Explained: মোসাদ কি ব্রহ্মা? সত্যিই সবার ‘গোপন কম্ম’ জানে?
কখনও নিজের বাড়িতে, কখনও আবার চলন্ত গাড়িতেই নিকেশ হয়ে যাচ্ছে ইরানের সেনাকর্তারা। চারদিনের ব্যবধানে দু'জন শীর্ষ সেনাপ্রধান খতম। কীভাবে এত নিখুঁত তথ্য? মোসাদের নেতৃত্বে কে? একদিনে এই পরিকল্পনা হয়নি। কীভাবে হয়েছে?

ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী যখন ইরান অভিযানের কথা ভেবেছিলেন, তখনই অনেকেই তাঁকে সতর্ক করে বলেন, ‘এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে!’ তেহরান তাদের পরমাণু বোমা তৈরির কাজ কতদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, এ বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন ইজরায়েলের শীর্ষ সেনা কর্তারাও। অনেকেই ইরানে সরাসরি সামরিক অভিযানের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সেই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতেও ইরানে সামরিক আগ্রাসনের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন দু’জন মানুষ। যাঁদের মধ্যে একজনের কাছে ইরানের সবকটি পারমাণবিক গবেষণাগার, ব্যালিস্টিক মিসাইল ভাণ্ডার থেকে শুরু করে সেনাঘাঁটি, এমনকী সেনাকর্তাদের যাত্রাপথেরও নিখুঁত তথ্য মজুত ছিল আগে থেকেই। যা ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন‘ চলাকালীন তেল আভিভকে ‘অ্যাডভান্টেজ‘ পেতে সাহায্য করে। কারা সেই দু’জন? কার তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরানে এত বড় অপারেশন চালাল ইজরায়েল?
সেই দু’জন হলেন মোসাদের ডিরেক্টর ডেভিড বার্নিয়া ও ইজরায়েলি বায়ুসেনার প্রধান মেজর জেনারেল তোমার বার। চর মারফত শত্রুর আগাম গতিবিধির নিখুঁত তথ্য এনে দেয় মোসাদ। আর যুদ্ধের মাটিতে আকাশপথে হামলা চালাতে ইজরায়েলি বায়ুসেনাকে ব্যাপক দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন বায়ুসেনা প্রধান। একটা কথা আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করছেন, যে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ দেখিয়ে দিল কীভাবে ইজরায়েলের দুই সামরিক শাখা একে অপরের সঙ্গে নিখুঁত কো-অর্ডিনেশনে কাজ করেছে। ‘ওরা দু’জনে মিলে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে যেতে পারে, এমন যে কোনও ভুলচুককে ‘মিলিমিটার’ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন’, জানিয়েছেন ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক শীর্ষ আধিকারিক। ‘ওরা দু’জনে মিলে এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। যার পুরোটা আমাদের কাছেও সে সময় স্পষ্ট ছিল না। ওরা দু’জনে একেবারে খুঁটিনাটি কী কী ভুল হতে পারে সেটা পর্যন্ত আগাম আঁচ করেছিলেন। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, ওদের পরিকল্পনার সিকিভাগও এখনও দেখা যায়নি। আমাদের আস্তিনে এখনও অনেক তাস লুকানো।’
ইজরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাচি হানেগবি অনেকদিন ধরেই ইরানে সামরিক অভিযানের পক্ষে সওয়াল করে আসছিলেন। তিনিই মূলত নেতানিয়াহুকে এই অভিযান চালাতে উৎসাহ দেন। পাশাপাশি, ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামিরকে আবেদন করেন, ব্যাকআপ সাপোর্ট তৈরি রাখতে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাই নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেটের সামনে মোসাদের অভিযানের পরিকল্পনা পেশ করেন। সেনার ‘ব্যাক-আপ’ পাওয়ার আশ্বাস পেতেই অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২০০৭ থেকে একাধিকবার ইরানে হামলার পরিকল্পনা হলেও আইডিএফ কর্তাদের একাংশ প্রতিবারই বাধা দিয়ে এসেছেন। আজ পর্যন্ত অন্তত তিনজন শীর্ষ ইজরায়েলি সেনাকর্তা ইরানে অভিযান চালানোয় আপত্তি জানান। আর ২০১৫-য় আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় ইরান অভিযানের গোটা পরিকল্পনাই হিমঘরে চলে যায়।
২০২১-এ ডেভিড বার্নিয়া মোসাদের ডিরেক্টর পদে আসার পর ফের ইরান মোসাদের ‘ফুল স্কেল’ অভিযানের পরিকল্পনার ফাইল নড়ে ওঠে। এবার মোসাদ-ই গোটা অপারেশনের প্ল্যান করে। বার্নিয়া ও তাঁর স্পাইরা প্রায় দেড় বছর ধরে ইরানের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করেন। এমনকী, এবার মোসাদের গুপ্তচরেরা লুকিয়ে, ছদ্মনাম নিয়ে তেহরানের ভিতরে ঢুকে পড়েন। ড্রোন-সামরিক সরঞ্জাম বড় বড় ট্রাকে চাপিয়ে ইরানে স্মাগল করে মজুত রাখা হয়। ক্ষমতায় এসে মোসাদকে ঢেলে সাজান বার্নিয়া। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘বার্নিয়া দায়িত্বে এসেই এজেন্সিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেন। স্মার্ট সার্ভেলেন্স ক্যামেরা, ফেসিয়াল রেকগনিশন, বায়োমেট্রিক-এর মতো কাটিং এজ টেকনোলজি এনে মোসাদে হৈচৈ ফেলে দেন। ভুলে গেলে চলবে না, মোসাদ কিন্তু একটি প্রাচীনপন্থী সংস্থা। এখানে নতুন প্রযুক্তি আনা সহজ ছিল না। প্রথাগত পদ্ধতিতেই এখানে কাজ হত। নয়া প্রযুক্তির আমদানি করায় বার্নিয়াকে এজেন্সির ভিতরেই অনেক সমালোচনা শুনতে হয়।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই কর্তা আরও বলেন, ‘বার্নিয়াকে এজেন্সির অভ্যন্তরীণ সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছে। কিন্তু বার্নিয়া যা করেছেন, তার প্রমাণ আজ তেহরানের রাস্তায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।’
বার্নিয়া চরিত্রগত দিক থেকেও তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে আলাদা। ইয়োশি কোহেন, মোসাদের প্রাক্তন প্রধানের চেয়ে বার্নিয়ার কাজ করার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। বার্নিয়া শিরোনামের পরোয়া করেন না! মোসাদের কোনও অপারেশন নিয়ে আজ পর্যন্ত তিনি কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি। কিন্তু বার্নিয়া আত্মকেন্দ্রিকও নন, বলছেন তাঁর সহকর্মীরাই। কোনও অধস্তনও যদি ভাল কোনও তথ্য নিয়ে আসেন বা পরিকল্পনার সুপারিশ করেন, মোসাদ প্রধান মন দিয়ে তাঁর কথা শোনেন। অন্যদের কথা শুনলে ডিরেক্টর হিসাবে তাঁকে খাটো ভাবা হবে, এমনটা বার্নিয়া নাকি মোটেও ভাবেন না। ৬০ বছরের বার্নিয়া তাঁর নেতৃত্বে এমন কাজ করে দেখিয়েছেন, যা এর আগে কোনও মোসাদ প্রধানই করে দেখাতে পারেননি। বিশেষত ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাস গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে তিনি সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন। নেতানিয়াহু-র মতো মোসাদ প্রধানও মনে করতেন, ইরানের সঙ্গে ওবামা আমলে আমেরিকা যে পারমাণবিক শান্তি চুক্তি করেছিল, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত। কিন্তু সেবার দেখা গেল মোসাদ প্রধানের অনুমান খাটল না। ওবামা ২০১৮-র মে মাসে ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করায় ফল হল উল্টো। ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেল যে তেল আভিভ ভাবল এই বুঝি ইরান পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলল। অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল তেহরানে সামরিক অভিযান।
২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে মোসাদ প্রধান বার্নিয়া শিরোনামে উঠে আসেন হেজবোল্লা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বিপার’ চালিয়ে। তেহরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীর হাজার হাজার সদস্যদের ওয়াকিটকি, পেজারে গোপনে বোমা ঢুকিয়ে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় মোসাদ। গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা, ইন্টেলিজেন্স সংস্থা, গুপ্তচরেরা অবাক হয়ে দেখল, এমনটাও সম্ভব? এখানেই শেষ নয়, ২০২৪-এই তেহরানের বুকে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে নিকেশেরও মাস্টারমাইন্ড সেই বার্নিয়া। সেই শুরু। অপারেশন রাইজিং লায়নে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে মোসাদ। ইরানের তাবড় তাবড় শীর্ষ সেনাকর্তাকে নিখুঁত লক্ষ্যে নিকেশ করেছে মোসাদের চরেরা। কাউকে বাড়িতে, কাউকে চলন্ত গাড়িতেই উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৪ দিনের ব্যবধানে ইরানের দুই সেনাপ্রধানকে নিকেশ করেছে মোসাদ। ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আরেক কর্তার কথায়, ‘বার্নিয়া বুঝেছিলেন ইরানে পুরোদমে অভিযান চালানো ছাড়া এবার আর কোনও অন্য উপায় নেই। তাঁকে কিন্তু ইরানের সামরিক শক্তিরও আঁচ করতে হয়েছিল। এমনকী ট্রাম্পও যে শুরুতেই সরাসরি ইরান আক্রমণ করবেন না, সেটাও অনুমান করতে পেয়েছিলেন মোসাদ প্রধান।’ অন্যদিকে ইরান আঁচও করতে পারেনি, দিনের পর দিন তাদেরই সীমান্তে ইজরায়েলি ট্রাক গোলাগুলি, ড্রোন, বিস্ফোরক নিয়ে ঢুকে তেহরানেই মোসাদের আরেকটা ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছিল প্রায়। অপারেশন রাইজিং লায়ন শুরু হতেই একে একে ওই ট্রাক থেকে ড্রোন উড়ে গিয়ে ইরানের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, সেনাঘাঁটি, পারমাণবিক ঘাঁটিতে আছড়ে পড়ে।
সব ঠিক থাকলে, ২০২৬-এর জুন বার্নিয়া অবসর নেবেন। যদি না ইজরায়েল সরকার তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করে। অবসরের পর রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারেন বার্নিয়া। কিন্তু তার জন্য ৩ বছর ‘কুলিং পিরিয়ড‘ পর্যন্ত নিয়মমাফিক অপেক্ষা করতে হবে। এমনকী ইজরায়েলের রাজনৈতিক দলগুলি তাঁকে দলের মাথাতেও বসাতে পারে এতটাই এখন তেল আভিভে বার্নিয়ার জনপ্রিয়তা। বার্নিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর এক সহকর্মী বলছেন, ‘উনি হয়তো সংবাদমাধ্যমে গরমাগরম ভাষণ দেন না, কিন্তু সব রাজনৈতিক দলই চাইবে তাঁর মতো ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন একজনকে দলে নিতে, যিনি রাজনীতির অভিমুখটাই পাল্টে দিতে পারেন।’ তবে অবসরের পরপরই যে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ারে আগ্রহ নেই বার্নিয়ার, সেটা স্পষ্ট করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরাই।
