পটনা: শিক্ষা ক্ষেত্রে বারবার বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কারণে বদনাম হয়েছে বিহার রাজ্যের। চলতি বছরেও জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, অশিক্ষার হারে দেশের সবথেকে আগে থাকা রাজ্যগুলির তালিকায় তিন নম্বরে আছে বিহার। কাজেই যদি বলা হয়, এই বিহার রাজ্যেই আছে এমন এক গ্রাম, যেখানে প্রতি ঘরে ঘরে অন্তত একজন করে আইআইটি গ্র্যাজুয়েট তাহলে তা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে, অবস্থা এমনই যে বর্তমানে গ্রামটির নামই হয়ে গিয়েছে ‘আইআইটি গ্রাম’। প্রতি বছর এই গ্রাম এবং আশপাশের কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে অন্তত ২০-২৫ জন করে ছাত্রছাত্রী ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। গ্রামের অনেকে আইআইটি থেকে পাস করে, ইতিমধ্য়েই মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছেন। আর এই ঐতিহ্য চলে আসছে সেই গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে।
বিহারের গয়া জেলার ফল্গু নদীর তীরে অবস্থিত, পাটোয়া টলি গ্রাম। আগে এই গ্রাম পরিচিত ছিল তাঁত বোনার জন্য। কিন্তু, ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে অবস্থাটা বদলে যায়। ওই সময় বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে তাঁত বোনার জন্য ব্যবহৃত বেশ কিছু পাওয়ার লুম বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ব্যবসার সুযোগ কমে যাওয়াতেই অনেক পরিবারের যুবরাই পড়াশোনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। জিতেন্দ্র প্রসাদ নামে গ্রামের এক ছাত্র প্রথম আইআইটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ২০০০ সালে তিনি মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। তিনিই গ্রামের যুবদের সামনে আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। গ্রামের বহু যুবক বিশ্বাস করতে থাকেন, জিতেন্দ্র পারলে তারাও পারবে। শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম।
পর পর কয়েক বছর পাটোয়া টোলি গ্রাম থেকে ছাত্ররা আইআইটি-তে সুযোগ পাওয়ার পর, গ্রামের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্ররা মিলে ‘বৃক্ষ’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। ওই সংস্থা এখন গ্রামের আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক ছাত্রদের বিনামূল্যে সাহায্য করে। আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকেও ছাত্রছাত্রীরা আসেন বৃক্ষের পাঠ নিতে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চন্দ্রকান্ত পাটেশ্বরী জানিয়েছেন, ‘যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বাইরে কোথাও যেতে পারে না, তাদের গাইড করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’ গ্রামের যে সকল ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে আইআইটি-তে পড়াশোনা করছে, তারাও ‘বৃক্ষে’র মাধ্যমে গ্রামের পরবর্তী যুবকদের অনলাইন ক্লাস নেয়।
এর পাশাপাশি গ্রামে একটি আইআইটি গ্রন্থাগারও গড়ে তোলা হয়েছে। সেটি গ্রামের যুবকরাই পরিচালনা করেন। প্রাক্তন ছাত্ররা সেই গ্রন্থাগারে বই দান করেন। বিভিন্ন বিষয়ের নোটস দান করেন। গ্রামের আইআইটি প্রার্থীরা বিনা পয়সায় সেই গ্রন্থাগারের লাভ নিতে পারেন। সম্প্রতি দেলা প্রশাসনের সহায়তায় গয়া জেলাতেই আরও একটি এই ধরনের গ্রন্থাগার স্থাপন করেছে ‘বৃক্ষ’। ছাত্রছাত্রীদের মুতুল সাড়া পেয়ে সংগঠনটি এখন জেলার প্রতিটি পঞ্চায়েতে এই জাতীয় গ্রন্থাগার খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাটোয়া টলি গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ১০,০০০। তাঁদের বেশিরভাগই এখনও পেশায় তাঁতি। গ্রামের ঢুকলেই এখনও প্রথমেই কানে আসে পাওয়ার লুমের আওয়াজ। তবে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে ডেমোগ্রাফি। এখনও পর্যন্ত, গত আড়াই দশকে এই গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামের প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের দাবি, পাওয়ার লুমের যন্ত্রের আওয়াজ তাঁদের কানে সঙ্গীতের মতো বাজে। তার মধ্যেই পড়াশোনা করতে অভ্যস্ত তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করার পর, শুধু পাটোয়া টলি গ্রামেরই অন্তত ২৫টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করেছে।
পাটোয়া টলির গ্রামের বাসিন্দারা, যাঁরা পাওয়ার লুমে শ্রমিক বা তাঁতি হিসাবে কাজ করেন, তাঁরাও চান তাঁদের সন্তানদের আইআইটিয়ান কর চতুলতে। অর্থনৈতিক দুর্দশাও তাদের মনোবল ও ইচ্ছাশক্তিকে দমাতে পারেনি। নিজেরা আধপেটা থেকেও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া যাতে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করেন বাবা-মায়েরা। টিউশন ফি বা সন্তানদের অন্যান্য শিক্ষাগত প্রয়োজনীয়তা মেটাতে টাকা ধার করতেও পিছপা হন না তাঁরা। স্বপ্ন একটাই, আইআইটি!