সন্দেশখালির অন্দরের একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রীতিমতো হিমশিম খায় পুলিশ।
শুক্রবার সকাল, জ্বলছে সন্দেশখালি
এরপর শুক্রবার সকাল। একটি ভাইরাল ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে। যার সত্যতা যাচাই করেনি TV9 বাংলা। যেখানে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনকারীদের বাড়ির সামনে তৃণমূল নেতাদের ভিড়। অভিযোগ ওঠে, বেছে বেছে এবার আন্দোলনকারীদের টার্গেট করছে তৃণমূল। বিক্ষোভ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সন্দেশখালিতে শিবু হাজরার পোলট্রি ফার্ম, বাগানবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে। হালদারপাড়ায় সে খবর সংগ্রহ করতে যায় TV9 বাংলা। সেখানে আক্রান্ত হতে হয় আমাদের সাংবাদিক সৌরভ দত্ত ও চিত্র সাংবাদিক গৌরব পালকে। শিবু হাজরার শাকরেদরা TV9 বাংলাকে খবর করতে বাধা দেয়। আমাদের প্রতিনিধির ওপর চলতে থাকে কিল, ঘুষি, চড়। ক্যামেরা ভেঙে জলে ফেলে দেওয়া হয়।
শিবু হাজরার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রামে পুলিশি ধরপাকড়
এরপর শিবু হাজরার তরফ থেকে আন্দোলনকারী গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ১১১ জন আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। তাতে আরও ক্ষেপে ওঠেন গ্রামবাসীরা। পুলিশকে ‘চুরি’ পরাতে বাড়ি থেকে চুরি নিয়ে আসেন মহিলারা। এখানে তাঁদের হাতে থাকে লাঠি, বাঁশ. গাছের ডাল! একেবারে রণংদেহি মূর্তিতে গ্রামের হাজার হাজার মহিলারা।
গ্রাম ঘিরতে শুরু করে পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী
এরপর বেলা গড়াতে গ্রাম ঘিরতে শুরু করে পুলিশ। গ্রামবাসীদের ধরপাকড় শুরু হয়। আর ততই বাড়তে থাকে বিক্ষোভের আগুন! গ্রামে পৌঁছে যান পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তারা। গ্রামে বন্দুক হাতেও ঘুরতে দেখা যায় কয়েকজনকে। TV9 বাংলার ক্যামেরায় ধরা পড়ে সেই ছবি। শুক্রবার বিকালে এডিজি আইনশৃঙ্খলা মনোজ ভর্মা, সন্দেশখালির পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।