বছর কুড়ি আগে এমন সেপ্টেম্বরেই ছিন্নভিন্ন হয়েছিল বাবার দেহ, এবার সেই মাসুদ-পুত্রই লড়াই দিচ্ছে তালিবানকে

9/11 Attack: আল-কায়দার মাস্টারস্ট্রোক বলা যায় মাসুদের হত্যা। হিসেব কষাই ছিল। আমেরিকা আফগানিস্তানে আক্রমণ হানতে পারে ৯/১১-র পর।

বছর কুড়ি আগে এমন সেপ্টেম্বরেই ছিন্নভিন্ন হয়েছিল বাবার দেহ, এবার সেই মাসুদ-পুত্রই লড়াই দিচ্ছে তালিবানকে
৯/১১-এর কুড়ি বছর।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 11, 2021 | 12:52 PM

শৌর্য ভৌমিক: নয় নয় দু’হাজার এক। আহমেদ শাহ মাসুদ নিজের বাংলোতে বসে ফারসি কবিতা পড়ছিল। এক সহকর্মী এসে বলল, “দুই সাংবাদিক বহুদিন অপেক্ষা করছেন ইন্টারভিউয়ের জন্য”। মাসুদ রাজি হল। প্রশ্ন অধিকাংশ লাদেনকে নিয়ে। মাসুদ জানাল, সে তৈরি। ক্যামেরার শাটার টেপা মাত্রই বিস্ফোরণ। ছিন্নভিন্ন মাসুদ এবং সাংবাদিক।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর বিন লাদেন ইউনিটকে যোগাযোগ করে আমরুল্লাহ সালেহ বলল, “মাসুদ মৃত, দেহ মর্গে”। সন্দেহের তির আল-কায়দার দিকে। ঘাঁটি ধরে রাখার জন্য ছড়ানো হল মাসুদ আহত, বেঁচে আছে। কিন্তু সিআইএ থেকে হোয়াইট হাউস যেতেই খবর ‘লিক’ হল সংবাদ মাধ্যম সিএনএন-এর কাছে। ১০ সেপ্টেম্বরে পুরো বিশ্ব জেনে গেল। সালেহর আবার ফোন ভার্জিনিয়ায় ল্যাংলির সিআইএ-এর সদর দফতরে। বুঝিয়ে দিল লড়াই এখন কঠিন।

এরপর ঠিক ৩৬ ঘন্টা। সেপ্টেম্বর ১১। প্রথম বিমান ধাক্কা দিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ টাওয়ার। এরপরের দু’ঘন্টায় আরও ৩টে বিমান হানা। দ্বিতীয়টা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর টাওয়ার। তৃতীয়টা পেন্টাগন। মার্কিন প্রতিরক্ষার সদর দফতর। চতুর্থ বিমানের লক্ষ্য ক্যাপিটল, যেখানে মার্কিন সেনেট বসে। সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় বিমানের যাত্রীদের রুখে দাঁড়ানোতে।

আল-কায়দার মাস্টারস্ট্রোক বলা যায় মাসুদের হত্যা। হিসেব কষাই ছিল। আমেরিকা আফগানিস্তানে আক্রমণ হানতে পারে ৯/১১-র পর। সেইক্ষেত্রে মাসুদ, যে কিনা সিআইএ-এর যোগ্য সঙ্গী তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইতে, আল-কায়দার বিরুদ্ধেও জোরকদমে নামবে। তাকে সরানোর রাজনৈতিক চাল আগে খেলা হল।

‘দ্য সিস্টেম ওয়াজ ব্লিঙ্কিং রেড’। ঠিক এটাই বলছে নাইন ইলেভেন কমিশন। মার্চ থেকে অগস্ট ২০০১ অবধি ওয়ার্নিং ছিল। এফবিআই থেকে সিআইএ সবার কাছে সতর্কতা আসছিল। কেউ বলে সমন্বয়ের অভাব ছিল বিস্তর। দেশের মাটিতে না বিদেশের মাটিতে? কোথায় হতে পারে হামলা? এই নিয়ে বিব্রত মার্কিন এজেন্সি। ওদিকে হাইজ্যাক করার জঙ্গিরাও আমেরিকাতে এসে ফ্লাইট একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে!

৩০০০ মানুষের মৃত্যু । কেউ পুড়ে ছাই হয়ে তো কেউ ১০০ তোলার ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে । তপ্ত আমেরিকা । গর্জে উঠল ইস্ট থেকে ওয়েস্ট কোস্ট। নর্থ ডাকোটা থেকে টেক্সাস। ঘন্টা বাজল ওয়ার অন টেররের। পাকিস্তানকে জানিয়ে দেওয়া হল বোমা মেরে স্টোন এজে পাঠিয়ে দেওয়া হবে সহযোগিতা না করলে। বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইতে তোমরা হয় আমাদের সঙ্গে অথবা আমাদের বিরুদ্ধে। স্বাধীন থাকার জায়গা নেই। পশতুন বিধি অনুযায়ী তালিবান জানাল লাদেনকে তুলে দেওয়া যাবে না। ৭ অক্টোবর শুরু হল অপারেশন এনডুরিং ফ্রিডম। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আব্দুল রাশিদ দস্তুম, নর্দার্ন এলায়েন্স।

অবিরাম বোমাবর্ষণ এবং মিসাইল স্ট্রাইক-এ তিন মাস লেগেছিল তালিবান এবং আল-কায়দাকে কোণঠাসা করতে। ডিসেম্বরের শেষে গিয়ে আফগান জমিতে মার্কিন বাহিনী, দস্তুমের ঘোড়সওয়ার সেনা এবং মাসুদের বাহিনী তাড়া করছে তালিবান এবং আল-কায়দাকে। ডিসেম্বরে লাদেন, আল-কায়দা ও তার দলবল একদম পাকিস্তান সীমানায় তোরাবোরার গুহায়। তারপরের ঘটনাবলী কিছুটা ধোঁয়াশা।

ফিরে এল তালিবানের পুরনো দোস্ত আইএসআই। কিছু বিশ্লেষকের মত আল-কায়দা এবং তালিবানকে পাকিস্তান ঢুকতে দেয় গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। ওদিকে তারাই আবার নানা তালিবান, আল-কায়দা জঙ্গিকে অপহরণ করে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে ডলার কামাচ্ছে ।

তালিবানের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অনেক আফগান মানুষ খুশি হলেও ২০০২ থেকে অভ্যন্তরীণ অবস্থা বদলাচ্ছিল। আমেরিকার বোমাবর্ষণ কেঁড়ে নিচ্ছিল অনেক নির্দোষ আফগানের প্রাণ । প্রতিবাদে মুখ খুলতে শুরু করেছে মানুষ । নতুন যে আফগান সরকার তৈরি হয় তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ । নতুন যে আফগান সেনা প্রশিক্ষণ পাচ্ছে মার্কিন বাহিনীর থেকে তাদেরও নাকি অনেকে নেশাগ্রস্ত এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি করেই মরছে । ওদিকে ইরাকে যুদ্ধ পাকিয়ে আমেরিকায় যেন লাদেনের কথা প্রমাণ করল, যে তারা মুসলিম দুনিয়াকেই টার্গেট করছে ।

২০১১ সাল । অবশেষে লাদেনের খোঁজ পাওয়া গেল পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে । রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানকে না জানিয়েই অপারেশন জেরোনিমোর ব্লুএপ্ৰিন্ট তৈরি করল আমেরিকা । ৪০ মিনিটের অপারেশন । খতম ওসামা বিন লাদেন । এরপর অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো মার্কিন বাহিনীর থেকে যাওয়া । ততদিনে ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে । মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের ।

২০১৪ সাল । ওবামা জানিয়ে দিল অপারেশন এনডুরিং ফ্রিডম শেষ হতে চলেছে । পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নেওয়া হবে সেনা । ২০১৬র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রার্থী ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন ক্ষমতায় এলে সরানো হবে সেনা । অব্যবস্থার সুযোগ কিন্তু তলেতলে নিচ্ছিল তালিবান । অবশিষ্ট যারা, তাড়া একত্রিত হয়ে এলাকা দখলে নামছিল ।

২০১৮-তে শুরু হল দোহাতে আলোচনা । আমেরিকা, আফগান সরকার এবং তালিবানের মধ্যে । ওদিকে লড়াই শুরু হয়ে গেছে আবার । আফগান সেনা বনাম তালিবান । তালিবানের দখল বাড়ছে । ফেব্রুয়ারি ২০২০-তে দোহা চুক্তি সই হল আমেরিকা এবং তালিবানের মধ্যে । প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমেরিকা পুরো সেনা প্রত্যাহার করবে এবং তালিবান আল-কায়দাকে জায়গা দেবে না ।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল চুক্তির দেড় বছরের মধ্যেই । তালিবান ফের ক্ষমতায় । এবার আহমেদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমেদ মাসুদের লড়াই দিচ্ছেন। পাকিস্তান ফের স্বমহিমায় তালিবানের চালিকাশক্তি হয়ে।

আরও পড়ুন: ‘পচুক ওর দেহটা’, আমরুল্লাহর ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাইরেই ফেলে রাখল তালিবরা